প্রাথমিক শিক্ষায় সামাজিক নিরাপত্তা ও নারীর ক্ষমতায়ন

রবীন্দ্রনাথ রায়: শিক্ষাই জাতির সার্বিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির চাবিকাঠি, দক্ষ মানব-সম্পদ, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত। প্রাথমিক শিক্ষা জনগণের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার। স্বাধীনতা-পূর্ব শিক্ষাব্যবস্থা ছিল বৈষম্যমূলক, সনাতনধর্মী, গতানুগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত অনেকাংশে অদক্ষ জনবল তৈরির পরিকল্পনা। স্বাধীনতা-পূর্ব শিক্ষাব্যবস্থা জীবনসম্পৃক্ত ছিল না বলেই স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বজনীন ও বাধ্যতামূলক করেন। তিনি নিরক্ষরমুক্ত সোনার বাংলা বিনির্মাণের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। একটি সদ্য স্বাধীন ও যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনৈতির মধ্য দিয়ে জাতির পিতার তত্ত্বাবধানে রচিত বাংলাদেশের সংবিধানে সব শিশুর অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়।

স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রাথমিক শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে ১৯৭৩ সালে ৩৬ হাজার ১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ এবং ১ লাখ ৫৭ হাজার ৭২৪ জন শিক্ষককে সরকারিকরণের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতির সোপান রচনা করেন। তারই ধারাবাহিকতায় প্রাথমিক শিক্ষাকে আরও গতিশীল করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২৬ হাজার ১৯৩টি রেজিস্টার্ড ও কমিউনিটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণসহ প্রধান শিক্ষকের পদকে দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা প্রদান করেন এবং সহকারী শিক্ষকদের বেতনস্কেল এক ধাপ উন্নীতকরণসহ ১ লাখ ৫ হাজার ৬১৬ জন শিক্ষকের চাকরি সরকারিকরণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতির ক্ষেত্রে এটি আরেকটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। বর্তমানে মোট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১ লাখ ৩৩ হাজার ২, যার মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৫৬৬ এবং শিশু কল্যাণ ট্রাস্ট প্রাথমিক বিদ্যালয় ২০৫টি। প্রাক-প্রাথমিকসহ মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২ কোটি ১৫ লাখ ৫১ হাজার ৬৯১ জন, গ্রস ভর্তির হার ১০৪.৯ শতাংশ, নিট ভর্তির হার ৯৭.৮১ শতাংশ, ঝরে পড়ার হার ১৭.২০ শতাংশ এবং প্রাথমিক শিক্ষাচক্র সমাপ্তির হার ৮২.৮০ শতাংশ। বিগত দশকে প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য গ্রস (মৎড়ংং) ও নিট (ঘবঃ) ভর্তির হার বৃদ্ধি এবং ভর্তির ক্ষেত্রে লিঙ্গসমতা অর্জন। সে তুলনায় অনুরূপভাবে ঝরে পড়ার হার কমে প্রাথমিক শিক্ষাচক্র সমাপ্তির হার উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়নি।

