স্বাধীনতার পর থেকে দেশে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমলেও কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায় ধান উৎপাদন। দেখা যায়, ১৯৭০-৭১ সালে যেখানে ধানের উৎপাদন ছিল ১ কোটি ১০ লাখ টন, সেখানে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে উৎপন্ন হয়েছে সাড়ে তিন কোটি টন ধান। ধান উৎপাদনশীলতার এমন প্রভূত বৃদ্ধিতে বিরাট ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিআরআরআই বা ব্রি)। তার সঙ্গে দেশি-বিদেশি উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থাগুলোর অবদান অস্বীকারের জো নেই। প্রাপ্ত তথ্যমতে, বর্তমানে দেশের মোট ধান উৎপাদনের ৮৫ শতাংশই বিভিন্ন ব্রি জাত। এর মধ্যে বিআর-২৮ জাতের ধান চাষ হচ্ছে স্থানীয় ২০ শতাংশ জমিতে। আর একক জাত হিসেবে আনুমানিক ১৪ শতাংশ জমিতে চাষ হয় বিআর-২৯ জাত। উল্লিখিত দুটি জাতের ফলন হেক্টরপ্রতি ৫ থেকে ৬ টন। সুখবর হলো, ধান উৎপাদনে বাংলাদেশের সক্ষমতা বৃদ্ধির ঘটনা এখন আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত। গতকালের শেয়ার বিজে প্রকাশিত ‘ধানের উৎপাদনশীলতা: দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে বাংলাদেশ’ শীর্ষক খবরটি তার প্রমাণ। প্রতিবেদনটি প্রস্তুত হয়েছে গত বছর অক্টোবরে প্রকাশিত ‘এগ্রোবিজনেস ইন সাউথ এশিয়া’ শিরোনামের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে। সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশে গড়ে হেক্টরপ্রতি ধানের উৎপাদন ৪ দশমিক ৩৯ টন, যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় সর্বোচ্চ। উল্লেখ্য, এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশ ধান উৎপাদনে বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে লক্ষণীয়ভাবে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, হেক্টরপ্রতি ধান উৎপাদনে দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে শ্রীলঙ্কা; দেশটি গড়ে ৩ দশমিক ৮৯ টন ধান উৎপাদন করে থাকে প্রতি হেক্টরে। এ উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির সুফল যেন জনগণ পায়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে সবার আগে। মধ্যস্বত্ব¡ভোগীদের দৌরাত্ম্যে ধানচাষিরা প্রায়ই বাড়তি উৎপাদন বৃদ্ধির সুফল পান না বলে অভিযোগ ব্যাপক। এক্ষেত্রে তীক্ষè দৃষ্টি রাখা দরকার, সরবরাহ-শৃঙ্খলের কেউই যেন অন্যায় সুযোগ লাভ না করেন।
লক্ষণীয়, সামান্য হলেও আমাদের ধান উৎপাদনশীলতা আরেকটু বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে বলে প্রতীয়মান। তবে সেক্ষেত্রে ব্যবধানটি সামান্য। তা অর্জন কঠিন হবে না আমাদের পক্ষে। কথা হলো, ধান উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাত্রা অসীম নয়; এর একটি সীমারেখা আছে। আমরা তার অতি-নিকটে উপনীত হয়েছি বলে মনে করেন কেউ কেউ। ফলে কিছুদিন পর সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে ধানের উৎপাদনশীলতা। সেজন্য আগে থেকেই ফসল বৈচিত্রায়নে (ক্রপ ডাইভারসিফিকেশন) দৃষ্টি দেওয়া দরকার। দুর্ভাগ্যজনক হলো, দেশে এখন পর্যন্ত ফসল বৈচিত্রায়নে যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে, তার সবই প্রাথমিক অবস্থায় রয়েছে বলা যায়। কর্মসূচিগুলো এখনও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত নয়। কিছু ক্ষেত্রে উল্লিখিত কার্যক্রম সরকারের পর্যাপ্ত মনোযোগের অভাবে ব্যাহত হয়েছে বলেও প্রতীয়মান। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কয়েক বছর আগে দেশের কয়েকটি জেলায় ব্যাপকভাবে আলু উৎপাদন বৃদ্ধির খবর মিলছিল। অত্যন্ত দুঃখজনক, কাক্সিক্ষত দামে বিক্রি করতে না পারা এবং পাশাপাশি সংরক্ষণেও অসমর্থ হওয়ায় বিপুল পরিমাণ আলু ধ্বংসের খবর শিরোনাম হয়েছে তার ঠিক কিছুদিন পরই। এখনই দৃষ্টি দেওয়া না হলে তেমন কিছু ভুট্টার কপালেও ঘটতে পারে বলে শঙ্কা। অথচ স্থানীয়ভাবে চাষযোগ্য প্রতিটি ফসলের উৎপাদনশীলতা সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছাক, এটাই প্রত্যাশিত। নইলে আগামী দিনে বাড়তি জনসংখ্যার জন্য সুষম খাদ্যের জোগান দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এ অবস্থায় ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর যতোটা গুরুত্ব দিয়েছে, ফসল বৈচিত্রায়নেও কৃষি মন্ত্রণালয় সমভাবে জোর দেবে এটাই কাম্য।
Add Comment