প্রান্তিক জনগণের স্বাস্থ্যসেবায় কমিউনিটি ক্লিনিক

সানজীদা আমীন: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১০টি বিশেষ উদ্যোগের মধ্যে একটি উদ্যোগ হচ্ছে কমিউনিটি ক্লিনিক। স্বাধীনতার পর থেকে গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য সাফল্যের পেছনে আছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন ও উদ্যোগ। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ দাবি করেন, কমিউনিটি ক্লিনিক বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বিপ্লব ঘটিয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিকের সাফল্যগাথা নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি পুস্তিকার নাম ‘কমিউনিটি ক্লিনিক: হেলথ রেভুলেশন ইন বাংলাদেশ’। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত নিয়ে আলোচনা উঠলেই কমিউনিটি ক্লিনিককে বাদ দিয়ে সে আলোচনা পূর্ণ হয় না। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) এবং ভিশন-২০২১ অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কমিউনিটি ক্লিনিকের অগ্রযাত্রা। এটা সমন্বিত স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ-সংক্রান্ত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় আলোকবর্তিকা। সম্প্রতি দেশের স্বাস্থ্য খাতের অন্যতম আলোচিত বিষয় ‘রিভাইটালাইজেশন অব কমিউনিটি হেলথ কেয়ার ইন বাংলাদেশ’ প্রকল্প বা কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্প।

কমিউনিটি ক্লিনিক নিয়ে ২০১৩ সালের ১২ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ে তিনি তার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধারণা ও চিন্তার সম্প্রসারণ করেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘তাঁর চিন্তা ও পরিকল্পনাগুলো আমি তাঁর কাছ থেকে শুনতাম। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কীভাবে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া যায়, এ নিয়ে তাঁর ভাবনাগুলো তিনি আমাকে বলতেন। পরে ওই চিন্তাগুলোই আমি আরও বিস্তৃত করেছি।’ ২০০০ সালের ২৬ এপ্রিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গোপালগঞ্জর টুঙ্গিপাড়া উপজেলার পাটগাতী ইউনিয়নের গিমাডাঙ্গা গ্রামে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক উদ্বোধন করেন। এর মধ্য দিয়ে দেশে কমিউনিটি ক্লিনিকের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সারাদেশে ১০ হাজার ৭৬৩ কমিউনিটি ক্লিনিকের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছিল। এর মধ্যে চালু হয়েছিল প্রায় চার হাজার। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ক্ষমতায় এসে ক্লিনিকের কাজ বন্ধ করে দেয়। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর কমিউনিটি ক্লিনিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা এনজিওদের দিয়ে চালানোর কথা তখন ভাবা হয়েছিল। ২০০৯ সালের নির্বাচনের পর সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম।