ঝরে পড়ার হার কমানো এবং শিশুর মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য ১৯৯৩ সালের অক্টোবর মাসে সরকার শিক্ষার জন্য খাদ্য কর্মসূচি চালু করে। এ কর্মসূচির আওতায় প্রতিটি উপজেলার নির্ধারিত কিছু ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একক পরিবারের জন্য মাসে ১৫ কেজি এবং যৌথ পরিবারের জন্য মাসে ২০ কেজি গম বরাদ্দ পেত। অথবা সমমূল্যে চাল পেত। প্রথম দিকে স্কুল ম্যানেজিং কমিটি-এসএমসি বিতরণকারী কর্তৃপক্ষ ছিল। পরে ডিলারের মাধ্যমে গম/চাল বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়। শিক্ষার জন্য খাদ্য কর্মসূচির প্রকল্পবহির্ভূত ইউনিয়নগুলোর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর জন্য ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে সরকার প্রাথমিক শিক্ষা উপবৃত্তি প্রকল্প চালু করা হয়। সুবিধাভোগী প্রতিটি শিশুর পরিবারকে মাসে ২০ টাকা বৃত্তি দেওয়া হতো। পরবর্তী সময়ে উপবৃত্তির টাকা ২৫ টাকায় উন্নীত করা হয়। ২০০২-২০০৩ অর্থবছরের শুরুতে সরকার শিক্ষার জন্য খাদ্য কর্মসূচি বন্ধ করে মহানগরী ও পৌরসভা এলাকাবহির্ভূত সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি প্রকল্প চালু করে। প্রত্যেক একক সুবিধাভোগী পরিবারকে মাসে ১০০ টাকা এবং যৌথ পরিবারকে মাসে ১২৫ টাকা হারে উপবৃত্তি দেওয়ার ব্যাবস্থা করা হয়। প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো প্রাথমিক বিদ্যালয় গমনোপযোগী সব শিশুর বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত করা, বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি বৃদ্ধি করা এবং ঝরে পড়ার হার রোধ করা। ফলে শিশুশ্রম বন্ধ হবে, ঝরে পড়ার হার কমে প্রাথমিক শিক্ষাচক্র সমাপ্তির হার বৃদ্ধিসহ শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে। প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি প্রকল্পে এসব মহৎ উদ্দেশ্যের জন্য পরিবারগুলো বাস্তবে উপকৃত হচ্ছে, দরিদ্র পিতামাতা তাদের শিশুসন্তানকে জীবিকা অর্জনের জন্য নিয়োজিত না করে বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষার উপবৃত্তি কার্যক্রম প্রাথমিক শিক্ষায় ইতিবাচক ভূমিকা রেখে চলেছে।

