নাজমুল হুসাইন: দেশে ২০০০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ফল উৎপাদন ছিল ১১ দশমিক চার শতাংশ। আর সেই ১০ বছরে দেশে হেক্টরপ্রতি ফল উৎপাদন বেড়েছিল ১০ শতাংশ। ওই পরিমাণ বিবেচনায় ২০১৩ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ফল উৎপাদনশীলতায় বিশ্বের শীর্ষ অবস্থানে রেখেছিল বাংলাদেশকে। সেই সূচকে বাংলাদেশ সার্বিক ফল উৎপাদনে বিশ্বের ২৮তম দেশের স্থান পায়।
তবে সে তুুলনায় এর পরের বছরগুলোয় ফল উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতার হার আরও দ্রুত গতিতে বাড়ছে। শেষ গত দুই অর্থবছরেই ফল উৎপাদন বেড়েছে ১০ শতাংশ। আর দেশে ফলের উৎপাদনশীলতা ঠেকেছে প্রায় ২০ শতাংশে। এসব বিবেচনায় এখন বিশ্বে ফল উৎপাদনে আরও এগিয়েছে বাংলাদেশ।
কৃষি অধিদফতর বলছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে ফল উৎপাদন হয়েছিল ৯৯ লাখ ৭২ হাজার টন। আর পরের বছর ২০১৪-১৫তে উৎপাদন প্রায় ছয় শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ৬ লাখ ৮০ হাজার টন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে ফল উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ১০ লাখ ৩১ হাজার টন। অর্থাৎ দুই বছরেই উৎপাদন বৃদ্ধির হার প্রায় ১০ শতাংশ।
এছাড়া সংস্থাটির তথ্য আরও বলছে, ওই দুবছরে ফল উৎপাদনের আওতায় জমির পরিমাণ বেড়েছে ২৭ হাজার হেক্টর। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে ফলের জমির পরিমাণ ছিল ছয় লাখ ৭৮ হাজার ১৪৫ হেক্টর। পরের বছর সেই জমির পরিমাণ ছয় লাখ ৯৩ হাজার ২৩৫ হেক্টরে এবং শেষ ২০১৫-১৬তে জমির পরিমাণ সাত লাখ ২০ হাজার ২৬৩ হেক্টরে দাঁড়ায়। জমি ও উৎপাদন বৃদ্ধির হার বিবেচনায় বর্তমানে উৎপাদনশীলতার প্রায় ২০ শতাংশ। যা তুলনামূলকভাবে বিশ্বের প্রতিযোগী দেশগুলো থেকে দ্রুতগতিতে বাড়ছে আমাদের দেশে উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতার হার। এতে ২০১৫-১৬’র পরিসংখ্যান দিয়ে হিসাব করলে বাংলাদেশের অবস্থান আরও এগোবে।
কৃষি অধিদফতরের বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক মেহেদী মাসুদ বলেন, ‘প্রতি বছর ফল উৎপাদন বাড়ছে প্রায় ২০ শতাংশ হারে। বিশ্বে এখন বাংলাদেশ আম উৎপাদনে সপ্তম এবং পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে রয়েছে। তবে গত দুবছরের হিসাবে সেই সূচকে আরও এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।’
আম-পেয়ারার মতো গত কয়েক বছর থেকেই কাঁঠাল, কলা, লিচু, পেঁপে, বড়ই ও আনারসসহ বেশ কিছু দেশি ফল উৎপাদন সবচেয়ে দ্রুত হারে বাড়ছে। এ ধরনের ১৮ প্রজাতির ফল বর্তমানে বাণিজ্যিক চাষের আওতায় রয়েছে। ওইসব ফলের প্রতিবছর উৎপাদন বৃদ্ধির হার পাঁচ শতাংশের বেশি। আর কম-বেশি প্রচলিত-অপ্রচলিত উৎপাদন বৃদ্ধি হওয়ার মধ্যে রয়েছে ৪৫ প্রজাতির ফল।
ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির একই ধরনের তথ্য দিচ্ছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। তাদের তথ্যে দেশে সার্বিক ফল উৎপাদন কৃষি অধিদফতরের পরিমাণ থেকে কিছুটা কম হলেও উৎপাদন বৃদ্ধির হার একই। বিবিএসের সর্বশেষ হিসাবে, ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ফল উৎপাদন বেড়েছে চার দশমিক ৮৭ শতাংশ। এ তথ্যে ১৮ প্রজাতির বাণিজ্যিকভাবে চাষ হওয়া ফল উৎপাদন বেড়েছে।
কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে গত পাঁচ বছরে ৮৪টি ফলের নতুন জাত উদ্ভাবন হয়েছে। এতে হেক্টরপ্রতি ফলন আগের তুলনায় বেড়েছে। কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) উদ্ভাবিত ছয়টি উন্নত জাতের পেয়ারা এবং বেসরকারিভাবে আমদানি হওয়া থাই পেয়ারার চাষ দেশে পেয়ারার বিপ্লব ঘটিয়েছে। দেশজুড়ে আম্রপালি, হিমসাগর, হাঁড়িভাঙার মতো জাত এনেছে আমের বিপ্লব। পাহাড়জুড়ে পেঁপে উৎপাদন বাড়াচ্ছে রেড লেডি, শাহি জাত। উত্তরাঞ্চলে থাইকুল, আপেলকুল ও বাউকুল চাষে বৃদ্ধি পেয়েছে বড়ই’র আধিক্য। শুধু তাই নয়, দেশে নতুন করে অনেক প্রজাতির ফল বাণিজ্যিকভাকে চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে ড্রাগন, স্ট্রবেরি উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. রফিকুল ইসলাম মণ্ডল বলেন, ‘গত পাঁচ বছর আগেও দেশে বিশ্বের সব থেকে সুস্বাদু মাল্টা উৎপাদন হবে ভাবা যায়নি। সেই মাল্টায় বিপ্লব এসেছে দেশে। সারা বছর পাওয়া যাবেÑএমন আমের জাত এসেছে। ড্রাগন ফল চাষ হচ্ছে। সব মিলে দেশের এসব সফলতা উদ্যোক্তাসহ সরকারের সব পর্যায়ে সাড়া ফেলেছে। উৎপাদন বৃদ্ধিতে প্রাথমিক পর্যায়ে আরও প্রচুর কাজ হয়েছে। আগামী দু’তিন বছরের মধ্যে ফলের এ বিপ্লব আরও জোরদার হবে।
এদিকে কৃষি অধিদফতরের ফল উৎপাদনের ২০১৫-১৬ সালের তথ্যে জানা যায়, গত অর্থবছরে দেশে ২০ লাখ ২৩ হাজার ৯০২ টন আম উৎপাদন হয়েছে। সার্বিকভাবে কাঁঠাল উৎপাদন হয়েছে ১৬ লাখ ৯৪ হাজার টন, পেয়ারা চার লাখ ১৩ হাজার টন, কলা ১৭ লাখ ৫১ হাজার টন, পেঁপে পাঁচ লাখ ৬১ হাজার টন, আনারস চার লাখ ৬০ হাজার টন, লিচু এক লাখ ৮০ হাজার টন, বড়ই এক লাখ ৬১ হাজার টন, কমলা ৪০ হাজার টন, মাল্টা ৫৪ হাজার টন। বাণিজ্যিকভাবে চাষের আওতায় আসায় এসব ফলের অধিকাংশই দ্বিগুণ হয়েছে গত চার থেকে পাঁচ বছরে মধ্যে।
উৎপাদন বৃদ্ধির সুফল মিলছে দেশের রফতানি ও প্রক্রিয়াকরণ খাতে। বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাবে, পাঁচ বছরে বাংলাদেশ থেকে ফল রফতানি থেকে আয় আড়াইগুণেরও বেশি বেড়েছে। ২০০৯-১০ ও ২০১০-১১ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৩৮৮ কোটি টাকার ফল বিদেশে রফতানি করে। তবে ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ বছরে সেই রফতানির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৭৮০ কোটি টাকায়। অপরদিকে ২০১১-১২ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ২১১ কোটি ৩০ লাখ টাকার ফলের জুস রফতানি হয়েছিল। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সেই ফলের জুস রফতানি করে ৬৫০ কোটি টাকা এসেছে।
ইপিবি বলছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে ৫০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানির লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে সরকার। এ জন্য প্রয়োজন রফতানি পণ্যের বহুমুখীকরণ। এরই অংশ হিসেবে সম্প্রতি বাণিজ্যিক রফতানি পণ্যের পাশাপাশি তালিকায় যুক্ত হয়েছে লটকন, কদবেল, কাউ, বড়ই, ডেউয়া, অড়বড়ই, আমলকি, করমচা ও কামরাঙ্গার মতো অপ্রচলিত ফল।