তৈয়ব আলী সরকার: প্রতিদিনের মতো ‘সেতুবন্ধন’-এর সব সদস্য কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে নীলফামারী জেলার গ্রাম-গঞ্জে বেরিয়ে পড়েন। তারা সবাই পাখি পাগল। পাখির প্রতি তাদের ভালোবাসা অপরিসীম।
পাখি সুরক্ষায় সর্বস্তরের মানুষকে সজাগ করার উদ্দেশ্যে তারা বিভিন্ন সেøাগানসমৃদ্ধ লিফলেট বিতরণ করছেন সৈয়দপুরসহ নীলফামারীর বিভিন্ন উপজেলায়। স্কুল, কলেজ, হাট-বাজারে তারা এ কর্মসূচি চালান। দিন দিন বাড়ছে মানুষ, বাড়ছে বসতি, নির্বিচারে কাটা হচ্ছে গাছ। ফলে ধ্বংস হচ্ছে গাছপালা ও বন। কমছে পাখির নিরাপদ আশ্রয়। একই সঙ্গে কমছে নানা প্রজাতির পাখিও। হুমকিতে পড়ছে প্রকৃতির ভারসাম্য। এ অবস্থা উত্তরণের কথা চিন্তা করে তারা সবাই হাতে হাত রেখে পশুপাখি রক্ষার কাজ করছেন।
পাখির নিরাপদ আবাসস্থল তৈরি ও পাখি সুরক্ষায় তারা এসব কর্মকাণ্ড করছেন। ইতিমধ্যে সৈয়দপুর শহরকে পাখি সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন তারা। এজন্য উপজেলার প্রত্যেকটি গাছে মাটির কলস বেঁধে দিয়েছেন। ওইসব কলসে পাখিরা নিরাপদে বসে এবং বংশবিস্তার করছে। এসব কলসে বাসা বেঁধেছে দোয়েল, বুলবুলি, ঘুঘুসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। এসব কলসে পাখিরা দিয়েছে ডিম, ফুটিয়েছে হরেক রকমের ছানা। কোনো কলস হেলে গেলে তারা তা ঠিক করে দেন। এলাকায় পাখি নিধন করতে দেবেন নাÑএমন প্রতিজ্ঞা করেছেন তারা। পাখি শিকারীর বিরুদ্ধেও কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। কেউ পাখি শিকার করছেনÑএমন খবর পাওয়া মাত্রই প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পাখি শিকার রোধ করছেন।
প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় পাখির ভূমিকা অপরিসীম। পাখিরা নানাভাবে উপকার করে থাকে। ফসলের ক্ষতিকর পোকামাকড় বিনাশ করতেও পাখির ভূমিকা রয়েছে। যার ফলে আবাদি ফসলি জমিতে বাম্পার ফলন হয়। এ কারণে ফসল রক্ষায় পাখির প্রয়োজনীয়তা অনেক। এটি বোঝানোর জন্য তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন।
‘এসো পাখির বন্ধু হই, সবুজ ও পৃথিবীকে বাঁচাই’Ñএ সেøাগানকে ধারন করে নীলফামারীর সৈয়দপুরে গড়ে উঠছে ‘সেতুবন্ধন’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। পাখির নিরাপদ আবাসন গড়ে তোলার লক্ষ্যে সংগঠনটি ২০১৩ সাল থেকে উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে কাজ করে যাচ্ছে।
সেতুবন্ধনের সদস্যরা পড়াশোনার খরচ বাঁচিয়ে এসব কলস ক্রয় করে থাকেন। তারা এ পর্যন্ত উপজেলায় ছয় হাজার গাছে কলস বেঁধে দিয়েছেন।
বর্তমানে সংগঠটির সদস্য শতাধিক। শুধু সৈয়দপুরেই নয়, তাদের উদ্যোগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও বাঘা উপজেলা, নীলফামারী সদর উপজেলার বড়ুয়া, দিনাজপুরের খানসামা, রংপুরের তারাগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় গাছে গাছে পাখির বাসার জন্য মাটির কলস লাগানো হয়েছে।