প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তার ও মানোন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৯৩ সালে চালুকৃত শিক্ষার জন্য খাদ্যকর্মসূচি এবং ১৯৯৯ সালে চালুকৃত উপবৃত্তি প্রদান প্রকল্প দুটিকে একীভূত করে ২০০২ সালে চালু করে ‘প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি প্রকল্প’। উপবৃত্তি প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়ে) সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা ব্যতিরেকে ৭৮,৭০,১২৯ জন শিক্ষার্থী উপবৃত্তির আওতাভুক্ত ছিল। পরে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাসহ প্রাথমিক স্তরের সব শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি প্রদানের জন্য তৃতীয় পর্যায়ে উপবৃত্তি প্রকল্প গ্রহণ করে এবং সারাদেশে সুবিধাভোগীর সংখ্যা ১ কোটি ৪০ লাখ নির্ধারণ করা হয়। স্বতন্ত্র এবতেদায়ি মাদরাসা শিশু কল্যাণ ট্রাস্ট পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শতভাগ শিক্ষার্থীকেও এ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ ছাড়া প্রাক-প্রাথমিকের শতভাগ শিক্ষার্থী এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চালুকৃত ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির সব শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি প্রদান প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হয়। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির জন্য একক শিক্ষার্থীবিশিষ্ট পরিবার ১৫০ টাকা, দুই শিক্ষার্থী বিশিষ্ট পরিবার ৩০০ টাকা, তিন শিক্ষার্থীবিশিষ্ট পরিবার ৪০০ টাকা, চার শিক্ষার্থীবিশিষ্ট পরিবার ৫০০ টাকা এবং ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ২০০ টাকা করে উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। মুজিববর্ষে শিক্ষা সহায়ক উপকরণ হিসেবে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ১০০০ টাকা দেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে ঝরে পড়া রোধ, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বৃদ্ধি ও সুষম মেধা বিকাশের লক্ষ্যে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীর মাঝে বৃত্তি প্রদান করা হয়। বর্তমানে পঞ্চম শ্রেণির সব শিক্ষার্থীর সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ রয়েছে, যা পূর্বে ছিল না। সমাপনী পরীক্ষার প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের মেধা ও সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে মেধার স্বীকৃতিস্বরূপ কোটা-ভিত্তিক উপজেলা/থানা ওয়ারি, ট্যালেন্টপুল বৃত্তি এবং পৌরসভা ওয়ার্ড/ইউনিয়ন/উপজেলা/থানা ওয়ারি সাধারণ বৃত্তি দেয়া হয়। সমাপনী পরীক্ষার মাধ্যমে ৫৫ হাজার শিক্ষার্থীর মাঝে মেধার ভিত্তিতে বৃত্তি দেওয়া হতো, ২০১৫ সালে এ সংখ্যা বাড়িয়ে ৮২ হাজার ৫০০ করা হয়েছে। এখন মেধা কোটায় (ট্যালেন্টপুল) বৃত্তি পেয়ে থাকে ৩৩ হাজার শিক্ষার্থী, যা আগে ছিল ২২ হাজার। সাধারণ কোটায় পাচ্ছে ৪৯ হাজার ৫০০ জন, যা আগে পেত ৩৩ হাজার শিক্ষার্থী। বৃত্তি প্রাপ্তদের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি বৃত্তির অর্থের পরিমাণও ২০১৫ সাল থেকে বৃদ্ধি করা হয়েছে। আগে ট্যালেন্টপুল বৃত্তিপ্রাপ্তদের মাসে ২০০ টাকা করে দেওয়া হলেও বর্তমানে ৩০০ টাকা এবং সাধারণ বৃত্তিপ্রাপ্তদের মাসে ১৫০ টাকার পরিবর্তে ২২৫ টাকা করে দেওয়া হয়। সন্তানদের উপবৃত্তি অর্থ মায়েরা তাদের মোবাইল অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সরাসরি পেয়ে থাকেন যা নারীর ক্ষমতায়নের বহিঃপ্রকাশ। প্রাথমিক শিক্ষার উপবৃত্তি কার্যক্রম প্রাথমিক শিক্ষায় ইতিবাচক ভূমিকা রেখে চলেছে। এরই ধারাবাহিকতা সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে বিনামূল্যে বই বিতরণ, মিড-ডে মিল চালুকরণ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, অতিরিক্ত শ্রেণি কক্ষ নির্মাণ, ক্লাসরুমে মাল্টিমিডিয়া সংযোজনসহ বিভিন্ন কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে ডিজিটাল বিপ্লব শুরু হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে প্রায় দেড় কোটি মা ঘরে বসেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তাদের সন্তানদের উপবৃত্তির টাকা পাচ্ছেন। ইতঃপূর্বে সনাতন পদ্ধতিতে তারা উপবৃত্তির অর্থ পেতেন ঠিকই, কিন্তু সে আনন্দ খানিকটা ম্লান হয়ে যেত তাদের কষ্ট, বহুদূর হেঁটে এসে টাকা সংগ্রহের বিড়ম্বনায়। ডিজিটাল বাংলাদেশের অংশ হিসেবে একজন মা আজ শুধুই আনন্দিত। আজ তার কোনো কষ্ট নেই, বিড়ম্বনা নেই, সময় নষ্ট নেই। উপবৃত্তির অর্থ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দেয়া সংক্রান্ত সরকারের সিদ্ধান্তের পর দ্রুতগতিতে মোবাইল অ্যাকাউন্ট খোলা এবং চাহিদা সংগ্রহ করে ডেটাবেইস করা হয়েছে। মোবাইল অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া টাকা তারা যেকোনো সময় মোবাইল অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে তুলতে পারছেন। সুবিধাভোগী এসব ছাত্র-ছাত্রীর উপবৃত্তির অর্থ মোবাইল অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে প্রদান করা হচ্ছে, যা বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ ও মায়েদের ক্ষমতায়নের একটি কার্যকর উদ্যোগ।

পিআইডি নিবন্ধ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০