মেহেদী হাসান, রাজশাহী: পেস্টি ডেস পেটিটস ইন রুমিন্যান্টসের সংক্ষিপ্ত নাম পিপিআর। পিপিআর গবাদিপশু, যেমন ছাগল, ভেড়া ও গাড়লের একটি মারাত্মক ভাইরাসজনিত রোগ। সেইসঙ্গে ফুট অ্যান্ড মাউথ বা এফএমডি গরু-ছাগলের অতিপরিচিত রোগ। এ দুটি ভাইরাসজনিত রোগের হাত থেকে দেশের খামারি ও প্রান্তিক কৃষকদের বাঁচাতে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করে সরকার। প্রায় বছর চারেক আগে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ‘পিপিআর রোগ নির্মূল এবং ক্ষুরারোগ নিয়ন্ত্রণ’ শীর্ষক প্রকল্প হাতে নেয় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। কিন্তু এ প্রকল্পের প্রায় পাঁচ হাজার শিক্ষিত যুবক বেকার হয়ে অসহায়ভাবে দিন গুনছেন এবং পাননি একটি টাকাও।
ভুক্তভোগী অন্তত ২০ জন তাদের অসহায়ত্বের কথা জানান। তারা বলেন, কাগজ-কলমে ও কর্মকর্তাদের মুখ দিয়ে ভাইরাস মারা চলমান রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে কাজের বেলায় কিছুই হচ্ছে না। দীর্ঘ সাড়ে তিন বছর পার হলেও প্রকল্পের কাজ সরকারি হিসেবে ৩০ শতাংশ এগিয়েছে। অন্যদিকে সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, পাঁচ শতাংশের বেশি কাজ হয়নি। সেসময় তোড়জোড় করে সারাদেশে রোগ নির্মূল করতে গিয়ে সরকারের তহবিল থেকে ৩৪৫ কোটি ২৯ লাখ টাকা খরচের হিসাব ধরা হয়।
সূত্রে জানা যায়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় ৩৮১ কোটি ৭৩ লাখ ১৭ হাজার টাকা। ২০১৯ জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য ধরা হয়। জানুয়ারিতেই পিপিআর রোগ নির্মূল এবং ক্ষুরারোগ নিয়ন্ত্রণ শীর্ষক প্রকল্পের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। পরবর্তী সময়ে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় প্রকল্পটির প্রাক্কলিত খরচ ধরা হয় ৩৪৫ কোটি ২৯ লাখ টাকা।
প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রম দেখানো হয়, টিকা দেয়া ও স্বেচ্ছাসেবী ভ্যাকসিনেটর নিয়োগ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাচাই এবং নমুনা সংগ্রহ, পিপিআর ও ক্ষুরা রোগের ভ্যাকসিন উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি, সিডিআইএলের জন্য যন্ত্রপাতি কেনা, কৃমিনাশক বিতরণ, হেলথ কার্ড বিতরণ ও রেকর্ড সংরক্ষণ, প্রশিক্ষণ, চারটি কুলভ্যান কেনা এবং জনসচেতনতা তৈরি করা। এগুলো কার্যত কিছুই হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
অনুমোদনের পর নিয়মানুযায়ী ২০১৯ সালের ২ জুলাই প্রেষণে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয় বিএলআরআই’র মিডিয়া অ্যান্ড শিড কালচার শাখার ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মো. এমদাদুল হককে। তিনি নিয়োগ পাওয়ার পর শুরু করেন ভ্যাকসিনেটর নিয়োগ দেওয়াসহ বিভিন্ন কাজ। তার কিছুদিন পর মারা যান প্রকল্প পরিচালক। এরপর আসেন নতুন পরিচালক অমল জ্যোতি চাকমা।
বর্তমান প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্বে আছেন ডা. ফজলে রাব্বি। প্রকল্পের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সারাদেশের প্রতিটি ইউনিয়নে ভ্যাকসিনেটর নিয়োগ দেয়া আছে। পাঁচ হাজারের বেশি ভ্যাকসিনেটর কাজের জন্য প্রস্তুত। বর্তমানে রংপুরের আট জেলায় ভ্যাকসিন প্রদান কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এছাড়া পাবনা, সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও ভোলা জেলায় এফএমডি টিকা দেয়া হচ্ছে। কাজের অগ্রগতি ৩০ শতাংশ বলে দাবি করেন এ কর্মকর্তা।
তবে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। মাত্র চার মাসে বাকি কাজ শেষ হবে কি নাÑজানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হবে। যারা ভ্যাকসিনেটর রয়েছেন, তারাই থাকবেন। এরই মধ্যে আমরা কাগজপত্র সব ঠিক করেছি। মেয়াদ বাড়লেও টাকার পরিমাণ বাড়বে না বলে জানান তিনি। কিন্তু কাজ কেন হলো নাÑএমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘বাইরে থেকে টিকা কিনতে হয়, ফলে এখনও কেনা হয়নি বলেই সারাদেশে এর কার্যক্রম বন্ধ আছে। ভ্যাকসিনেটরদের বেকার করে রাখার বিষয়ে তিনি তেমন মন্তব্য করতে রাজি হননি। ‘প্রত্যেকের কাজ শুরু হবে’ বলে জানান এ প্রকল্প পরিচালক।
