ফল আমদানির ঘোষণায় অর্থ পাচার করে প্রতিষ্ঠান লাপাত্তা

রহমত রহমান: ঘোষণা ছিল ফল আমদানির, আমদানি হয়েছে সিগারেট। এলসি খোলা হয়েছে তিন হাজার ডলারের (প্রায় দুই লাখ ৪০ হাজার টাকা), কিন্তু সিগারেট আমদানি করা হয়েছে প্রায় তিন কোটি টাকার। সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাচার হয়েছে সেই টাকা। নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংক কোনো ঠিকানা যাচাই ছাড়াই খুলেছে হিসাব। আর সেই হিসাব থেকে একে একে চারবার এলসি করে পাঠানো হয়েছে টাকা। প্রতিবারই ফল আমদানির নাম করে পাঠানো হয়েছে টাকা। আর আমদানি করা হয়েছে সিগারেট। কখনও পোশাক আমদানি-রপ্তানিকারক, কখনও ডেটা ম্যানেজমেন্ট, আবার কখনও কার্গো ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং প্রতিষ্ঠান থেকে ফল আমদানি দেখানো হয়েছে। এলসিতে যেই মূল্য দেখানো হতো, হুন্ডি বা নন-ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠানো হতো কয়েকগুণ বেশি টাকা।

মূলত চোরাচালান আর অর্থ পাচার করতেই মেসার্স এস আর ট্রেডিং নামে একটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এতসব প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ের শাপলা হাউজিং এলাকার এই প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে লাপাত্তা। প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে ফল আমদানির আড়ালে সিগারেট আমদানি করে আসছে। ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠানটির সিগারেট আমদানির একটি চালান আটকের পর একে একে সিগারেট আমদানি ও অর্থপাচারের তথ্য বেরিয়ে আসে। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী মো. মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে চোরাচালান ও অর্থ পাচারের অভিযোগে মানি লন্ডারিং আইনে মামলার সুপারিশ করেছে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। সম্প্রতি মামলার সুপারিশ করে এনবিআর চেয়ারম্যানকে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এ বিষয়ে জানতে মো. মেহেদী হাসানের ব্যক্তিগত নম্বরে গত কয়েক দিনে বেশ কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানায় গিয়ে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।

সূত্রমতে, ২০১৮ সালের ৫ এপ্রিল। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর গোপন সংবাদ পায় যে, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ফলের ভেতর সিগারেট আসবে। এরই ভিত্তিতে কাস্টমস গোয়েন্দা কার্গো শাখায় নজরদারি বাড়ানো হয়। পরে কার্গো শাখায় চার ক্যারেট ফল পাওয়া যায়। একটি কার্টনে মালটার ভেতর সিগারেট পাওয়া যায়। পরে ক্যারেটগুলো বিমানবন্দরে গ্রিন চ্যানেলে এনে স্ক্যানিং করা হলে সিগারেটের অস্তিত্ব ধরা পড়ে। ক্যারেটগুলো খুলে পাঁচ হাজার ৩০০ কার্টন বিদেশি সিগারেট ও ৮৪৩ কেজি মাল্টা পান কাস্টমস গোয়েন্দার কর্মকর্তারা। পরে এসব সিগারেট ও মাল্টা জব্দ করা হয়, যার মূল্য প্রায় দুই কোটি ৬৯ লাখ টাকা।

রাজধানীর আগারগাঁও শাপলা হাউজিং এলাকার বাড়ি নং-২০৩ ঠিকানার মেসার্স এস আর ট্রেডিং নামের প্রতিষ্ঠানটি দুই হাজার ২২৫ কেজি ফ্রেশ ফ্রুট আমদানির ঘোষণা দিয়ে এসব সিগারেট আনে। পণ্য জব্দের পরপরই প্রতিষ্ঠানের মালিক ও সহযোগীরা পালিয়ে যান। শুল্ক গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানির অভিযোগে মামলা করে। পরে মামলার অনুসন্ধান করে এস আর ট্রেডিং ও এর মালিকের বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়। দীর্ঘ চার বছর অনুসন্ধান শেষে সম্প্রতি প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের মালিকের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলার সুপারিশ করে প্রতিবেদন দেয় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এসআর ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী মো. মেহেদী হাসান ও তার সহযোগী সুমন রানা। মো. মেহেদী হাসান চাঁদপুর জেলার কচুয়া পালাখাল এলাকার মো. শাহজাহানের ছেলে। আর সুমন রানার বাড়ি জামালপুরের সরিষাবাড়ী চাপকোনা ও হাটবাড়ী এলাকায়। মেহেদী হাসান ২০১৭ সালের ২০ এপ্রিল এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের হাতিরপুল শাখায় এসআর ট্রেডিংয়ের নামে হিসাব খোলেন। ২০১৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ হিসাবে ১৮ লাখ ৫৭ হাজার টাকা জমা ও উত্তোলন করা হয়।

