ফটিকছড়িতে অবৈধ বালি উত্তোলন

ওবাইদুল আকবর রুবেল, ফটিকছড়ি (চট্টগ্রাম) : চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে কিছুতেই থামছে না অবৈধভাবে বালি উত্তোলন। উপজেলার বিভিন্ন নদী, খাল ও জলাশয় থেকে শক্তিশালী ড্রেজার দিয়ে দিনরাত বালি উত্তোলন করছে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। ফলে এক দিকে যেমন পার্শ্ববর্তী রাস্তা ও জমিতে ভাঙনের সৃষ্টি হচ্ছে। ইজারা-বহির্ভূত যত্রতত্র স্থান থেকে অবাধে বালি উত্তোলনের ফলে বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। তেমনি ড্রেজার মেশিনের বিকট শব্দে স্থানীয় পরিবেশ-প্রতিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো।

সর্বশেষ গত ৭ নভেম্বর অবৈধভাবে বালি উত্তোলনের খবরে উপজেলার পাইন্দং ইউনিয়নের জুগিনাঘাটা এলাকায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে উপজেলা প্রশাসন। এ সময় অবৈধভাবে বালি উত্তোলনের কাজে ব্যবহƒত একটি এক্সক্যাভেটর ও একটি ট্রাক্টর জব্দ করা হয়, যা গত ১৪ নভেম্বর জব্দকৃত এক্সক্যাভেটরের মালিক হাজির হয়ে দোষ স্বীকার করায় তাকে বালিমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০ অনুযায়ী ২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

অভিযোগ রয়েছে, বেশিরভাগ এলাকায় স্থানীয় প্রভাবশালী মহল যোগসাজশে এসব বালি উত্তোলন করা হয়। যার কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা অতিষ্ঠ হলেও প্রভাবশালী মহলের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পারছেন না। অন্যদিকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বারবার অভিযানের পরও থামছে না বালি উত্তোলন।

স্থানীয়রা বলছেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) এক জায়গায় বালি তোলা বন্ধ করলে উত্তোলনকারীরা অন্য জায়গায় বালি তোলা শুরু করে। আবার অভিযান চালিয়ে মেশিন বা সরঞ্জামাদি জব্দ করা হলেও, উত্তোলিত বালি বিক্রিতে বাধাগ্রস্ত হতে হয় না এ অসধিু চক্রের। ফলে এক জায়গায় বালি তোলা বন্ধ করতেই তারা অন্য স্থানে তোলা শুরু করে। এসব বালি উত্তোলনকারী সিন্ডিকেট করে বিভিন্ন জায়গা থেকে বালি তোলেন এবং দিন-রাতে ট্রাক, পিকআপসহ বিভিন্ন গাড়িতে করে বিক্রি করে আসছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, অবাধে বালি উত্তোলনের ফলে ওইসব এলাকার রাস্তাঘাট ভেঙে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এক স্থান থেকে দীর্ঘদিন বালি তোলার ফলে বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়ে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।
এদিকে, সম্প্রতি উপজেলা মাসিক আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে অবৈধভাবে বালি উত্তোলনের প্রসঙ্গটি প্রায়ই ওঠে। বৈঠকে এ অপতৎপরতা বন্ধের দাবি জানানো হয়।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত সাত মাসে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ বালি উত্তোলন ও মাটি কাটার বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা ১০টি মামলায় সর্বমোট ১৫ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মো. সাব্বির রাহমান সানি। দিনে বা গভীর রাতে পরিচালিত এসব অভিযানে বালি উত্তোলন বা মাটি কাটার কাজে ব্যবহƒত বেশ কিছু এক্সক্যাভেটর, ড্রেজার মেশিন, ট্রাক্টর, পিকআপভ্যান জব্দ করা হয়। জব্দকৃত প্রায় সব সরঞ্জাম জরিমানা আদায় সাপেক্ষে অবমুক্ত করা হলেও এখনও একটি এক্সক্যাভেটর, একটি ট্রাক্টর ও কিছু ড্রেজার মেশিন রয়েছে জানা গেছে ।

সরেজমিন উপজেলার বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শনে জানা যায়, ড্রেজার ও বালি পরিবহনে ব্যবহƒত ড্রামট্রাক ও ট্রাক্টরের বিকট শব্দে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ। যত্রতত্র বালি উত্তোলন জনজীবনে দুর্ভোগ নেমে এসেছে। ফলে গ্রামীণ রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, সেতু-কার্লভাট, নষ্ট হয়ে ক্রমান্বয়ে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে ধুলাবালির স্তূপ এলাকার বায়ুদূষণসহ সার্বিক পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলার পাইন্দং ইউনিয়নের জুগিনাঘাটা, বেড়াজালী এলাকার চম্পাপাড়া, শ্বেতকুয়া এলাকার গজ্জেম্মে টিলা এলাকা, কাঞ্চন নগর ইউনিয়নের চেঙ্গেরকুল, ফরেস্টর অফিস, পাল্লান পাড়া ও চুরখাঁহাট এলাকা, ফটিকছড়ি পৌরসভার ১নং ওয়ার্ড উত্তর রাঙ্গামাটিয়া এলাকা, পূর্ব সুয়াবিল হালদাপাড়, ভূজপুর ইউনিয়নের হরিণাকুল, নারায়ণহাট ইউনিয়নের জুজখোলা ও দাঁতমারা, ধর্মপুর, খিরাম ইউনিয়নের যথাক্রমে ধুরুং, হালদা ও সর্তাখালসহ বিভিন্ন নদী-খাল থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে ট্রাক ও ড্রামট্রাকসহ ছোট-বড় গাড়িতে করে নিয়ে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করে আসছে একটি শক্তিশালী বালি ও মাটি সিন্ডিকেট।

জানতে চাইলে হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ও বিভাগীয় প্রধান ড. মো. শফিকুল ইসলাম জানান, নদী থেকে অতিরিক্ত বালি উত্তোলনের ফলে নদীর স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ কমে যায়। ফলে নদীর ক্ষয় বেড়ে গিয়ে নদীর পাড় ভাঙন ত্বরান্বিত করে। এছাড়া অতিরিক্ত বালি উত্তোলনের ফলে নদীর তলদেশের বাস্তুতন্ত্র পরিবর্তন হয়ে যাবে। যার প্রভাবে তলদেশে বসবাসকারী উদ্ভিদ ও প্রাণিগোষ্ঠীর আবাসস্থল যেমন ধ্বংস হবে তেমনি ধ্বংস হয়ে যাবে এদের খাদ্যের উৎসগুলো। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে মৎস্য সম্পদের প্রজনন প্রক্রিয়ায়। অতিরিক্ত বালু উত্তোলনের ফলে পানিদূষণসহ নদীর গঠন প্রক্রিয়া পরিবর্তন হয়ে যাবে এবং কমে যাবে নদী পাড়ের মাটির গুণাগুণ ও কর্মদক্ষতা।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাব্বির রাহমান সানি বলেন, ‘আমি ফটিকছড়িতে যোগদানের পর থেকে অবৈধ বালি উত্তোলন ও মাটি কাটার বিরুদ্ধে একাধিক মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়। পুরো উপজেলাজুড়ে অভিযান চলমান, অভিযোগ পেলে যেকোনো মুহূর্তে অভিযান পরিচালনা করা হবে। পরে এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও আশ্বাস দেন এবং জনস্বার্থে এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানান এ কর্মকর্তা।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০