সেতুবন্ধনের কার্যক্রম সর্বস্তরের মানুষের প্রশংসা কুড়িয়েছে। স্থানীয় জনগণও স্বতঃর্স্ফূতভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। সেতুবন্ধনের সভাপতি আলমগীর হোসেনের এ কার্যক্রমে যোগ দিয়েছে রইজ উদ্দিন রকি, নাফিজ, রফিকুল, টুইংকেল, নওশাদ আনছারী, ফাহিম, রনি, কাকন, জুয়েল, মাসুদ রানা, বিপু, সাকিব, রিফাত, আকাশ, জাহাঙ্গীর, আরফি, কুতুবউদ্দিন আলো, বদরুদ্দোজা, জিএম কামরুল হাসান, মাহবুবুল আলম প্রমুখ। সেতুবন্ধনের মাধ্যমে পাখি বাঁচাও, প্রকৃতি বাঁচাও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
পাখির আবাসস্থল সংরক্ষণের জন্য পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের বন অধিদফতরের ‘পাখি সংরক্ষণ সম্মাননা-২০১৬’ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন সেতুবন্ধনের সভাপতি আলমগীর হোসেন।
সেতুবন্ধনের উদ্যোগে পাখি রক্ষায় গৃহীত কর্মকাণ্ড দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন ‘আলোর পথ সমাজ উন্নয়ন সংস্থা’। সেতুবন্ধনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আলমগীর হোসেন জানান, প্রকৃতিতে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি আজ বিলুপ্তির পথে। এসব পাখি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। পাখি না থাকলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। তাছাড়া কৃষিতে পাখির ভূমিকা অপরিসীম। তারা ক্ষতিকর পোকামাকড় নিধন ও চাষাবাদে বড় ভূমিকা রাখছে।
তিনি বলেন, সংগঠনের সবাই স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া ছাত্র, তাই অনেক কষ্টে আমাদের অর্থ সংগ্রহ করে কাজ করতে হয়।
সৈয়দপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ হোমায়রা মণ্ডল বলেন, এটি খুব ভালো ও ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। সবার সহযোগিতায় পরিবেশ ও ফসল উৎপাদনে এ উদ্যোগ অদূর ভবিষ্যতে সুফল বয়ে আনবে।
সৈয়দপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু ছালেহ মো. মুসা জঙ্গী জানান, সেতুবন্ধনের মাধ্যমে পাখির আবাস তৈরির পাশাপাশি শিকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে সবার নজরে এসেছে সেতুবন্ধন। ফলে কেউ আর পাখি শিকার করছেন না। পাখি শিকার বন্ধসহ পরিবেশবান্ধব বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডেও অংশগ্রহণ করছে তারা।
আশা করছি, ভবিষ্যতে তারা দেশব্যাপী পাখি রক্ষার্থে এসব কার্যক্রম ছড়িয়ে দেবে। যার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ হবে পাখির নিরাপদ অভয়ারণ্য।
রাজশাহী বিভাগীয় বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বন কর্মকর্তা ইমরান আহমেদ বলেন, পাখি দেশের সম্পদ। অনুকূল আবহাওয়া এবং মানুষের সচেতনতার কারণে পাখি দিন দিন বাড়ছে। কৃষিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার এখন অনেক কমিয়ে আনা হয়েছে; বিপরীতে অর্গানিক সারের ব্যবহার বেড়েছে। পোকামাকড়মুক্ত রাখতে কীটনাশক না দিয়ে এখন অনেক জায়গায় গাছের ডালপালা, বাঁশের কঞ্চিতে পাখি বসার জায়গা করে দিচ্ছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। পাখিরা পোকা খেয়ে ফসল ভালো রাখছে। ফলে ফসল বাড়ছে। সেতুবন্ধন পাখি সুরক্ষায় সংগ্রাম করছে প্রকৃতির জন্য এটি ভালো কাজ।
নীলফামারী
Add Comment