আরও বলা হয়, মো. মেহেদী হাসান ২০১৮ সালের ৭ মার্চ সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে দুই হাজার ২২৫ কেজি ফ্রেশ ফ্রুট আমদানির ঘোষণা দিয়ে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের ওই শাখায় তিন হাজার ডলারের (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় দুই লাখ ৪০ হাজার টাকা) এলসি খোলে। এলসিতে আমিরাতে ফল রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয় ‘আসর সাদ ফুড স্টাফ ট্রেডিং এলএলসি’। ওই বছরের ২ এপ্রিল প্রতিষ্ঠানটি প্যাকিং লিস্ট ও কমার্শিয়াল ইনভয়েস এবং ৩ এপ্রিল এয়ারওয়ে বিল ব্যাংকে দেয়ার পর ব্যাংক ওই পণ্য ছাড় করার অনুমোদন দেয়। তবে শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা অনুসন্ধানের সময় অনলাইনে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব পাননি। আর এলসিতে আমদানি করা পণ্যের মূল্য দেখানো হয়েছে তিন হাজার ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় দুই লাখ ৪০ হাজার টাকা। কিন্তু শুল্ক গোয়েন্দার জব্দ করা সিগারেট ও মালটার দাম দুই কোটি ৬৯ লাখ টাকা। বাকি টাকা প্রতিষ্ঠানটি হুন্ডি বা নন ব্যাংকিং চ্যানেলে দুবাইতে পাচার করে দিয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, অনুসন্ধানে প্রতিষ্ঠানটির ফল আমদানির ঘোষণায় অর্থ পাচারের আরও তথ্য বেরিয়ে আসে। শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা দেখতে পান, এস আর ট্রেডিং এনআরবি ব্যাংকের হাতিরপুল শাখায় ফ্রেশ ফ্রুট (খেঁজুর, আঙ্গুর, এপ্রিকট, পেঁয়াজ) আমদানির জন্য ২০১৭ সালের ৩১ জুলাই তিন হাজার ১০০ ডলারের এলসি খোলে। রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের নাম দেয়া হয় ‘জাইয়ারিস কার্গো এলএলসি’। ওই বছরের ১ আগস্ট এক হাজার ২৩০ ডলারের ফল আমদানি করে প্রতিষ্ঠানটি।

শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা অনুসন্ধানে জানতে পারেন, ‘জাইয়ারিস কার্গো এলএলসি’ নামক প্রতিষ্ঠানটি কার্গো ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং কোম্পানি। ২০০৫ প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটি কোনো ফল রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান নয়। এটি কাস্টমস ডকুমেন্টস, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডিং, প্যাকিং ও ট্রান্সপোর্টেশন সেবা দিয়ে থাকে। ভুয়া প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ফল আমদানির আড়ালে সিগারেট আমদানি ও অর্থপাচার করেছে বলে ধারণা করছেন কর্মকর্তারা।

তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এস আর ট্রেডিং ২০১৭ সালের ১৩ জুলাই সংযুক্ত আরব আমিরাতের ‘ইমপ্রেস এফজেডসি, আজমান’ প্রতিষ্ঠান থেকে পনির ও এপ্রিকট আমদানির বিষয় উল্লেখ করে দুই হাজার ডলারের এলসি খোলে। ৭ জুন একই প্রতিষ্ঠান থেকে দুই হাজার ডলারের খেজুর আমদানির এলসি খোলে। শুল্ক গোয়েন্দার অনুসন্ধানে দেখা যায়, ইমপ্রেস এফ জেড সি, আজমান’ একটি পোশাক আমদানি-রপ্তানি ও ডেটা ম্যানেজমেন্ট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের নামে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ফল আমদানির আড়ালে সিগারেট আমদানির মাধ্যমে এস আর ট্রেডিং অর্থপাচার করেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, শুল্ক গোয়েন্দা মো. মেহেদী হাসান ও তার সহযোগী সুমন রানাকে শুনানিতে অংশ নিতে আটবার চিঠি দিলেও তিনি হাজির হননি। দুজনের ঠিকানায় যোগাযোগ করা হলেও তাদের পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠানের মালিক মো. মেহেদী হাসান নামসর্বস্ব ও ভুয়া রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা ব্যবহার করে ব্যাংকিং চ্যানেল, হুন্ডি ও নন-ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থপাচার করেছে বলে প্রমাণ পেয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা। ফলে মো. মেহেদী হাসান ও তার সহযোগী সুমন রানার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলার সুপারিশ করেছে শুল্ক গোয়েন্দা।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০