সাইশা সুলতানা সাদিয়া: প্রতিদিন যেটা প্রয়োজন সেটা শত্রু হয় কীভাবে! আমাদের রোজকার জীবনে প্রত্যেকটি কাজের জন্য ব্যবহƒত বেশিরভাগ তৈজসপত্র প্লাস্টিকের, অথবা কোনোটি আবার পুরোপুরি প্লাস্টিকের। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত ফ্যান বা এসিতেও মিশ্রিত থাকে প্লাস্টিক। আমাদের ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক প্রতিনিয়ত আমাদের এটি ব্যবহার করে যেতে হচ্ছে।
ব্যবহারের কথা আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। ঘরে বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিকের ব্যাগ, প্যাকেট, বালতি, বোতল, কাপ, গ্লাস, মগ, টুথপেষ্ট, টুথব্রাশ, জিনিসপত্র রাখার বিভিন্ন আকর্ষণীয় কেস ও কলম থেকে শুরু করে নিত্য ব্যবহƒত বিভিন্ন প্লাস্টিক পণ্যের সঙ্গে বাস করছি আমরা। এমনকি জীবনরক্ষাকারী ওষুধ পর্যন্ত প্লাস্টিকে মোড়ানো থাকে। একপ্রকারে বলা যায়, আমরা প্লাস্টিকের মধ্যেই ডুবে আছি।
পানির ট্যাঙ্কসহ প্লাস্টিকের দরজা, চেয়ার, টেবিল, ওয়ারড্রব ও ঘর সাজাতে বিভিন্ন আসবাবপত্র তৈরি করা হচ্ছে প্লাস্টিক দিয়ে। দামে সস্তা, ওজনে হালকা, মজবুত, সহজে স্থানান্তরযোগ্য, রং অটুট থাকা, পানি সংবেদনশীলতা এবং সর্বোপরি মেশিনে যেমন খুশি তেমন আকর্ষণীয় ডিজাইনে তৈরি করা যায় বলে বর্তমানে এর ব্যবহার বহুমুখী হয়ে পড়েছে। এসব নানা ধরনের কারণে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দিনকে দিন তৈরি করা হচ্ছে আরও নতুন নতুন ডিজাইনের প্লাস্টিক পণ্য।
অনেক বিশেষজ্ঞ তো এ কারণে প্লাস্টিকের অর্থই করেছেন‘যা স্বচ্ছন্দে আকার দেয়া যায়।’ ইংরেজি অভিধানেও প্লাস্টিকের অর্থ এসেছে ‘আকার-আকৃতি গঠনক্ষম গঠনমূলক শিল্প’ হিসেবে। অর্থাৎ ইচ্ছা অনুযায়ী যেটাকে তৈরি করে ব্যবহার করা যায়। সংজ্ঞার্থে বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্লাস্টিক এমন বস্তু যা কোনো সিন্থেটিক বা আধা সিন্থেটিক দ্বারা তৈরি, যাকে নমনীয়তার জন্য গলিয়ে শক্ত জিনিসের মধ্যে ঢালা যায়।
১৮৫০ সালে পৃথিবীতে প্রথমবারের মতো এটি নিয়ে আসেন আলেকজান্ডার পার্কস প্রাকৃতিক রাবার থেকে প্লাস্টিক তৈরির মাধ্যমে। পরে ১৮৬৯ সালে জন ওয়েসলে হায়াত কৃত্রিম পলিমার ও সেলুলয়েড-জাতীয় প্লাস্টিক আবিষ্কার করেন। ঠিক এক বছর পরে আবার ১৯৭০ সালে সম্পূর্ণ কৃত্রিম প্লাস্টিক আবিষ্কার করেন লিও বেকেল্যান্ড।
মানুষের জীবনকে সহজ ও গতিময় করার নিমিত্তে আবিষ্কৃত এ প্লাস্টিক বিজ্ঞানের আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ, সে নিয়ে বহু তর্ক-বিতর্ক থাকলেও এটি যে অপচনশীল রাসায়নিক দ্রব্য, যা পরিবেশের সঙ্গে মেশে না এবং ক্ষতির পরিমাণই বেশি, তা নিয়ে সবাই একমত।
বর্তমানে প্রধান বৈশ্বিক সমস্যাগুলোর মধ্যে জলবায়ু ও পরিবেশগত সমস্যা অন্যতম। এ সমস্যার পেছনে যতটা না প্রাকৃতিক কারণ দায়ী, তার চেয়ে অনেক বেশি দায়ী মানুষের কাজকর্ম। প্লাস্টিকের ব্যবহারও ঠিক সেরকম একটি ক্ষেত্র। পৃথিবীতে বিদ্যমান কমপক্ষে তিন লাখ ৫০ হাজার কৃত্রিম রাসায়নিকের মধ্যে ১০ হাজারের বেশি রাসায়নিক ধারণ করে প্লাস্টিক। বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর প্রায় ২৭৫ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়। সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রাত্যাহিক জীবনে আমরা প্রতি মিনিটে তরল পদার্থের সঙ্গে ১০ লাখ প্লাস্টিকের বোতল কিনি, ৫০ শতাংশ দ্রব্য একবার ব্যবহার করে ফেলে দিই। প্রতি বছর প্রায় ৫০ হাজার কোটি প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার করা হয় এবং প্রায় ৮০ লাখ টনের মতো প্লাস্টিক বর্জ্য নদী-নালা ও সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হয়। অন্য আরেকটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি মিনিটে সাগরে পতিত প্লাস্টিক বোতল ও ব্যাগের সংখ্যা ৩৩ হাজার ৮০০টি। এভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ সালে সমুদ্রে মাছের চেয়ে প্লাস্টিকের পরিমাণ বেশি থাকবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাছাড়া প্লাস্টিক উৎপাদনে যে তেলের প্রয়োজন হয়, সেই তেল থেকে প্রতি কেজি প্লাস্টিক উৎপাদনে দু-তিন কেজি কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়। আর এই কার্বন ডাই-অক্সাইড বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু ও পরিবেশের দূষণের জন্য কতটা দায়ী, তা আমরা সবাই অবগত আছি।
