Print Date & Time : 23 June 2025 Monday 11:05 am

প্রান্তিকতার শেষের হলো শুরু

অনাথ শিশুর মতো যার জীবনখানি নিস্তরঙ্গে নিথর হতে পারতো নিযুত জীবনের নিঠুর নিয়তিপাশে তিনি জুগিয়েছেন হৃৎস্পন্দনের খোরাক। দেশের জন্য লড়েছেন। শূন্য জমিনে গড়েছেন ব্যবসায় কাঠামো। জীবনের সব অর্জন লিখে দিয়েছেন মানুষের নামে। তিনিই দেশের সবচেয়ে সফল ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান ‘কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’-এর জনক রণদা প্রসাদ সাহা। নারীশিক্ষা ও চিকিৎসায় নারী-পুরুষ কিংবা ধনী-গরিবের ভেদ ভেঙেছেন। তার জীবনেই রয়েছে সসীমকে ডিঙিয়ে অসীমে শক্তি সঞ্চারের কথামালা। এ জীবন ও কেতন যেন রোমাঞ্চিত হৃদয়েরই উদ্দীপ্ত প্রেরণা।  পর্ব-২৫

মিজানুর রহমান শেলী: পোদ্দার ঘরের সন্তান। নিম্নবর্গীয় বলা চলে না। তবে বাবা ছিলেন এক নিতান্ত পেটি পোদ্দার। যার ‘নুন আনতে পানতা ফুরাতো’। পানতাও জুটত না ক্ষণে ক্ষণে। এই মানুষটি নিম্নবর্গীয় না হলেও, ছিলেন সুবিধাবঞ্চিত অগঠিত বা প্রান্তিক এক মানুষ। কলকাতায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে তিনি আর মিষ্টির দোকানে ফরমায়েশি খাটতে থিতু হলেন না। উত্তাল উত্তেজনায় যৌবনের জোয়ারে হৃদয় রোমন্থনে নামবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন।

রণদা মার্চের শেষ দিকে আর্মহার্স্ট স্ট্রিটে ডা. সর্বাধিকারীর বাসভবনে ভর্তির জন্য উপস্থিত হলেন। কিন্তু সেনাবাহিনীতে ভর্তি হতে গেলে বা যুদ্ধে যেতে হলে অভিভাবকের অনুমতি পত্রের প্রয়োজন হয়। তবে কি রণদা আবার সেই সাহাপাড়া ফিরে যাবেন? বাবা দেবেন্দ্রের কাছ থেকে অনুমতিপত্র আনতে যাবেন? যেখানে গেলে দেখা হবে কোকোন দাসীর সঙ্গে। যার মুখের ওপর চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েই রণদা কলকাতায় এসেছেন, বড় না হয়ে ফিরবেন না বলে। কী করবেন এবার রণদা? না তিনি সাহাপাড়া গেলেন না। বড়দা মদন সাহাও তো তার অভিভাবক হতে পারেন। আবার এখানে তো মামারাও থাকেন। যে মামারা বাসা থেকে বের করে দিয়েছেন, তাদের কাছেই কি রণদা ছুটে যাবেন? প্রার্থনা নিয়ে। না তিনি মামাদের কাছে গেলেন না। বড়দাকে গিয়ে বলেন, আমি যুদ্ধে যাব। নাম লিখিয়ে এসেছি। তুমি অনুমতি দাও। এ কথা শুনে মদন সাহার অন্তরটা যেন আঁতকে উঠলো। কী! তুই যুদ্ধে যাবি? যুদ্ধে গেলে কি কেউ ফেরে! মদনের ভেতরে ভেতরে এমন এক ভয় উথলে উঠল যে, সহসা সে ফিরে গেল তার শৈশব-কৈশোরের সুখ-দুঃখের স্মৃতির সায়রে। ভেসে উঠল মনের পটে মায়ের বদনখানি। ছল ছল জল সজল নিংড়ে কপোলখানি ভিজিয়ে দিল। সেই যে মায়ের আঁচল ছিঁড়ে গেল, বিয়োগ বিধুর জীবনে নেমে এলো সৎ মায়ের অচ্ছুত-অস্পৃশ্য আচরণ। বাবার নিদারুণ শাসন। এসব সুখের দুঃখের বাতাবরণের সঙ্গে গলাগলি-জরাজরি করেও তো বেঁচে আছি! তুই ছাড়া যে আর কেউ আমার আপন বলে নাই রে এ সংসারে। মাকে হারিয়ে বাবাকেও হারিয়েছি। মামার বাসায় আজ চাকরের বেশে: অনুক্ষণ নিদাঘে নিদাঘে নীরবে নিনাদ বাজিয়ে তোলে। রণা যদি সত্যিই যুদ্ধে যায়, কীই বা তার বলার আছে। আনচান করে ওঠে প্রাণের মাঝে। ছোট ভাইটাকে হারালে কিছুই তো আর রইলো না আপন বলে এই জগতে। মদন সাহা সেদিন স্নেহের ডোরে, মায়ার জালে, প্রাণের দিব্যি দিয়েও রণাকে বোঝাতে পারেননি। রণদা যুদ্ধে যাবেনই।

