জাহেদুল ইসলাম সমাপ্ত, লালমনিরহাট: রংপুর অঞ্চলে মৌসুমি ফল সংরক্ষণ বা প্রক্রিয়াজাতকরণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় প্রতি বছর কোটি টাকা আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এ অঞ্চলের চাষিরা। একদিকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সময় নির্ধারণ করে দেওয়া, অন্যদিকে একসঙ্গে ফল পেকে যাওয়ায় কম দামে বাজারজাত করতে বাধ্য হচ্ছেন ফল চাষিরা। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, সরকারিভাবে ফল সংরক্ষণাগার না থাকলেও এ অঞ্চলে কিছু বেসরকারি উদ্যোগ রয়েছে।
জানা যায়, এ অঞ্চলের প্রতিটি জেলাতেই নতুন নতুন আম ও লিচুর বাগান তৈরি হচ্ছে। চাষ হচ্ছে ল্যাংড়া, গোপালভোগ, ক্ষীরশাপাত, হিমসাগর, ফজলি, আশ্বিনা, ক্ষুদি, বৃন্দাবনী, লক্ষ্মণভোগ, কালীভোগ, তোতাপরী, দুধসর, হাঁড়িভাঙা, লকনা ও মোহনভোগ জাতের সুস্বাদু আম। অন্যদিকে লিচু বাগানও রয়েছে বিভিন্ন জাতের। এর মধ্যে মাদ্রাজি, বুম্বাই, বেদানা, চায়না থ্রি, হাড়িয়া, কাঁঠালি উল্লেখযোগ্য।
এ ছাড়া বাণিজ্যিকভাবে লালমনিরহাট, পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁওয়ে অধিক পরিমাণে থাই পেয়ারা, কুল বড়ই, কমলা ও মাল্টার চাষ হয়। কিন্তু গত কয়েক বছর থেকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ফল পাড়ার সময় নির্ধারণ করে দেওয়ার ফলে লোকসানে ফল বিক্রি করে দিতে হয় ফল চাষিদের।
অনেক সময় দেখা যায়, নির্ধারিত সময়ের এক সপ্তাহ আগ থেকে ফল পাকা শুরু হয়। আর যখন পাড়া শুরু হয় তখন রেখে বিক্রি করার মতো অবস্থা থাকে না। ফলে লোকসানে বিক্রি করতে হয় ফল। তবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকলে এ সমস্যা হতো না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নাটোরে বেসরকারিভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকলেও রংপুর অঞ্চলে কোনো ব্যবস্থা নেই। সরকারের পক্ষ থেকে এখনও এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে ফল রাখতে পারলে বাগান মালিক বা ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফা অর্জন করতে পারবেন। সেই সঙ্গে আম, লিচুসহ অন্যান্য ফল এ অঞ্চলের জন্য অর্থনৈতিক ফসলে রূপান্তর হবে।
তথ্য মতে, রংপুর জেলায় তিন হাজার হেক্টর জমিতে আমের ফলন হয়েছে। এর মধ্যে হাঁড়িভাঙার ফলন হয়েছে এক হাজার ৪৫০ হেক্টরে। এছাড়া দিনাজপুরে ১৩টি উপজেলায় প্রায় চার হাজার ২৫ হেক্টর জমিতে আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এমনকি দিনাজপুর জেলায় এ বছর প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার হেক্টর জমিতে মাদ্রাজি, বুম্বাই, বেদানা, চায়না থ্রি, হাড়িয়া, কাঁঠালিসহ বিভিন্ন জাতের লিচু আবাদ হয়েছে।
চাষিরা জানান, গাছগুলোয় মুকুল আসার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবসায়ীরা বাগান কিনতে শুরু করেন। দুই-তিনবার হাত বদল হতে হতে বাগানের ধরন অনুযায়ী ৫০ হাজার থেকে শুরু করে দেড় লক্ষাধিক টাকা পর্যন্ত হয়। কিন্তু আম ও লিচু পাকা শুরু হওয়ার সঙ্গে গাছ থেকে তা পাড়া শুরু হয়। কেবল অন্যান্য ফসলের মতো তা সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় কোনো কোনো বছর ব্যবসায়ীদের লোকসানের সম্মুখীন হতে হয়। কারণ আম-লিচুসহ অন্যান্য ফল পচনশীল হওয়ার কারণে ব্যবসায়ীরা তা ধরে রাখতে পারেন না। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে জুস কোম্পানিগুলো বাজারে আম ও লিচু আসার আগেই বাগান মালিক বা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের চাহিদামতো ফল কিনে নেন। ফলে অনেকে ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন।
দিনাজপুরের মাসিমপুরের লিচুচাষি আবদুল মালেক জানান, অন্যান্য ফসলের মতো লিচু সংরক্ষণের ব্যবস্থা হলে অর্থনৈতিকভাবে চাষিরা লাভবান হওয়ার সুযোগ পাবেন। নইলে দেখা যায় গাছে লিচু পাকা শুরু হলেই বিভিন্ন কোম্পানির মালিকরা তাদের একটা মনগড়া বাজারদর সৃষ্টি করে লিচু কেনার চেষ্টা করেন।
রংপুরের জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত বাগান মালিক সালাম সরকার জানান, এ অঞ্চলে লিচু, আম, জাম, কাঁঠাল প্রাকৃতিক নিয়মেই পাকা শুরু হয়। সেখানে সময় নির্ধারণ করে দিয়ে কিছুটা হলেও বাগান মালিক বা চাষিরা আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। যদি সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকত তাহলে সর্বস্তরের ফল চাষি বা ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতেন না।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ মেজবাহুল ইসলাম জানান, সরকারিভাবে এখনও ফল চাষিদের জন্য এমন কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। তবে নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর ও ভোলাহাটে বেসরকারি উদ্যোগে জুস করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে প্রাণ, আকিজ গ্রুপ এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। কোম্পানিগুলো নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় তা সংরক্ষণ করে রাখার জন্য অধিক মুনাফা অর্জন করতে পারছে।

Print Date & Time : 26 June 2025 Thursday 6:09 pm
ফল রংপুর অঞ্চলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন চাষি
পত্রিকা ♦ প্রকাশ: