ফলপ্রসূ গবেষণা ও কার্যকর নীতি প্রণয়নে চাই জেন্ডার সমতা

নাভিকা মেহতা:‘নারী ইস্যু’ কথাটির অস্তিত্বই এই সহজ সত্যকে তুলে ধরে যে, আমরা আসলে বাস করি একটি পুরুষতান্ত্রিক জগতে। শত শত বছর ধরে ধরে পুরুষকে কেন্দ্র করে গবেষণা ও নীতি প্রণয়ন করাটা স্বাভাবিক বা ডিফল্টে পরিণত হয়েছে। তাই নারীকেও আমলে নেয়, এমন কোনো পদক্ষেপ নেয়া হলে তাকে ‘নারীকেন্দ্রিক’ ট্যাগ দেয়া হয়। কিন্তু পুরুষকেই যদি ডিফল্ট হিসেবে ধরা হয়, তাহলে নারীর জীবনের কোনো কিছুই আসলে তার জন্য তৈরি বা সামঞ্জস্য করা হলো না। নারীকে বাদ দিয়ে যে গবেষণা করা হয়, তা কেবল ‘জেন্ডার নিরপেক্ষ’ নয়, তা ‘অসম্পূর্ণ’।

এর পরিণতি হতে পারে মারাত্মক। যেমন পুরুষের তুলনায় নারীর গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার আশঙ্কা ৭৩ শতাংশ এবং মারা যাওয়ার আশঙ্কা ১৭ শতাংশ বেশি। এর অন্যতম কারণ হলো গাড়ির নিরাপত্তা পরীক্ষায় ব্যবহƒত ক্রাশ-টেস্টের ডামি পুতুলগুলো একজন গড়পড়তা পুরুষের শরীরের আদলে তৈরি করা হয়েছে। গত বছরের আগে পর্যন্ত নারীর আদলে গড়া ডামি তৈরিই হয়নি। আবার তৈরি হওয়ার পরও যান-নিরাপত্তা গবেষণায় এর ব্যবহার এখনও নিশ্চিত করছেন না নিয়ন্ত্রকেরা।

স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা যে ধরনের ব্যক্তিগত সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম ব্যবহার করে থাকেন, এসবও আসলে পুরুষদের হিসেব ধরেই বানানো হয়। মেয়েদের জন্য কেবল সাইজে একটু ছোট করা হলেও বাদবাকি সব মাত্রা পুরুষের সামঞ্জস্যে রাখা হয়। ব্রিটিশ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের ওপর করা ২০২০ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৪৪.৭ শতাংশ নারী শরীরের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ পিপিই পেয়েছেন, যেখানে পুরুষ কর্মী পেয়েছেন ১৫.৩ শতাংশ। কানাডার সম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ৮০ শতাংশ নারী উত্তরদাতাই পিপিই-বিষয়ক সমস্যার কথা জানিয়েছেন।

একইভাবে পুলিশ অফিসারদের ব্যবহƒত ‘ইউনিসেক্স’ বডি আর্মর বা বর্ম মূলত পুরুষের আদলে ডিজাইন করা হয়েছে। এসব ব্যবহার করা নারী পুলিশ অফিসারদের জন্য অস্বস্তিকর তো বটেই, উপরন্তু এটা তাদের ওপর সম্ভাব্য আক্রমণের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রে ৫০ হাজার নারী পুলিশ হিসেবে কাজ করছেন। অথচ গত বছর পর্যন্ত নির্দিষ্টভাবে নারীদের জন্য বর্ম চালু হয়নি।

চিকিৎসার ওষুধ নিরীক্ষায় অবশ্য এখন আর নারীদের বাদ দেয়া হচ্ছে না। তবে তাদের উপস্থিতি, বিশেষত নিরীক্ষার প্রাথমিক পর্যায়ে এখনও গৌণ রয়ে গেছে। ফলে এখনও ওষুধের প্রতিকূল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকিতে নারীরা বেশি ভুগছেন। এর অন্যতম কারণ হলো, প্রস্তাবিত ডোজ নারীর জন্য সামঞ্জস্য করা হয় না। এক গবেষণা বিশ্লেষণে নারী ও পুরুষকে একই মাত্রার ওষুধের ডোজ দেয়ার পর দেখা গেছে, ৯০ শতাংশেরও বেশি ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের তুলনায় শক্তিশালী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও বেশি ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার হয়েছেন।

