শাহ বিলিয়া জুলফিকার : মানুষের প্রতিটি কর্মই তার উপাসনা (ইবাদত)। যদি সে আল্লাহ তায়ালার আদেশ, নিষেধ মেনে কর্ম সম্পাদন করে, তবে কোরআনের ভাষ্যমতে তাই হবে ইবাদত। আর যেসব আদেশ-নিষেধ ও পথ নিদের্শ, আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের প্রতি জারি করেছেন তাহলো ‘শরিয়ত’। কোরআন মাজিদের বিধিনিষেধ সম্পর্কিত পাঁচশ আয়াতের ব্যবহার, রাসুল (সা.)-এর ২৩ বছরের নবি জীবনের ক্রিয়াকর্ম, কথাবার্তা ও আদেশ-নিষেধের ওপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে ইসলামি শরিয়ত। আর ইসলামি শরিয়তের সঙ্গে যে শব্দ ওতপ্রোতভাবে জড়িত তাহলো ‘ফতোয়া’।
ফতোয়া শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ ‘ফাতাওয়া’ থেকে। ফতোয়ার অর্থ ধর্মীয় আইন সম্বন্ধীয় মত। ফতোয়া হলো শরিয়ত সম্পর্কিত অনুশাসনগুলোতে যখন কোনো জটিল প্রশ্নের সরাসরি সমাধান পাওয়া যায় না, ধর্মশাস্ত্র অনুযায়ী সেই জটিল প্রশ্নের সমাধানে যে অভিমত দেয়া হয়। তাফসিরকারীগণ বলেন, কোনো ব্যক্তির জিজ্ঞাসার জবাবে দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে শরিয়তের বিধান স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হলো ফতোয়া। সহজ কথায় বলতে গেলে, সমস্যমান কোনো টপিকে শরিয়তের ফয়সালা। মানুষের বুঝার স্বার্থে বিষয়টিকে আরও ক্লিয়াফাই করার কথা ভাবছি। ধরা যাক, রমজান মাসে একজন মানুষ প্রচণ্ড অসুস্থ। রোজা রাখা তার পক্ষে পসিবল না। তাহলে এখন সে কী করবে এ অসুস্থতা নিয়েই রোজা রাখবে নাকি কোনো বিজ্ঞ ডাক্তারের কথা শুনে রোজা পরিত্যাগ করবে এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে যেটির দ্বারস্থ হবে তাহলো ইসলাম শরিয়ত। আর যে ফয়সালাটি পাবে তাই ফতোয়া।
আর এ ফতোয়া সবাই দিতে পারবে না, সক্ষমতা নেই। কেবল মুফতিগণ ফতোয়া দিতে পারবে। ফতোয়া দিতে হলে অবশ্যই ব্যক্তিকে মুসলিম হতে হবে। তারপর ফিকহ, উসুলে ফিকহ, নাসিখ এবং মানসুখ সম্পর্কে অবহিত, হালাল-হারাম, ফরজ, সুন্নাত, ওয়াজিব, নফল, মুবাহ, মাকরুহ তাহরিমি এবং তানজিহি সম্পর্কে জানা, কোরআন, হাদিস সম্পর্কে অবহিত, সকলকে তার দৃষ্টিতে সমান দেখা, সমকালীন বিষয়াদি সম্পর্কে জ্ঞানী, উপযুক্ত মুফতির কাছে থেকে শিক্ষা গ্রহণ ও প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া জরুরি। কেননা, ফতোয়া হলো এমন বিধান ও সমাধান, যা কোনো ঘটনা বা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামি দলিলের আলোকে মুফতি বা ইসলামি আইন বিশেষজ্ঞ প্রদান করেন। যখন কোনো ব্যক্তি সরাসরি কোরআন ও হাদিস কিংবা ফিকাহের আলোকে উদ্ভ‚ত সমস্যার সমাধান বের করতে অপারগ হন, তখন মুফতির কাছে এই বিষয়ে সমাধান চান।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ‘বিয়ে’ এবং ‘তালাক’ সম্পর্কিত ফতোয়া অত্যধিক জনপ্রিয়। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো ‘বিয়ে’ এবং ‘তালাক’ বিষয়ক সে ফতোয়াগুলোয় নারীই থাকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। অশিক্ষাই মূলত নারী সমাজকে নানা রকম ফতোয়া চক্রে আবদ্ধ করে রেখেছে। নারীর আর্থিক নিরাপত্তা এবং স্বাধীন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়। এ কারণেই সমাজের স্বার্থান্ধরা নারীর প্রতি সহিংসতার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ফতোয়াকে। ফতোয়ার নামে নারী নির্যাতন এবং নারীর প্রতি অবমাননার ঘটনা ঘটেই চলে। ফতোয়া প্রদানের ব্যবস্থাটি মুসলিম সমাজে দীর্ঘকাল যাবৎ প্রচলিত থাকলেও ফতোয়াবাজি শব্দটার ব্যবহার খুব সাম্প্রতিককালের। আর ফতোয়াবাজির ব্যাপারটি প্রধানত চলছে দরিদ্র সমাজের নারীর ওপর। অর্থাৎ সমাজের সবচেয়ে অসহায় স্তরের মানুষগুলো ফতোয়ার দ্বারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। কীভাবে চলছে ফতোয়ার এ নির্যাতন, সেটা একটুখানি খতিয়ে দেখলেই কারণগুলো বোধগম্য হবে। বাংলাদেশের নারীসমাজকে দাবিয়ে রেখে হীন রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ, কুপ্রবৃত্তি চরিতার্থ, সামাজিক প্রতিপত্তিকে প্রতিষ্ঠা, উদার ও প্রগতিশীল মূল্যবোধের চর্চা ও তার বিকাশকে দমিত, শোষণমূলক ব্যবস্থাকে টিকানো ও নারী স্বাধীনতা খর্ব করে তাকে ঘরে আবদ্ধ রাখায় ফতোয়াবাজির মুখ্য উদ্দেশ্য। সে পরিকল্পনাও বাস্তবায়িত হচ্ছে। আমরা যদি একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাব গ্রাম থেকে শহরে দেশব্যাপী ফতোয়াবাজির ফলে মানবাধিকার বিপন্ন, ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব, সব সময় আতঙ্কিত, ভবিষ্যৎ গতি স্তিমিত, পেছনের দিকে ফিরা, নারীদের ঘরমুখো থাকা, মুক্তচিন্তার চর্চা ও বিকাশের পরিবর্তে মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণায় আবদ্ধ হওয়ার মতো নানা সমস্যার উদ্ভব হচ্ছে।
তাই ফতোয়াবাজি বন্ধে জনসচেতনতা ও আইনি পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। আদালতের নির্দেশিত আইন মেনে ফতোয়া দেয়া থেকেও বিরত থাকতে হবে ফতোয়াতে অপরিপক্ব আলেমদের। তাদের মূর্খতার দরুন সমাজে নানা সময় অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়ছে ইসলামপ্রেমী সাধারণ মানুষ। তেমনি এক পরিস্থিতি হয়েছিল নওগাঁ জেলার সদর উপজেলার কীর্তিপুর ইউনিয়নে এক দম্পতি। ২০০০ সালের ২ ডিসেম্বর ‘দৈনিক বাংলাবাজার’ পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের পরিপ্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিক সুয়োমোটো রুল উত্থাপিত হয়। নওগাঁ জেলার সদর উপজেলার কীর্তিপুর ইউনিয়ন পরিষদের অধীনে আটিখা গ্রামের ছাইফুলের (গোলাম মোস্তফার পুত্র) স্ত্রী সাহিদাকে তার স্বামীর চাচাতো ভাই শামসুলকে বিয়ে করতে বাধ্য করা হয়। হাজী আজিজুল হক প্রদত্ত তথাকথিত ফতোয়ার ভিত্তিতে, যাতে বলা হয়, প্রায় এক বছর আগে একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তার স্বামী যখন রাগের মাথায় ‘তালাক’ শব্দটি উচ্চারণ করেছিল। পরে তার বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল, কিন্তু তারা দাম্পত্য জীবন অব্যাহত রেখেছিল ।
পরবর্তী সময়ে ২০০১ সালের ১ জানুয়ারি হাইকোর্টের বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী ও নাজমুন আরা সুলতানার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বেঞ্চ ফতোয়াকে অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করেন। রায়ে বলা হয়, একমাত্র আদালতই মুসলিম বা অন্য কোনো আইন অনুযায়ী আইনসংক্রান্ত কোনো প্রশ্নে মতামত দিতে পারেন। কেউ ফতোয়া দিলে তা ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য হবে। ফতোয়াবিরোধী হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীলরা আপিল করেন। দীর্ঘদিন পর বিভিন্ন রিটের রুলের ওপর চ‚ডান্ত শুনানি শেষে ৮ জুলাই, ২০১০ তারিখে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি গোবিন্দচন্দ্র ঠাকুরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বেঞ্চ রায় দেন। রায়ে ফতোয়ার নামে বিচারবহিভর্‚ত কার্যক্রম ও শাস্তিকে অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এ ধরনের শাস্তি ঘোষণাকারীকে অপরাধী হিসেবে গণ্য করতে বলা হয়েছে। দণ্ডবিধিসহ প্রচলিত অন্যান্য আইন অনুযায়ী এই অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের অপরাধের সহযোগী হিসেবে একই ধরনের শাস্তির ব্যবস্থা করার নির্দেশনা দেন আদালত। এই রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীলরা আবারও আপিল করে। পরবর্তীতে প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বে ছয় বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ২০১১ সালের ১২ মে ফতোয়ার ওপর এক যুগান্তকারী রায় প্রদান করেন। ধর্মীয় বিষয়ে ফতোয়া দেয়া যাবে, তবে শাস্তি নয়। রায়ে বলা হয়, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে করা ২টি আপিল সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে আংশিক মঞ্জুর করা হলো। শুধু যথাযথ শিক্ষিত ব্যক্তিরাই ধর্মীয় বিষয়ে ফতোয়া দিতে পারবেন। এটা ব্যক্তির স্বেচ্ছায় গ্রহণের ওপর নির্ভরশীল। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রভাব বা বলপ্রয়োগ করা যাবে না। রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনে ব্যক্তির সাংবিধানিক অধিকার ও মর্যাদা ক্ষুণœ করে এমন কোনো ধরনের ফতোয়া দেয়া যাবে না।
ফতোয়া সম্পর্কিত বদ্ধমূল ধারণা ও অলীক বিশ্বাসের শিকড ছিঁড়ে ফেলে এ বিষয়ে সচেতনতার মাত্রা বাড়ানো, যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য সরবরাহ করে তা বিশ্লেষণ এবং বাস্তবায়নের জন্য সক্ষমতা বিকাশে সহায়তা করা, গ্রামীণ জনগোষ্ঠী তথা নারীশিক্ষা প্রসারে আরও সুদূরপ্রসারী ভ‚মিকা পালন করা, নারীর আর্থিক নিরাপত্তা ও স্বাধীন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, বাংলাদেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলকভাবে মানবাধিকারের সকল বিষয়ে সচেতনতা জোরদার, দেশের আইন, জনস্বার্থ ও জনগণের নৈতিকতার বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে দেশব্যাপী সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো, তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রচারমাধ্যমগুলোর সাহায্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে অনুষ্ঠান প্রচার, দেশের পুলিশ প্রশাসনকে আইন অনুযায়ী বেআইনি ফতোয়ার ঘটনায় দ্রæত কার্যকর ভ‚মিকা পালন ও ফতোয়া সম্পর্কে জনসচেতনতাসহ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যদি পরিবার, সুশীল সমাজ, আইন বিশেষজ্ঞ, প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, নেতৃবৃন্দ, মানবাধিকার ও নারী সংগঠনসমূহকে বেআইনি ফতোয়ার বিরুদ্ধে একযোগে কাজ করে, তবেই সম্ভব হবে নারি-পুরুষের অংশীদারিত্বে গড়ে ওঠা একটি শান্ত, সুন্দর ও বাসযোগ্য পৃথিবী।
শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়