ফল এখন মধ্যবিত্তের জন্য ‘বিলাসী খাদ্য’

বীর সাহাবী: আপেল, মাল্টা, আনার, আঙ্গুরএসব ফল নিন্মবিত্তদের খাদ্য তালিকা থেকে বহু আগেই উঠে গেছে। স্বল্প আয়ের মানুষ হয়তো রোগে বা বিশেষ আতিথেয়তায় কালেভদ্রে এসব ফল কিনে থাকে। তবে গত দেড় বছর ধরে আমদানিনির্ভর এসব ফলের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে মধ্যবিত্তদের জন্য আপেল, মাল্টা, আনার, আঙ্গুর কেনা কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেকেরই নিত্য আহারের তালিকা থেকে বিলাসী খাদ্য হয়ে উঠেছে এসব ফল।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমদানি কমাতে দেশের বাজারে এ ফলগুলোর দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। ফলে নি¤œ ও মধ্যবিত্তদের নিয়মিত খাদ্য তালিকা থেকে বাদ যাচ্ছে এ ফলগুলো। দুই বছর আগে যে আপেল ১২০ থেকে ১৫০ টাকায় পাওয়া যেত, সেই আপেল কিনতে এখন গুনতে হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩২০ টাকা। এ হিসেবে দুই বছরের ব্যবধানে আপেলের দাম দ্বিগুণের বেশি হয়েছে।

একই অবস্থা আনার, মাল্টা, আঙ্গুরের। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ফলের দাম বাড়ার কারণে তাদের বিক্রি কমেছে অনেক। মানুষ আগের মতো তেমন ফল কিনছে না। ব্যবসায়ও মন্দাভাব চলছে।

রাজধানীর বাদামতলীতে কয়েকজন আমদানিকারকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এলসি খুলতে না পারা ও ডলার সংকটে তাদের আমদানির পরিমাণ কমেছে। পাশাপাশি শুল্ক বাড়ার কারণে গত দুই বছরের তুলনায় অনেক ফলের দাম বেড়ে দিগুণ হয়েছে। ব্যবসায়ীরা কোনো রকমে টিকে আছেন বলেও তাদের মত।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মহানগর ফল আমদানি রপ্তানিকারক ও আড়তদার ব্যবসায়ী বহুমুখী সমিতির একজন সদস্য শেয়ার বিজকে বলেন, ‘২০২১ সালে এক কনটেইনার আপেল আনলে যে পরিমাণ শুল্ক দেয়া লাগত তা এখন দিগুণ দেয়া লাগছে। এতে এক কনটেইনার আপেল আমদানিতে যদি তখন ৩০ লাখ টাকা খরচ হতো সেটা এখন দাঁড়াচ্ছে ৪৮ লাখ টাকার বেশি। আবার ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে চাচ্ছে না। খুললেও আবার ডলারের দর নিচ্ছে অনেক বেশি। আমাদের বাধ্য হয়েই বেশি দাম দিয়ে এলসি খোলা লাগছে। ডিউটি বাড়ার কারণে এক কনটেইনার লাল আঙ্গুর আনতে শুধু ডিউটি খরচই হচ্ছে প্রতি ৭ কেজির কার্টনে ৮৫০ টাকা। এরপর আছে এর দাম ও যাতায়াত খরচসহ আনুষঙ্গিক আরও খরচ। এসবের পরই দাম গিয়ে দাঁড়াচ্ছে উচ্চ পর্যায়ে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এক কনটেইনারে আপেলের ২০ কেজি ওজনের ১ হাজার ১৮৬টি কার্টন থাকে, যার প্রতি কার্টনে শুধু শুল্ক গুনতে হচ্ছে ১ হাজার ২৫০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা। আর মাল্টার এক কনটেইনার ১৬ কেজি ওজনের ১ হাজার ৬০০ কার্টন থাকে; প্রতি কার্টনে ডিউটি গুনতে হচ্ছে ৯৫০ থেকে ১ হাজার টাকা।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, বাংলাদেশে ‘ফ্রেশ ফ্রুটস’ (তাজা ফল) ও ‘ড্রাই   ফ্রুটস’ (শুকনা ফল) এ দুই ক্যাটাগরিতে ফল আমদানি করা হয়ে থাকে। ড্রাই ফ্রুটস ক্যাটাগরিতে খেজুর, কিশমিশ, বাদাম, ড্রাই চেরি, ড্রাই এপ্রিকটসহ আরও নানা ধরনের শুষ্ক ফল আমদানি করা হয়। ফ্রেশ ফ্রুটস ক্যাটাগরিতে রয়েছে আপেল, মালটা, নাশপাতি, আঙুর (সাদা, কালো ও লাল), আম, কমলা, ডালিম, চেরি, ড্রাগন, কিউই, অ্যাভোকাডো, তরমুজ, রামবুটান, ম্যান্ডারিনসহ প্রায় ৫২ রকমের ফল। তবে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয়ে থাকে আপেল, কমলা, আঙুর ও মাল্টা।