বর্তমানে সারাদেশে ১৩ হাজার ৮৮১টি ক্লিনিক চালু আছে, চালুর অপেক্ষায় আছে আরও ১৪৬টি কমিউনিটি ক্লিনিক। এসব ক্লিনিক থেকে দৈনিক গড়ে ৩০ জন সেবা নেন। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে বিনা মূল্যে প্রায় ৩০ ধরনের ওষুধের পাশাপাশি স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা এবং পুষ্টি-সংক্রান্ত পরামর্শ দেয়া হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সার্বিক প্রজনন স্বাস্থ্য পরিচর্যার আওতায় অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের প্রসবকালীন এবং প্রসবোত্তর সেবা প্রদান করা। এছাড়া সাধারণ জখম, জ্বর, কাটা, পোড়া, হাঁপানি, চর্মরোগ, কৃমি এবং চোখ, দাঁত ও কানের সাধারণ রোগের ক্ষেত্রে লক্ষণভিত্তিক প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করা হয়। সময়মতো প্রতিষেধক টিকা, যেমন যক্ষ্মা ডিফথেরিয়া, হুপিং কফ, পোলিও, ধনুষ্টংকার, হাম, হেপাটাইটিস-বি, নিউমোনিয়া প্রভৃতিসহ কমিউনিটি ক্লিনিকে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবাও দেয়া হয়। ১৮ থেকে ৪৯ বছর বয়সে সন্তান ধারণক্ষমতাসম্পন্ন মায়েদের সঠিক তালিকা প্রণয়ন, জšে§র ২৮ দিনের মধ্যে শিশুর জš§ নিবন্ধন, এক থেকে পাঁচ বছরের শিশুদের ছয় মাস পরপর প্রয়োজনীয় ভিটামিন খাওয়ানো এবং রাতকানা রোগে আক্রান্ত শিশুদের খুঁজে বের করে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডাররা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা গ্রহণকারীদের জটিল কেসগুলোকে প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান পূর্বক দ্রুত উচ্চতর পর্যায়ে রেফার করে।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে গ্রামের মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে প্রতি ছয় হাজার মানুষের জন্য একটি কমিউনিটি ক্লিনিক গড়ে তোলা হয়েছে। এখান থেকে প্রায় ৮০ ভাগ এলাকাবাসী সেবা নেয় আর গড়ে প্রতিদিন সেবা নেয়া মানুষের সংখ্যা ৩৫। ক্লিনিকগুলো বাড়ির কাছাকাছি হওয়ায় এবং সেখানে বিনা মূল্যে সাধারণ রোগের ওষুধ পাওয়া যায় বলে দিন দিন সেবাগ্রহীতার সংখ্যা বাড়ছে।

প্রতিটি ক্লিনিকে তিন সেবাকর্মী আছেন। সিএইচসিপির সপ্তাহে ছয় দিন ক্লিনিকে থাকার কথা। শুক্রবার ব্যতীত সপ্তাহের ছয় দিন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার কমিউনিটি ক্লিনিকে উপস্থিত থেকে সেবা প্রদান করেন। অফিস সময় সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত। কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার স্বাস্থ্য সহকারীদের তদারকি করেন। প্রশাসনিক কর্ম এলাকায় (প্রতিটি ইউনিয়নের ৯টি) ওয়ার্ডভিত্তিক মাঠকর্মীদের পদায়ন করা হয়। কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবাগ্রহীতার সংখ্যা বৃদ্ধি করার জন্য স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবারকল্যাণ সহকারী বাড়ি পরিদর্শনকালে আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগের মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবাগুলোর তথ্য প্রদানের জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করে থাকেন। যেসব গর্ভবতী মহিলা কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে প্রসবপূর্ব সেবা গ্রহণ করেননি, স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবার কল্যাণ সহকারীরা তাদের খুঁজে বের করে কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবা ব্যবস্থায় নিয়ে আসেন। এছাড়া প্রতিটি ক্লিনিকে শিশু ও মায়েদের টিকাদানের ব্যবস্থা আছে। ক্লিনিকে যেসব নারী-পুরুষ ইপিআই, যক্ষ্মা, কুষ্ঠ প্রভৃতি বিষয়ে কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে সেবা গ্রহণ করেননি, তাদেরও এই সেবা ব্যবস্থায় নিয়ে আসা হয়। কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম সফল, শক্তিশালী ও ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র রেফারেল সেন্ট্রাল হিসেবে ব্যবহƒত হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোয় একদিকে রোগীর ভিড় বেড়ে গেছে, বেড়েছে আস্থা। গ্রামীণ জণগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে কাজ করে যাওয়া এসব কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোয় রয়েছে বেশ কিছু সমস্যা। এসব সমস্যা সমাধান করে বর্তমান সরকার আধুনিক মানের একটি ক্লিনিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কাজ করে যাচ্ছে, যা বাস্তবায়িত হলে জনগণ আরও ফলপ্রসূ সেবা পাবে।