দৈনন্দিন জীবনে আমরা মাছ, মাংস ও তরকারি কিনে এনে ফ্রিজে সংরক্ষণ করে রাখি, ফ্রিজে থাকা সাইরিন গ্যাস আমাদের সঙ্গে ও নিঃশ্বাসের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করে বিভিন্ন জটিল রোগের সৃষ্টি করছে। তাছাড়া সমুদ্রে নিক্ষেপিত প্লাস্টিকে যখন সূর্যের আলো পড়ে, তখন সে প্লাস্টিকটি মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়ে মাছের মাধ্যমে মানবশরীরে প্রবেশ করে। ২০১০ সালে সিটল সমুদ্রসৈকতে প্লাস্টিকভর্তি মৃত নীল তিমি পাওয়ার ঘটনা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। অস্ট্রেলিয়ার নিউ ক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা অনুযায়ী, বছরে ৯ আউন্স ওজনের এক লাখ ২০ হাজার প্লাস্টিককণা মানুষ অনবরত খাচ্ছে। ২০২২ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণা ‘এনভারমেন্ট ইন্টারন্যাশনাল’-এ পরীক্ষা করা ৮০ শতাংশ মানুষের রক্তে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে এবং এ ধরনের মাইক্রোপ্লাস্টিক মানুষের অঙ্গে এমবেড হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাছাড়া সম্প্রতি শুধু প্লাস্টিক দ্বারা সৃষ্ট নতুন একটি রোগ সামুদ্রিক পাখির মধ্যে আবিষ্কৃত হয়েছে। এই রোগে আক্রান্ত পাখিকে প্লাস্টিক বর্জ্য খাওয়ার ফলে পরিপাকতন্ত্রে প্রদাহ সৃষ্টি করে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমাগত প্রদাহের কারণে টিসুগুলো বিকৃত হয়ে পাখিগুলোর বৃদ্ধি ও বেঁচে থাকাকে প্রভাবিত করে।
বর্তমানে বাংলাদেশে মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহার সাড়ে ১৭ কেজি, যা ২০১৪ সালে ছিল পাঁচ কেজি। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে দিন দিন ব্যবহারের মাত্রা কীভাবে বেড়ে চলেছে। গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরের ৮০ শতাংশ জলাবদ্ধতার কারণ প্লাস্টিক অব্যবস্থাপনা। জলাবদ্ধতার কারণে প্রতিনিয়ত চলাচল করতে আমরা যে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি, তা কারওই দৃষ্টির অগোচরে নয়। তবে আশার বিষয় এই যে, বাংলাদেশেও অন্যান্য দেশের মতো প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। কিন্তু ঘোষণা করা সত্ত্বেও মানুষ কতটা মেনে চলছে তা প্রতিনিয়ত প্রশ্নবিদ্ধ। আদৌ কি প্লাস্টিকের ব্যবহার বর্জন করতে পারছি? মানুষ, প্রাণী, পাখি সর্বোপরি গোটা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এ প্লাস্টিকের প্রয়োজনকে কি আমরা এড়াতে পারছি?
প্রতিকার হিসেবে পুনর্ব্যবহার, উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ ও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগে বিভিন্ন কিছু করা গেলেও ব্যক্তিসচেতনতা সর্বোচ্চ প্রাধান্য না পেলে কখনোই আমরা মুক্তি পাব না। প্রত্যেক ব্যক্তি থেকে শুরু করতে হবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা। পানিতে নিক্ষেপ করা প্লাস্টিক বর্জ্যসমূহ তুলে আনার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এরই মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কাজ শুরু করে দিয়েছে। জনমনে প্লাস্টিকের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অবগত করতে হবে; নয়তো আমরা এই শত্রুর থাবা থেকে রেহাই পাব না, রেহাই পাবে না জীবজন্তু ও আমাদের বসবাসের পরিবেশ।
শিক্ষার্থী
ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়