রণদাও তো জীবনের সেই চোরাবালি, অলিগলি, প্রতারণা আর বঞ্ছনার উদাসী বায় ভুলে যাননি। তারো তা কাঁদায়! তিনি শূন্যে হারিয়েছেন নিজেকে। নিজের কাছেই নিজেকে করেছেন আকাক্সক্ষাহীন। তাই আজ আর তার হারানোর ভয় নেই। স্মৃতিতে যা আছে, তা শূন্যে মিলবে যেদিন, সেদিনই তিনি বাঁধ মানবেন। কে আছে, যে দিবে একমুঠো ভাত, একটু ভালোবাসা, একটু মানুষের সম্মান। কেউ নেই। তাই সে যুদ্ধেই যাবে। চলে গেলেন রণদা।
এই দেখায় রণা আর মদনের মাঝে শেষ দেখা হতে পারতো। শেষ হবে বলেই মেনে নিয়েছিলেন সেদিন দুই সহোদর। উদর ছেঁড়ার পরে আজ রক্তের মায়াও ছিঁড়ে গেল দূরে- বহুদূর। বিদায়।

রণদা চলে গেলেন রণদা আর্মহার্স্ট স্ট্রিটে। ডা. সর্বাধিকারীকে গিয়ে বলেন, দুনিয়ায় আমার মা-বাবা কেউ নেই। আমার আবার কিসের অনুমতিপত্র। আমি আমার অভিভাবক। অবশ্য কোনো কোনো কথ্য উপাত্তে পাওয়া যায় তিনি সাহাপাড়া বাবার কাছে এসেছিলেন। অনুমতি নেওয়ার জন্য। কিন্তু এ কথার কোনো সত্যতা মেলেনি। যাহোক, রণদার সেনাবাহিনীতে ভর্তি সম্পন্ন হলো।

ভর্তির পর ১৯১৫ সালের ১ এপ্রিল ‘বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। প্রতিটি সদস্য ১ এপ্রিল আলিপুর সেনানিবাসের ১৬ রাজপুত রেজিমেন্টের সঙ্গে যোগ দিল। প্রশিক্ষণ শুরু হওয়ার পর শুরু হলো বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরের সদস্যদের পুলিশ ভেরিফিকেশন। রণদা পুলিশের ছাড়পত্র পেলেন না। তার অর্থ দাঁড়াল, রণার যুদ্ধে যাওয়া হলো না। অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াই তিনি ভর্তি হলেও এই সংকট মিটবে কীভাবে? কেননা সংকট খুব জোরালো। তিনি তো স্বদেশি আন্দোলনের ব্রিটিশ বিরোধী যুবা। সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার আগে রাজনৈতিক সন্দেহভাজন হিসেবে কিছুদিন হাজতে ছিলেন।

ডা. সর্বাধিকারী ছিলেন খুব আন্তরিক। তিনি ছুটে গেলেন। কীভাবে এই সংকট নিরসন করা যায়। সরাসরি পুলিশ কমিশনার ও তার সহকারীদের সঙ্গে রণদার বিষয়ে যোগাযোগ করলেন। পরে অবশ্য চ‚ড়ান্তভাবে রণদার ছাড়পত্র আদায় করতে ডা. সর্বাধিকারী সক্ষম হলেন। রাজনৈতিক সন্দেহভাজন হিসেবে তিনি কিছুদিন হেফাজতে ছিলেন, এই মর্মে তাকে পুলিশ একটি ছাড়পত্র লিখে দেয়। যেখানে লিখা ছিল, `It is of interest to note that Ranoda was under a cloud-perhaps not undeservedly when he sought admission into the crops. He had actually been in custody for sometime as a political suspect.