কমিউনিটি ক্লিনিককে কেন্দ্র করে নমুনা কার্যক্রম শুরু করেছে সরকার। প্রতিটি ক্লিনিকসংলগ্ন ২৫০ থেকে ৩০০ পরিবারের জন্য একজন করে মাল্টিপারপাস হেলথ ভলান্টিয়ার মনোনয়ন দেয়া হচ্ছে। মডেল হিসেবে কমিউনিটি ক্লিনিক বিশ্বের সুনাম কুড়িয়েছে, তবে উদ্দেশ্য পুরোপুরি পূরণ হয়নি। দেশের গ্রামীণ জনপদে যেকোনো প্রান্তে কিছু পথ যেতে না যেতেই চোখে পড়ে একেকটি কমিউনিটি ক্লিনিক। প্রায় একই নকশায় তৈরি ছোটো ভবনে ক্লিনিক ব্যবস্থাপনা দিনে দিনে মানুষের কাছে অপরিহার্য ভরসা হয়ে উঠেছে। অন্তত মাতৃস্বাস্থ্য, শিশুস্বাস্থ্য ও সাধারণ অসুখ-বিসুখে দোরগোড়ায় সহজেই প্রাথমিক সেবাটুকু পাওয়া যায় কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে। প্রথমে সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রকল্পটির পরিচালনা করা হলেও ২০১৮ সালের নতুন আইনের মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিক এখন চলছে কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের আওতায়।

স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সভা-সেমিনারে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কমিউনিটি ক্লিনিকের সাফল্য তুলে ধরা হয়। সরকারের পৃথক দুটি জরিপে কমিউনিটি ক্লিনিক নিয়ে ৮০ থেকে ৯৮ শতাংশ মানুষ সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক মার্গারেট চ্যান বাংলাদেশ সফরে এসে কমিউনিটি ক্লিনিকের উদ্যোগকে বিপ্লবী হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।

বিভিন্ন ত্রুটিবিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও একটি জায়গা থেকে মানুষ স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা ও পুষ্টিসেবা পাচ্ছে, এটা একটা বিরাট ব্যাপার। কমিউনিটি ক্লিনিক তৃণমূল মানুষকে শুধু স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে না, স্বাস্থ্যসেবা-সংবলিত যে সচেতনতা সৃষ্টি করছে, সেটা সার্বিক স্বাস্থ্য সূচকে ইতিবাচক ফল নিয়ে এসেছে। বিনা মূল্যে সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা বা ৩০ ধরনের ওষুধ পাওয়া গ্রামের মানুষের জন্য কম পাওয়া নয়। গ্রামের মানুষদের নিয়ে গঠিত কমিউনিটি ক্লিনিক। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনায় গ্রাম পর্যায়ে স্থানীয় জনসাধারণের অংশগ্রহণের ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে একটি মডেল, সাফল্যের দৃষ্টান্ত। সিংহভাগ কমিউনিটি ক্লিনিক স্থানীয় কোনো ব্যক্তির জমিতে গড়ে উঠেছে। এর পরিচালনায় স্থানীয় মানুষ ও জনপ্রতিনিধিরা সম্পৃক্ত। সরকারি বেতনভুক্ত যে তিনজন স্বাস্থ্যকর্মী এখানে সেবা দেন, তাদের অধিকাংশ সংশ্লিষ্ট এলাকার। তাই কমিউনিটি ক্লিনিকের সাধারণ মানুষ নিজেদের প্রতিষ্ঠান বলে মনে করেন। সাধারণ অসুখে আগে যারা চিকিৎসকের কাছে যেতেন না, এখন তারা কমিউনিটি ক্লিনিকে আসেন। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোয় দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকজনকে দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকতে হবে, যাতে গ্রামের অবহেলিত মানুষ ক্লিনিকে সেবার জন্য এসে ফিরে না যান। তাহলে সরকারের কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবার কাজ সার্থক ও সফল হবে।

পিআইডি নিবন্ধন

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০