‘এমবিয়েন’ নামক ঘুমের ওষুধ গ্রহণ করেন এমন নারীরা পরদিন সকালে তুলনামূলকভাবে বেশি হারে সড়ক দুর্ঘটনায় পড়ার মতো মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হয়েছেন। এই পর্যবেক্ষণ থেকেই উল্লিখিত গবেষণার সূত্রপাত। পরে দেখা গেল, প্রস্তাবিত ডোজ পুরুষদের তুলনায় নারীদের শরীরে বেশি মাত্রায় রক্তের ঘনত্ব তৈরি এবং ‘ড্রাগ-ইলিমিনেশন’ (ওষুধ অপসারণ) সময় বৃদ্ধি করছে। যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন এখন নারীদের ‘স্ট্যান্ডার্ড’ ডোজের অর্ধেক ওষুধ গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছে।

আবার বিশেষভাবে নারীদের আক্রান্ত করে, এমন সব স্বাস্থ্যসমস্যা-বিষয়ক গবেষণায় অর্থায়নই করা হয় না। কেবল একটি লিঙ্গের মানুষকে আক্রান্ত করে এমন রোগ নিয়ে হওয়া গবেষণা করা হলে প্রায় ৭৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, গবেষণার বিষয়বস্তু পুরুষ। ‘পুরুষের রোগ’ বেশি অর্থায়ন পাচ্ছে, যেখানে ‘নারীর রোগ’ অর্থায়ন পাচ্ছে কম।

যৌন সহিংসতা রোধেও নারীদের আদতে যা প্রয়োজন, তা যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছে না। কারণ এসব ব্যাপারে নারীকে মূলত ভিকটিম হিসেবে এত বেশি চাউর করা হচ্ছে যেন যৌন সহিংসতা পুরোপুরি ‘মেয়েদের বিষয়’ এবং এ ব্যাপারে পুরুষদের নিয়ে করার মতো কিছু নেই। অথচ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরুষই মূল অপরাধী। বাইরে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা, হেল্পলাইন স্থাপন ও ‘সেফ স্পেস’ বা নিরাপদ স্থান তৈরি এসব নীতি এতই ভিকটিমকেন্দ্রিক হচ্ছে যে সহিংসতার মূল উৎস অধরাই রয়ে যাচ্ছে।

একইভাবে স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত তথ্যগুলো প্রাথমিকভাবে নেয়া হয়েছে পুরুষের কাছ থেকে। এর ভয়াবহ প্রভাব দেখা দিচ্ছে। কারণ স্বাস্থ্যসেবায় এসব তথ্যের ভিত্তিতে প্রশিক্ষিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ করা হচ্ছে। উদাহরণসরূপ কার্ডিওভাসকুলার রোগকে মোটাদাগে পুরুষদের স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে, এমন তথ্যের ওপর ভিত্তি করে মেডিকেল অ্যাপ তৈরি করা হলো। এবার এতে যদি একজন পুরুষ তার বাঁ বাহুতে ও পিঠে ব্যথার অভিযোগ করে, তাহলে অ্যাপটি তাকে সম্ভাব্য হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসা নেয়ার পরামর্শ দেবে। ওই একই অ্যাপ হয়তো একজন নারীকে বলবে, তিনি ‘ডিপ্রেশন’ বা বিষণ্নতায় ভুগছেন, তাই তার জরুরি সেবা নেয়ার দরকার নেই। ব্যাপারটা এমন যেন নারীদের হার্ট অ্যাটাকে কিছু হয় না।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আরও অনেকভাবে নারীদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। ২০১৫ সালে নারীদের বিরুদ্ধে পক্ষপাত দেখানোর জন্য অ্যামাজন তার এআই-নির্ভর নিয়োগ সফটওয়্যার বাতিল করে দেয়। এর আগের এক দশক ধরে জীবনবৃত্তান্তের প্যাটার্ন অনুযায়ী আবেদনপত্র মূল্যায়ন করতে শেখার পর এ কম্পিউটার মডেল পুরুষ প্রার্থীদের উচ্চ রেটিং দিয়েছে। বলাই বাহুল্য, পুরুষদের কাছ থেকেই সবচেয়ে বেশি আবেদনপত্র জমা পড়েছে। অবাক হওয়ার কিছুই নেই। কারণ এআই গবেষকদের মধ্যে মাত্র ১২ শতাংশ ও সফটওয়্যার ডেভেলপারদের মোটে ছয় শতাংশ নারী। এআই-ভিত্তিক নিয়োগ সফটওয়্যার ব্যবহার করে এমন আরও অনেক কোম্পানি আছে, যেখানে এ ধরনের পক্ষপাতিত্বের পরীক্ষাই করা হয় না।

জেন্ডার সমতা বৃদ্ধি পেলে অর্থনৈতিক অগ্রগতি বেগবান হয়, এমন প্রমাণ যথেষ্টই আছে। তবুও সামষ্টিক দিক নিয়ে কাজ করে এমন বিশ্লেষণে জেন্ডারের ধরণাকে আমলে নেয়া হচ্ছে না। সরকারি ব্যয়, কর ও আর্থিক নীতির প্রভাব নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা হতে পারে। এ ব্যাপারে গুরুত্ব না দিলে অর্থনৈতিক মূল্যায়ন হবে ত্রুটিপূর্ণ। এতে নীতির কার্যকারিতা ও পূর্বপরিকল্পনার যথার্থতা হ্রাস পায়।

যেমন প্রাথমিক পরিচর্যাকারী হিসেবে নারীদের অবৈতনিক শ্রম সামষ্টিক অর্থনীতিতে গণ্যই করা হয় না। রান্না করা, ধোয়া-মোছা, জল আনা এবং শিশু ও বয়স্কদের যত্ন নেয়ার মতো কাজেরও অর্থনৈতিক মূল্য আছে। হিসেব করলে তা জিডিপির অন্তত ১০-১৬ শতাংশ হবে। জেন্ডার ইস্যুতে গুরুত্ব না দিয়ে বিশ্লেষণ করার ফলে নারীরা অতিরিক্ত কাজ করেও কম বেতন পাচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অবৈতনিক শ্রম কমানোর বা ভাগাভাগির জন্যও নীতি প্রণয়ন করতে হবে।

ভারতের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে যে আলোচনা চলছে, তার দিকে খেয়াল করি। সম্প্রতি জনসংখ্যায় চীনকে ছাড়িয়েছে ভারত। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ অনুমান করছেন, দেশটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও চীনকে ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু অশ্বিনী দেশপাণ্ডে ও অক্ষি চাওলা ব্যাখ্যা করেছেন, প্রবৃদ্ধিতে চীনকে ছাড়িয়ে যাওয়া তখনই সম্ভব হবে যখন এ বর্ধিত জনশক্তি কর্মক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে। আর ভারতে কর্মক্ষেত্রে নারী জনশক্তির অংশগ্রহণ কম হওয়ায় এ প্রভাব কমই হবে।

অন্যান্য অনেক নীতিগত ক্ষেত্রেই জেন্ডার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ জলবায়ু পরিবর্তনও এর বাইরে নয়। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য ইস্যুর মতো জলবায়ু-সম্পর্কিত বিপর্যয়সহ বৈশ্বিক উষ্ণতাও পুরুষের চেয়ে নারীর ওপর বেশি প্রভাব ফেলে।

যদি বিশ্বের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে একটি বাড়তি চিন্তার বিষয় হিসেবে ধরা হয়, তবে গবেষণা হবে ভ্রান্ত, নীতি হবে অকার্যকর এবং ব্যর্থ হবে মানবকল্যাণের প্রয়াস। গবেষণা, পণ্যের নকশা, প্রযুক্তি ও নীতিÑ প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীদের স্পষ্টভাবে গুরুত্ব না দিলে এ অবস্থার পরিবর্তন হবে না।

অর্থনীতিবিদ-সম্পাদক, ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিকস অ্যাসোসিয়েশন

প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে ভাষান্তর

শামসুন নাহার

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০