রণদা প্রশিক্ষণে যোগ দিলেন। ১৬ রাজপুত তখন বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরের প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিল। প্রথম দিকে তাদের জন্য তিনটি ব্যারাক, রান্নাঘর এবং স্টোর রুম দেওয়া হয়। প্রথম দিনে সৈনিকদের কম্বল, বিছানা, বালিশ ইত্যাদি দেওয়া হলো। রণদাও এগুলো পেলেন। শুরু দিকে ‘বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরে’র সৈনিকদের অন্য ইউনিট থেকে সেলাই করা পোশাক দেওয়া হলো। সেসব ইউনিটের সৈন্যরা বাঙালিদের চেয়ে লম্বায় ছিল বড়। তাই পোশাকের মাপ সাধারণ বাঙালিদের চেয়ে বড় হলো। দেখতেও বেঢপ্পা লাগছিল। রণদা দৈর্ঘ্যে এবং প্রস্থে বেশি একটা লম্বা ছিলেন না। ফলে বিশেষ করে রণদাকে দেখতে একটু বেশিই কিম্ভ‚তকিমাকার লাগত। এভাবেই চললো কিছুদিন। তারপর দর্জি দিয়ে তা মেরামত করে তাকে দেওয়া হলো। পোশাকের মধ্যে ছিল একটি বাঁকানো টুপি, টিউনিক, শার্ট, শর্টস, সটস, বুটি ও পট্টি। পরে অবশ্য রাকানো টুপির বদলে গুর্খা হ্যাট দেওয়া হয়।

প্রশিক্ষণের প্রথম ১৫ দিন স্কোয়াড ড্রিল শেখানো হলো। তারপর পর্যায়ক্রমে সেকশন ড্রিল, স্ট্রেচার ড্রিল ও কোম্পানি ড্রিল শিখলো সবাই। প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলেন ক্যাপ্টেন তারাপোরওয়ালা, হাবিলদার বাঘ সিং ও হাবিলদার খুবি সিং। সার্বক্ষণিকভাবে তারা ‘বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরে’র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এরপর শুরু হলো চিকিৎসা বিষয়ে নানা প্রশিক্ষণ। কর্নেল নট, লেফটেন্যান্ট পি কে গুপ্ত ও অন্য ডাক্তাররা এই প্রশিক্ষণে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে অংশ নিলে অস্ত্র চালানোর প্রাথমিক জ্ঞান কিছু একটা তো থাকতেই হয়। তাই তাদের অস্ত্র পরিচালনার প্রাথমিক জ্ঞান বা প্রশিক্ষণও দেওয়া হলো। এই প্রশিক্ষণ কৌশলই তারা কুটে প্রয়োগ করে। অবসরে তারা খেলাধুলা ও শরীরচর্চাও করতেন। সারাদিন বিভিন্ন শারীরিক কসরত বা ব্যায়াম এবং চিকিৎসাবিষয়ক প্রশিক্ষণের ফলে তাদের অনেকেরই দেহের অতিরিক্ত মেদ কমে যায়। তবে যারা খুব হালকা-পাতলা ছিলেন তাদের ওজন একটু বেড়ে যায়। ওজন হ্রাস-বৃদ্ধিতে সময় লেগেছিল এক মাস। এক মাস পরে ডাক্তার সর্বাধিকারী স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করলেন। দেখলেন যারা দুর্বল ছিলেন তাদের ওজন বেড়েছে। আর যারা অতিরিক্ত মোটা ছিলের, তারা মেদমুক্ত হয়েছেন। রণদা প্রসাদ সাহার এ সময় ওজন কমেছিল পাঁচ সের।

