নিজস্ব প্রতিবেদক: করোনার অভিঘাত এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি বাংলাদেশ। করোনার কারণে অনেকের আয়-রোজগার হ্রাস পেয়েছে। ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। কাজেই মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যাতে বৃদ্ধি পায় এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর হাতে যাতে অর্থের প্রবাহ বাড়ে, সে বিষয়টি বিবেচনায় রেখে আগামী ২০২২-২৩ সালের বাজেট দিতে হবে। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো, বিভিন্ন ধরনের খাদ্যপণ্য ও সারে ভর্তুকি চলমান রাখা এবং ভর্তুকি পণ্য পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তিরা তাদের প্রাপ্য পণ্য পাচ্ছেন কি না, তা পরিবীক্ষণের তাগিদ দিয়েছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
আসন্ন ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য এক বাজেট প্রস্তাবনায় সংগঠনটি এসব প্রস্তাব তুলে ধরে। এ উপলক্ষে গতকাল সংগঠনটির ধানমণ্ডি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। উপস্থিত ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খানসহ অন্য গবেষকরা।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় ফাহমিদা খাতুন বলেন, আগামী অর্থবছরের বাজেট আসছে এমন সময়ে আসছে যখন নিত্যপণ্যের মূল্য বাড়ছে, বহিঃখাত চাপে রয়েছে এবং বিদেশি উৎস থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বাড়ছে। তাই এ রকম পরিস্থিতিতে রাজস্ব সংগ্রহ নির্দিষ্ট পদ্ধতির মধ্যে না রেখে বাস্তবসম্মত হওয়া উচিত। এবারের বাজেট হওয়া উচিত সাধারণ মানুষের কথা ভেবে, তাদের আয় বৃদ্ধিতে সহায়তার বাজেট। তিনি বলেন, বাজেটে সরকারকে এমন সব উদ্যোগ দরকার যাতে মানুষের কাজের সুযোগ বাড়ে এবং কৃষি উৎপাদন খরচ কম হয়। এ জন্য তিনি সার ও জ্বালানিতে ভর্তুকি ও শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় কঠোর হওয়ার সুপারিশ করেন।
এছাড়া ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকা করা এবং দ্বিতীয় ধাপের আওতা কমপক্ষে তিন লাখ টাকা নির্ধারণ, কর আহরণ প্রক্রিয়াকে ডিজিটালকরণ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সক্ষমতা বাড়ানো, সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দ থেকে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের জন্য প্রদেয় পেনশন ও অন্যান্য বরাদ্দগুলো পৃথককরণ, সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় বিতরণ করা সব ধরনের ভাতা কমপক্ষে মাসিক এক হাজার টাকা করার প্রস্তাব দেন ফাহমিদা খাতুন।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘অনেক পণ্য আছে যেগুলোর ব্যবহার স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। সেগুলোর কর বাড়াতে হবে। বিশেষ করে সিগারেট। সিগারেটের ক্ষেত্রে সারচার্জ ৫ শতাংশ করা, প্রতিটি শলাকার বিপরীতে অ্যাডভেলোরেম পদ্ধতির পরিবর্তে সুনির্দিষ্ট করারোপ ও করপোরেট কর হার ৫০ শতাংশ করার প্রস্তাব দেন তিনি।’
তিনি বলেন, ‘কোমল পানীয়ও স্বাস্থ্যের কোনো উপকার আসে না বরং ক্ষতি করে। ফলে এই খাতে কর বাড়ানো উচিত। অন্যদিকে স্যানিটারি ন্যাপকিনের কর কমিয়ে আনতে হবে।’
বর্তমানে বহিঃখাত চাপে আছে উল্লেখ করে মুদ্রার বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা রাখার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংখকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দেয় সিপিডি। এছাড়া শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিমা চালু করা, রাষ্ট্রায়ত্ত লোকসানি প্রতিষ্ঠান ইপিজেড অথবা অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর এবং বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন করা, এ খাতে অপ্রয়োজনীয় খরচ কমানো এবং জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তন নবায়নযোগ্য জ্বালানি উদ্বুদ্ধকরণের সুপারিশও করে সংগঠনটি।
এ সময় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এবারের বাজেট যেহেতু নির্বাচনের আগে তাই আমি মনে করি সরকারকে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার (জিরো টলারেন্স) ঘোষণা করতে হবে। তাহলে একদিকে সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়বে অন্যদিকে টাকাও আদায় হবে। তিনি আরও বলেন, ব্যতিক্রম সময়ের এই বাজেটে আমাদের উদ্ভাবনী পদক্ষেপ নিতে হবে। কীভাবে নি¤œ আয়ের ও দরিদ্র মানুষকে স্বস্তি দেয়া যায় সে জন্য বাজেটে পদক্ষেপ থাকতে হবে। আর তা করতে গিয়ে যদি বাজেট ঘাটতি বাড়ে সেটা মেনে নিতে হবে। এ সময় তিনি বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে টাকা পাচার রোধে সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তৎপরতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন।
সাংবাদিকদের আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, শ্রীলংকার সঙ্গে তুলনা করার মতো আমাদের পরিস্থিতি হয়নি। তবে তাদের কাছ থেকে আমাদের শিক্ষণীয় অনেক কিছু আছে। এখন আমাদের মেগা প্রকল্প নেয়ার ব্যাপারে সাবধান হতে হবে। প্রকল্পগুলো সময়মতো সুশাসনের সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে হবে। এই জায়গাটায় শ্রীলঙ্কা ব্যর্থ হয়েছিল।’
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সরকারের ঋণ ও দায়, বাজার ব্যবস্থা, সুশাসন, প্রতিষ্ঠান সংস্কার এবং রাজস্ব আহরণে কাঠামোগত সংস্কারের বিষয়ে নজর দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, আগামী নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও দীর্ঘস্থায়ী প্রবৃদ্ধি, সামাজিক কল্যাণ বিষয়ে রাজনৈতিক দলের অঙ্গীকার থাকা প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচনের বছর এসে যেন সরকার কর ও ঋণখেলাপিদের কোনো ধরনের সুবিধা না দেয়। এটা দেয়া হলে সমস্যা আরও বাড়বে। ’
এ সময় সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, নির্বাচনের আগে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে কিছু প্রকল্প নেয়া হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। এ ধরনের প্রকল্প নেয়ার ক্ষেত্রে এখন সতর্ক থাকা দরকার। এ সময়ে এসে বাংলাদেশের অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নেয়া ঠিক হবে না।