বাদামতলীতে তাসফিয়া এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী শফিকুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বর্তমানে দাম অনেক বাড়তি। এখন আমাদেরই কেনা পড়ছে বেশি দামে। আমরা তো আর লোকসানে বিক্রি করব না। আমাদেরও কিছু লাভ করা লাগছে। ২০ কেজি ওজনের এক ক্রেট চায়না গালা আপেলের দাম ৪ হাজার ৭০০ টাকা বিক্রি করছি। ২০ কেজি আপেলে ৩ হাজার ৫০০ টাকা দামের মধ্যে  শুল্ক পড়ছে ১ হাজার ৯০০ টাকা। আগে এই শুল্ক ছিল ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। সেটাই এখন বেড়ে এ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আনার ২০ কেজি ওজনের এক ক্রেটের পাইকারি দাম সাড়ে ৪ হাজার থেকে ৭ হাজার পর্যন্ত বিক্রি করছি।’

ফল কেনা কমিয়েছেন অনেকেই

বাদামতলী পাইকারি ফল মার্কেটের সামনেই কার্টন নিয়ে বসে ফল বিক্রি করেন অনেক খুচরা ব্যবসায়ী। এখানকার ব্যবসায়ী আবুল কাশেম বলেন, ‘আমরা বেশি দাম দিয়ে ফল কিনছি। তাই আমাদেরও বেশি দামে বিক্রি করা লাগছে। এখন আপেল বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি। এই আপেলে গত বছর বা তার আরও আগের সময় এর অর্ধেক দাম ছিল। দাম বেড়ে যাওয়ায় বিক্রি অনেক কমে গেছে।’

ফল ক্রেতা ইমন চৌধুরী বলেন, ‘বাচ্চাটা আঙ্গুর খেতে চাচ্ছে অনেকদিন ধরে। দাম বেশি হওয়ায় কিনতে পারছি না। তবুও আজ এসেছি এক কেজি লাল আঙ্গুর কিনে নিয়ে যেতে। দাম কম থাকলে হয় আঙ্গুরের সঙ্গে এক কেজি আপেল বা মাল্টাও নিতে পারতাম। এখন আর আগের মতো মন চাইলেই এক কেজি ফল কিনে বাসায় নিয়ে যেতে পারি না।’

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে ফল বিক্রি করছেন কয়েকজন। এখানে ফল কিনতে আসা একজন রোগীর অভিভাবক সাইদুর রহমানের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আসছিলাম মাল্টা আর আঙ্গুর কিনতে। ডাক্তার রোগীকে আঙ্গুর আর মাল্টা খেতে বলেছে। কিন্তু আঙ্গুরের দাম যেই বেশি, এতে আঙ্গুর কিনলে আর মাল্টা কেনার টাকা থাকবে না।

পুরোনো ঢাকার নাজিরাবাজারের এক ফল বিক্রেতা সম্প্রতি জানান, এক কার্টন (২০ কেজি) সবুজ আপেল কিনতে তার খরচ হয়েছে সাত হাজার ২০০ টাকা। যাতায়াত, দোকান ভাড়া ও অন্যান্য খরচ ধরে এই আপেল ৪০০ টাকায় বিক্রি করতে হবে। কিন্তু ৪০০ টাকা কেজি দাম শুনে সবুজ আপেল কেউ নিতে চাচ্ছে না। অথচ এক বছর আগেও এ আপেল ২২০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি করেছেন তিনি।

