রহমত রহমান: রাজস্ব ফাঁকি উদ্ঘাটনে মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরে (ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তর) গতি এসেছে। কখনও অভিযান আবার কখনও নিরীক্ষার মাধ্যমে উদ্ঘাটিত হচ্ছে রাজস্ব। তবে প্রযুক্তির সহায়তা আর টেকনিক অবলম্বন করায় এই অধিদপ্তর আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ফাঁকি উদ্ঘাটন করতে পারছে। গত তিন অর্থবছরে ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তর প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব ফাঁকি উদ্ঘাটন করেছে। এর মধ্যে প্রায় ৩৩৭ কোটি টাকা আদায় করেছে। বাকি টাকা আদায়ে ভ্যাট কমিশনারেটে প্রতিবেদন দিয়েছে অধিদপ্তর।
বিদায়ী অর্থবছর সবচেয়ে বেশি প্রতিষ্ঠান নিরীক্ষা, অভিযান, রাজস্ব ফাঁকি উদ্ঘাটন ও ফাঁকি দেয়া রাজস্ব আদায় করেছে। এ ছাড়া কয়েকশ’ প্রতিষ্ঠান নিরীক্ষা করা হচ্ছে, যাতে বিপুল পরিমাণ ফাঁকি উদ্ঘাটিত হবে বলে আশা করছে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। সম্প্রতি ভ্যাট গোয়েন্দার নিরীক্ষা ও চলমান কার্যক্রম নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
সূত্রমতে, ভ্যাট গোয়েন্দার নিরীক্ষা কার্যক্রম ও চলমান প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষা কার্যক্রমের হালনাগাদ তথ্য চেয়ে এনবিআর থেকে ভ্যাট গোয়েন্দাকে চিঠি দেয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি নিরীক্ষা হালনাগাদ তথ্য দিয়ে এনবিআরকে প্রতিবেদন দেয় ভ্যাট গোয়েন্দা। এতে ২০১৮-১৯, ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরের উদ্ঘাটিত ও আদায় করা রাজস্ব তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া নিরীক্ষা কার্যক্রম চলমান প্রতিষ্ঠানের সর্বশেষ অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। তিন অর্থবছরে ৪১৮টি নিরীক্ষা শেষ হয়েছে। যাতে প্রায় তিন হাজার ৬২৭ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি উদ্ঘাটিত হয়েছে, যার মধ্যে আদায় হয়েছে প্রায় ৩৩৭ কোটি টাকা। নিরীক্ষা শেষে মামলা করে উদ্ঘাটিত রাজস্ব আদায়ে মামলাগুলো সংশ্লিষ্ট ভ্যাট কমিশনারেটে পাঠিয়েছে ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তর।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছর সবচেয়ে বেশি প্রতিষ্ঠান নিরীক্ষা ও অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এই অর্থবছর নিরীক্ষা, অভিযান, ফাঁকি উদ্ঘাটন ও আদায় গত তিন অর্থবছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২১৫টি প্রতিষ্ঠান নিরীক্ষা ও অভিযানে মোট প্রায় এক হাজার ৬৩৬ কোটি টাকা ফাঁকি উদ্ঘাটিত হয়েছে; যার মধ্যে আদায় হয়েছে প্রায় ১৩৮ কোটি টাকা। বিদায়ী অর্থবছর সর্বোচ্চ ১২৫টি প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষা শেষ করা হয়েছে। এতে প্রায় এক হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা ফাঁকি উদ্ঘাটিত হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ১৩০ কোটি টাকার বেশি আদায় করেছে ভ্যাট গোয়েন্দা। এ ছাড়া ৯০টি প্রতিষ্ঠানে অভিযান শেষে প্রায় ২৭২ কোটি টাকার ফাঁকি উদ্ঘাটন ও প্রায় ৮ কোটি টাকা আদায় হয়েছে।