২০ জুন শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠান হয়। এ সময়ের মধ্যে বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরের জন্য একটি ভাসমান হাসপাতাল (ষড়ি ফৎধভঃ যড়ংঢ়রঃধষ নধৎমব) তৈরি করা হয়। এর শয্যা ছিল ১০০টি। এ হাসপাতালটি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কাছ থেকে এক লাখ ৩০ হাজার রুপি দিয়ে কেনা একটি ফ্ল্যাটের ওপর সাজানো হয়। ৮ মে ভাসমান হাসপাতালের নামকরণ করা হয় বেঙ্গলি। লর্ড কারমাইকেল আনুষ্ঠানিকভাবে এর নামকরণ করেন। ভারতীয় ও ব্রিটিশ অতিথিদের উপস্থিতিতে জাঁকজমকভাবে এ অনুষ্ঠান উদযাপিত হয়। এ অনুষ্ঠানে ভারতীয় বাহিনীর সর্বাধিনায়ক লর্ড বিশপ ও মেডিক্যাল সার্ভিসের ডিজিকে অভিনন্দন বাণী পড়ে শোনানো হয়। বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোর গঠনের ইতিহাসও পাঠ করা হয়। অবশেষে বাংলার গভর্নর ভারতের ভাইসরয়কে শুভেচ্ছা বাণী পড়ে শোনান। অনুষ্ঠান শেষে ভাসমান হাসপাতালটি প্রধান অতিথিসহ সব অতিথি ঘুরে দেখেন।

বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরের সদস্যরা রেলযোগে যাত্রা করার আগেই বেঙ্গলি ১১ মে কলকাতা থেকে সমুদ্রপথে মেসোপটেমিয়া বা যুদ্ধক্ষেত্রে যাত্রা করে। বেঙ্গলির ইঞ্জিন না থাকায় তা শিখ নামের আরেক জাহাজ দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। দুর্ভাগ্যবসত ১৭ মে করাচি পৌঁছার আগেই মাদ্রাজের কাছাকাছি বেঙ্গলি ডুবে যায়। সৌভাগ্যবসত সব সৈনিক ও যন্ত্রপাতি জাহাজে না থাকায় তা রক্ষা পায়। এরপরে মে মাসের শেষ দিকে নতুন করে সিদ্ধান্ত হয় যে, বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোর মেসোপটেমিয়ায় স্টেশনারি হসপিটাল তৈরি করবে। ২৬ জুন বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরের ৬৮ জন অফিসার ও অন্যান্য পদবির সৈনিক এবং ৪৬ জন ফলোয়ার্স কলকাতা থেকে রওনা হয়। এ সময় তারা হাওড়া রেলস্টেশন থেকে বোম্বে যায়। ২ জুলাই ‘মাদ্রাজ’ নামের জাহাজে করে যুদ্ধক্ষেত্রে রওনা হয়। ৯ জুলাই বসরা পৌঁছে। ১৫ জুলাই ইরাকের আমারা শহরে পৌঁছায়। এখানে তারা এক গোলাবাড়িতে ক্যাম্প স্থাপন করে। ১৭ জুলাই থেকে আমারায় বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরের সদস্যরা ‘বেঙ্গল স্টেশনারি হসপিটাল’ চালু করে একটি পুরোনো ও পরিত্যক্ত তুর্কি ব্যারাকে। এ হসপিটাল ১৯১৬ সালের ৩১ মে পর্যন্ত চালু থাকে। বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স হসপিটাল প্রাথমিকভাবে ২০০ শয্যার হাসপাতাল হিসেবে তৈরি করা হলেও যুদ্ধের তীব্রতার কারণে শেষ দিকে প্রায় এক হাজার রোগীকে একত্রে হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসাসেবা দিতে হয়।

এই হাসপাতালের কার্যক্রমে মুগ্ধ হয়ে ভারতীয় বাহিনীর প্রধান সেনাপতির পক্ষ থেকে ডিরেক্টর অব মেডিক্যাল সার্ভিসের ডিজি ডা. সর্বাধিকারীকে অভিনন্দন জানান। হাসপাতালের মেয়াদ বৃদ্ধি করেন। তাছাড়া নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘ইন্ডিয়ান জেনারেল হসপিটাল’।

লেখক: গবেষক, শেয়ার বিজ
mshelleyjuÑgmail.com