সব ফলেরই দাম বেড়েছে

ফলের দাম যাচাইয়ে সদরঘাট, সূত্রাপুরসহ বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে গেছে, গত বছর প্রতি কেজি আপেলের দাম ছিল ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা, আর এখন কিনতে গুনতে হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩২০ টাকা। বাড়তির দিকে মাল্টার দাম। গত বছর এক কেজি মাল্টার দাম ছিল ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা, বর্তমানে ২৭০ থেকে ২৮০ টাকা। আনারের দামের অবস্থাও বেশ চড়া। যেখানে গত বছর ২৬০ থেকে ২৮০ টাকা ছিল এক কেজি, বর্তমানে ৩৫০ থেকে ৩৮০ টাকা। লাল আঙ্গুর ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি মিললেও এ বছরের শুরু থেকেই চড়া দামে বিক্রি হয়ে আসছে এ ফলটি। বর্তমানে লাল আঙ্গুরের দাম ৩৬০ টাকা। ভিটামিন সি-এর ঘাটতি পূরণ করা কমলাও দাম বেড়েছে। এ ফলটি গত বছর ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা কেজির মধ্যে পাওয়া গেলেও বর্তমানে ভালো মানের কমলা ২৫০ টাকার কমে মিলছে না।

এদিকে খাদ্যপণ্য হওয়া সত্ত্বেও বিদেশি ফলকে ২০১২ সালে বিলাসপণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে এনবিআর। ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, আপেল, কমলা ও নাশপাতিকে বিলাসপণ্যের তালিকায় রাখা হয়। এর প্রভাবে আগে যেখানে বিদেশি ফলের ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কহার ছিল ৩%, সেটি গত ৯ মাস আগে বেড়ে দাঁড়ায় ২৩ শতাংশে। তার সঙ্গে আমদানিতে ২৫% কাস্টমস ডিউটি, ১৫% ভ্যাট, ৫% অগ্রিম আয়কর এবং ৪% অ্যাডভান্স ট্রেড ভ্যাট তো আছেই।

ফল আমদানিকারকদের তথ্যমতে, বাংলাদেশ মূলত ভারত, থাইল্যান্ড, মিসর, তিউনিসিয়া, তুরস্ক, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, চীন, ভুটান, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, আফগানিস্তান, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ থেকে শুকনা ও ফ্রেশ দুই ক্যাটাগরির ফল আমদানি করে। আমদানি করা এসব ফলের মধ্যে ড্রাগন, স্ট্রবেরি, ডালিমসহ ১০ থেকে ১২ ধরনের ফল বাংলাদেশে চাষ হচ্ছে। বাকি কোনো কোনো ফল উৎপাদন না হওয়ায় এসব ফলের প্রায় সবটাই আমদানি করে চাহিদা পূরণ করতে হয়।

এসব ফলের বেশিরভাগ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিশেষায়িত কনটেইনারভর্তি হয়ে জাহাজে করে আমদানি হয়। আবার আকাশপথে ও স্থলবন্দর দিয়েও ফল আসে। এ বাহনের ওপরে ফলের দাম ওঠানামা করে। তবে বাংলাদেশের বেশিরভাগ বিদেশি ফল চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই আসে, পরে সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়া হয়। সাধারণত প্রতি বছর বিভিন্ন দেশ থেকে গড়ে সাত লাখ টন ফল আমদানি হয়ে থাকে তার মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ হচ্ছে আপেল ও মাল্টা। এ বিদেশি ফলের বাজারের আকার প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বলে ধারণা আমদানিকারকদের। তবে আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়া এবং ফল আমদানির জন্য এলসি (ঋণপত্র) খুলতে না পারায়, চাহিদাসম্পন্ন এ পণ্য আমদানিতে সমস্যা হচ্ছে। এতে আমদানির পরিমাণ কমে যাচ্ছে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছেন।

ঢাকা মহানগর ফল আমদানি-রপ্তানিকারক ও আড়তদার ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ আবদুল করিম বলেন, ‘ডলারের ওপর চাপ কমাতে সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশি ফল আমদানিতে নানা শর্ত আরোপ করার ফলে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তবে বিদেশি ফল আমদানি কমার কারণে দেশীয় ফলের বাজার বাড়ছে। কৃষকেরা যেমন ফল চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন, তেমনই কিছু আমদানিকারক বিদেশি ফলের ব্যবসা কমিয়ে এখন দেশীয় ফলের ব্যবসায় ঝুঁকছেন।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০