ফাঁকি উদ্ঘাটনের তালিকায় থাকা ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে উত্তরা ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, এবি ব্যাংক, হাবিব ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, মেঘনা ব্যাংক লিমিটেড। ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে-এনআরবি গ্লোবাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স, ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ, আলফা ইসলামী লাইফ, চার্টার্ড লাইফ, সাউথ এশিয়া ইন্স্যুরেন্স, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ ইন্স্যুরেন্স, ফনিক্স ইন্স্যুরেন্স, সন্ধানী লাইফ, ডায়মন্ড লাইফ, মেঘনা লাইফ, হোমল্যান্ড লাইফ, ইউনাইটেড ইন্স্যুরেন্স, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স, সিকদার ইন্স্যুরেন্স, ইসলামী ইন্স্যুরেন্স, পিপলস ইন্স্যুরেন্স, মার্কেন্টাইল ইন্স্যুরেন্স, নর্দার্ন জেনারেল ইন্স্যুরেন্স, ন্যাশনাল লাইফ, ডেল্টা লাইফ, প্রভাতী ইন্স্যুরেন্স, আমেরিকান লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে লংকাবাংলা ফাইন্যান্স, আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট, দি ইউএই বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট, বাংলাদেশ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ফাস্ট ফাইন্যান্স, বিএমএসএল ইনভেস্টমেন্ট, লংকাবাংলা ইনভেস্টমেন্ট, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, আইসিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট, বে লিজিং, অ্যালায়েন্স ক্যাপিটাল অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট, বাংলাদেশ রেইস ম্যানেজমেন্ট, মাইডাস ফাইন্যান্স। সিমেন্ট কোম্পানির মধ্যে রয়েছেÑরয়েল সিমেন্ট, কনফিডেন্স সিমেন্ট, অ্যামিরেটস সিমেন্ট, ইস্টার্ন সিমেন্ট, লাফার্স হোলসিম, মদিনা সিমেন্ট, অলিম্পিক সিমেন্ট।
অন্যান্য উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে-ড্যানিশ কনডেন্স মিল্ক, নাভানা সিএনজি, সিডিবিএল, চট্টগ্রাম বন্দর, পিএইচপি শিপ ব্রেকিং, হোটেল আমারি, ডিপিএস এসটিএস স্কুল, গ্রিন হেরাল্ড স্কুল, গ্রেইস ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, তানভীর পলিমার, মুন্নু সিরামিক, ওরিয়ন ফুড, রহিম স্টিল মিলস, রহিম সুপার স্ট্রিম, এলিট পেইন্ট, বসুন্ধরা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ, আইডিয়াল পলিমার, নাভানা টয়োটা, জিপিএইচ ইস্পাত, কিয়াম মেটাল, ডিবিএল সিরামিক, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড, বনানী ক্লাব, শেলটেক সিরামিক, এশিয়ান পেইন্টস, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, পিএইচপি রিফাইনারি, লুবনান ট্রেড কনসোর্টিয়াম, মেসার্স মেলেনেডস, ইভ্যালি, আবুল-খায়ের টোব্যাকো, একুয়া মিনারেল, বিএসবি ফাউন্ডেশন, পারটেক্স পেপার মিলস, আকতার ফার্নিচার, ফ্রন্ট ডেস্ক বাংলাদেশ, ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো, গ্রেট কাবাব ফ্যাক্টরি, ফুড ভিলেজ, উজালা পেইন্টস, ফুডপান্ডা, মি. বেকার, সাইরো রিসোর্ট, হোটেল লেকশোর, মোহাম্মদ ট্রেডিং, আলিশা মার্ট, চারুতা প্রাইভেট ইত্যাদি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০১৯-২০ অর্থবছর ৫১টি প্রতিষ্ঠান নিরীক্ষা ও ২৯টি প্রতিষ্ঠানে অভিযান পরিচালনাসহ মোট ৮০টি মামলার প্রতিবেদন ভ্যাট কমিশনারেটগুলোয় পাঠানো হয়। এর মধ্যে ৫১টি প্রতিষ্ঠান নিরীক্ষা শেষে প্রায় ১৫৯ কোটি টাকা ফাঁকি উদ্ঘাটিত হয়। যার মধ্যে প্রায় ৪৯ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। এ ছাড়া ২৯টি প্রতিষ্ঠানে অভিযান শেষে প্রায় ১৭৯ কোটি টাকা উদ্ঘাটিত হয়, যার মধ্যে আদায় হয়েছে প্রায় ২১ কোটি টাকা।
নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে-পূবালী ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক, হেলথকেয়ার, গার্ডিয়ান লাইফ, সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স, ব্যাংক আল-ফালাহ, উরি ব্যাংক, ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, লংকাবাংলা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট, ফাইবার হোম, টার্কিশ হোপ স্কুল, মোনালিসা সিরামিক, সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্স, মেঘনা লাইফ, দেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স, প্রাইম ইসলামী লাইফ, প্রগতি লাইফ, সোনালী লাইফ, যমুনা ব্যাংক, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স, অঙ্গন প্রপার্টিজ, এনসিসি ব্যাংক, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক, আকিজ বিড়ি ফ্যাক্টরি, ইস্টার্ন পলিমার, মুন্নু সিরামিক, খাদিম চা ইত্যাদি। এ ছাড়া তদন্ত শেষে যেসব প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব ফাঁকি উদ্ঘাটিত হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑএশিয়ান টেক্সটাইল, প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স, শাহ সিমেন্ট, রূপালী ইন্সুরেন্স, স্প্যারো অ্যাপারেলস, ইউনাইটেড শক্তি, র্যাংগস ইলেকট্রনিক্স, রহিম আফরোজ ব্যাটারি, পদ্মা ক্রাউন, বিএসআরএম স্টিল, কনফিডেন্স সিমেন্ট ইত্যাদি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০১৮-১৯ অর্থবছর ১২৩টি নিরীক্ষা ও অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। যাতে প্রায় এক হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা ফাঁকি উদ্ঘাটিত হয়েছে। যার মধ্যে আদায় হয়েছে প্রায় ১২৯ কোটি টাকা।
ফাঁকি উদ্ঘাটিত উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে-সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্স, সান ফ্লাওয়ার লাইফ, প্রটেকটিভ লাইফ, সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্স, রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্স, পপুলার লাইফ, বায়রা লাইফ, মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফ, জেনিথ ইসলামী লাইফ, গোল্ডেন লাইফ, বেস্ট লাইফ, বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স, বসুন্ধরা লজিস্টিকস, গ্র্যান্ড সুলতান টি-রিসোর্ট, রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্স, আনোয়ার রিয়েল এস্টেট, যমুনা ব্যাংক, আকতার ফার্নিচার, সিগ্যাল হোটেল, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, উরি ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, পিপলস লিজিং, বেঙ্গল গ্লাস ওয়ার্কস, দুবাই বাংলাদেশ সিমেন্ট, এটলাস ফুটওয়্যার, অলিম্পিক সিমেন্ট, জিসকা ফার্মা, বিল ট্রেড ইঞ্জিনিয়ারিং, ফু-ওয়াং ইন্ডাস্ট্রিজ, ইউনিয়ন ব্যাংক, পিএইচপি কন্টিনিউয়াস গ্যালভানাইজিং, রেডিয়েন্ট ফার্মা, ঢাকা আইসক্রিম, ডেকো ফুডস, নাসির বিড়ি, সামিট অ্যালায়েন্স, নেমসন কনটেইনার, বিএম কনটেইনার ডিপো, সিটি সুগার, প্যারামাউন্ট টেক্সটাইল, বে ফুটওয়্যার, আফতাব অটোমোবাইলস, থার্মেক্স গ্রুপের আটটি প্রতিষ্ঠান, চট্টগ্রাম ক্লাব, নারায়ণগঞ্জ ক্লাব, হামদর্দ ল্যাবরেটরিজ, বেঙ্গল টেকনো ফার্মা, এ ওয়ান পলিমার, সনি র্যাংগস, মিনিস্টার হাইটেক লিমিটেড, আনোয়ার সিমেন্ট, প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স, গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স ইত্যাদি।
এ বিষয়ে ভ্যাট গোয়েন্দার মহাপরিচালক ড. মইনুল খান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ভ্যাট গোয়েন্দা এনবিআরের নির্দেশনা অনুযায়ী আইনের ভেতর থেকে কাজ করছে। টিমওয়ার্কের মাধ্যমে কাজ করায় আমরা যেকোনো সময়ের চেয়ে নিরীক্ষা ও অভিযান বেশি পরিচালনা করতে পারছি। আমরা বহু প্রতিষ্ঠান নিরীক্ষার কাজে হাত দিয়েছি, যা শেষ হলে উল্লেখযোগ্য রাজস্ব ফাঁকি উদ্ঘাটিত হবে বলে আশা করছি।’