কাজ না করেই ৩৪৫ কোটি ২৯ লাখ টাকা লোপাট করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘১৩০ কোটি টাকার মতো খরচ হয়েছে এ পর্যন্ত। নতুন টেন্ডার হবে, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে নিয়ম মেনে সব করা হবে। আমরা ভ্যাকসিন পাওয়ার পরপরই ভ্যাকসিনেটদের হাতে পৌঁছে দেব। তারা পাঁচ টাকা করে পাবে প্রতিটি ভ্যাকসিনের জন্য।’
সারাদেশে চার হাজার ২১২ ভ্যাকসিনেটর নিয়োগ দেওয়া হয় বিভিন্ন সময়ে। যাদের প্রত্যেকেই নিজ দায়িত্বে ইউনিয়নের গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া, গাড়লসহ গবাদিপশুকে টিকা দেবেন। স্বেচ্ছাসেবী হলেও প্রতিটি টিকা দেওয়ার জন্য প্রকল্প থেকে পাঁচ টাকা পাবেন ওই ভ্যাকসিনেটর। কিন্তু নিয়োগের ক্ষেত্রে দেয়া হয় কঠোর নিয়ম। যারা এ প্রকল্পের আওতায় রয়েছেন, তারা অন্য কোনো পেশায় বা চাকরিতে যেতে পারবেন না। আশ্বাস দেয়া হয়, এ প্রকল্প সারাদেশের জন্য, যা পুরো তিন বছর চালু থাকবে।
প্রকল্প শুরু ও নিয়োগের এক বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর যখন কর্মক্ষেত্র এবং কার্যক্রম বুঝিয়ে না দেয়া হয়, তখন নিয়োগপ্রাপ্ত চার হাজার ২১২ ভ্যাক্সিনেটর একতাবদ্ধ হয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে ধরনা দিতে থাকেন। অবশেষে ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি তারা ‘বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার ভ্যাক্সিনেটর অ্যাসোসিয়েশন’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। পরে প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি, জেলা-উপজেলায় মানববন্ধন এবং জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অনশন করেন। ফলাফল দাঁড়ায় শূন্য।
প্রশ্ন দাঁড়ায়, ৩৪৫ কোটি ২৯ লাখ টাকার কাজ না করেই গায়েব হয়ে গেল! আসলে তাও হয়নি। কৌশলে চারটি জেলায় ‘পিপিআর রোগ নির্মূল এবং ক্ষুরারোগ নিয়ন্ত্রণ’ প্রকল্প চালু করা হয় এবং চলমান রাখা হয়। ভোলা, মানিকগঞ্জ, পাবনা ও সিরাজগঞ্জে কাজ শেষ দেখানো হয়। পিপিআর রোগের কাজ হয় শুধু রংপুর বিভাগে। এছাড়া দেশের কোথাও কাজের তথ্য পাওয়া যায়নি, যেক্ষেত্রে সবাই বেকার অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এখন ভ্যাকসিনেটরদের প্রশ্নÑযদি কাজ না হয় তাহলে নিয়োগ কেন, প্রশিক্ষণ কেন, আর কেনইবা এ আশ্বাস। আজ হবে, তো কাল হবেÑএমনটা বলে তিন বছর চার হাজার মানুষকে বসিয়ে রাখার এ ডামাডোল কেন?
কথা হয় রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার ঘাষিগ্রামের বেলনা এলাকার মো. মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে। তিনি নিয়োগ পেয়েছেন ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে। ঢাকায় প্রশিক্ষণ শেষে তিন বছর বেকারত্বের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে মানবেতর দিন কাটছে তার। নিয়োগের পর ভেবেছিলেন প্রতি টিকায় পাঁচ টাকা পেলে অন্তত পরিবারের হাল ধরতে পারবেন। সেই আশায় গুড়েবালি। তিনি বলেন, সরকার একটা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে দেয় শতকোটি টাকা। টাকাগুলো জনগণের। কিন্তু প্রকল্প আলোর মুখ দেখে না। আমাদের নিয়োগের তিন বছর হলো। এ বছরের ডিসেম্বরে মেয়াদ শেষ। এতদিন বসে থাকার টাকা তো সরকার দেবে না। লুটপাটের কারণে যথাযথ উন্নয়ন হচ্ছে না। আমাদের দাবি, আমাদের নায্য পাওয়া বুঝিয়ে দেয়া হোক।
বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার ভ্যাক্সিনেটর অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রংপুরের ভ্যাকসিনেটর ফজলুল হক বলেন, আমাদের দাবি পরিষ্কার। সাতটি দাবি নিয়ে আমরা সংগ্রাম করে যাচ্ছি। এগুলো পূরণ করলেই আমরা খুশি। ভ্যাক্সিনেটরদের বেতন-ভাতার আওতাভুক্ত করা; ভ্যাক্সিনেটরদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা; ভ্যাক্সিনেটরদের সারা বাংলাদেশে কাজ চালুকরণ; ভ্যাক্সিনেটরদের ইউনিয়ন পর্যায়ে স্থায়ীকরণ; ভ্যাক্সিনেটরদের নিজস্ব অ্যাকাউন্ডে বেতন প্রদান করা; ভলান্টিয়ার বাদ দিয়ে ইউনিয়ন ভ্যাক্সিনেটর অথবা ফিল্ড ভ্যাক্সিনেটর পদবি; রাজস্ব খাতের সব ভ্যাক্সিন শুধু ভ্যাক্সিনেটরদের দিয়ে করানো।