ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট, যাকে ফাইটোকেমিক্যালও বলা হয়ে থাকে, আসলে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত গাছের কিছু কেমিক্যাল। গাছ রোগবালাই, ক্ষতিকর পোকামাকড় ও সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে এটি তৈরি করে। এছাড়া বেশ কিছু ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট আছে যারা ফলমূল, শাকসবজি ও খাদ্যশস্যের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ রং, স্বাদ ও গন্ধের জন্য দায়ী। সাম্প্রতিক অগণিত গবেষণায় উঠে এসেছে, এসব কেমিক্যাল শুধু গাছই নয়, মানুষের সুস্বাস্থ্য বিনির্মাণেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম। তবে এদেরকে রাখা হয়েছে অত্যাবশ্যক পুষ্টি উপাদান শ্রেণিতে। কারণ এরা খাদ্যের অন্য পুষ্টি উপাদান, যেমন কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, চর্বি, ভিটামিন বা মিনারেলের মতো জীবনের জন্য অত্যাবশ্যক নয়।
এখন পর্যন্ত ১০ হাজার ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট সম্পর্কে জানা সম্ভব হলেও বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন এমন ৪০ হাজার ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট প্রকৃতিতে বিদ্যমান। অর্থাৎ মানুষের জানার বাইরেও থেকে গেছে অনেকগুলো। ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট-সমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে রয়েছে রঙিন ফলমূল, শাকসবজি, খাদ্যশস্য, বাদাম, চা-কফি, মসলা প্রভৃতি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে এগুলো মানুষের শরীরে কাজ করে। হাজার হাজার ফাইটোনিউট্রিয়েন্টের ওপর করা ল্যাবরেটরির পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলকে যদি সংক্ষেপে উপস্থাপন করতে চাই, তবে বলা যায় এরা ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে। প্রতিনিয়ত খাবার, পানীয় ও বাতাসের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করা ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদানের বিরুদ্ধে এটি প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ক্যানসারে মোড় নিতে পারে এমন প্রদাহ ও অক্সিডেটিভ ড্যামেজকে হ্রাস করে। ডিএনএ ড্যামেজকে প্রতিহত ও এর মেরামতে সাহায্য করে। ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি হ্রাস করে। ড্যামেজড কোষকে আবার উজ্জীবিত হতে বাধা দেয়। হরমোন নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট জিনকে সুইচড অফ বা অন করতে পারে। অর্থাৎ কেউ যদি ওবেসিটি, ডায়াবেটিস কিংবা ক্যানসার সৃষ্টিকারী জিন বহন করে, তবে নির্দিষ্ট ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট পারে সেসব জিনকে সুইচড অফ রাখতে।
প্রকার অনেক হলেও গবেষকরা ছয় ধরনের ফাইটোনিউট্রিয়েন্টকে এদের কার্যকারিতা বিচারে অপেক্ষাকৃত বেশি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছেন
লিগন্যান: হরমোন-সম্পর্কিত ক্যানসার ও ওভারিয়ান ক্যানসার প্রতিরোধ করে। অন্য ফাইটোনিউট্রিয়েন্টের মতো লিগন্যানও তাজা ফলমূল ও শাকসবজিতে পাওয়া গেলেও বিভিন্ন ধরনের বীজ, যেমন তিল, রাই, যব প্রভৃতিতে এগুলো প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় ফ্লাক্স বীজে।
রেসভারেটর: হৃদরোগ ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করে। আঙ্গুরের ত্বক এদের একটি ভালো উৎস। তবে চীনাবাদাম, কোকোয়া ও বেরিজাতীয় ফলেও এদের পাওয়া যায়।
ক্যারোটিনয়েড: এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের গুণাবলি আছে। চোখের স্বাস্থ্য, ইমিউন সিস্টেম, আন্তঃকোষীয় যোগাযোগ, ক্যানসার প্রতিরোধ ও কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ প্রতিরোধে ভূমিকা রয়েছে। লাল, কমলা ও গাঢ় সবুজ বর্ণের ফলমূল ও সবজি, যেমন গাজর, মিষ্টিআলু, পেঁপে, তরমুজ, আম, টমেটো, কমলা, পালংশাক, পুঁইশাক ও সবুজ শাক প্রভৃতিতে রয়েছে উপাদানটি।
কারকিউমিন: এটি অ্যান্টি-ইমফ্লামেটরি উপাদান ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা টিউমার ও টক্সিক উপাদান প্রতিরোধ করে। এটি পাওয়া যায় হলুদে।
ইলাজিক অ্যাসিড বা ট্যানিন: এটি একটি অ্যান্টি-ইমফ্লামেটরি উপাদান ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। ক্যানসার, উচ্চ রক্তচাপ ও আর্টারিয়াল প্লেক প্রতিরোধ করে। আঙ্গুর, বেদানা, বেরিজাতীয় ফল, আখরোট প্রভৃতিতে পাওয়া যায়।
ফ্লাভনয়েড: ক্যানসার ও কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ প্রতিরোধ করে। দীর্ঘায়ু হতে সাহায্য করে। এই গ্রুপের মধ্যে অনেক ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট থাকায় এর উৎসও অনেক। যেমন আপেল, পেঁয়াজ, চা, কফি, বাতাবিলেবু, বেরিজাতীয় ফল, শিমজাতীয় সবজি, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রকলি, টমেটো, পেঁয়াজ পাতা, আদা, লেবু, ধনিয়াপাতা, গাজর প্রভৃতি। এখন পর্যাপ্ত পরিমাণ ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট গ্রহণ নিশ্চিত করতে যা প্রয়োজন তা হলো খাদ্য তালিকায় বৈচিত্র্যময় খাবার রাখা। বিশেষ করে নানা বর্ণের খাবার। কেননা সব বর্ণের আছে স্বতন্ত্র উপকারিতা। তবে ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট সাপ্লিমেন্টনা খাওয়াই ভালো, কারণ প্রাকৃতিক অবস্থায় ফাইটোনিউট্রিয়েন্টগুলোকে শরীর যেভাবে শোষণ করতে পারে, সাপ্লিমেন্টের নিউট্রিয়েন্টকে সেভাবে পারে না। তাছাড়া ফাইটোনিউট্রিয়েন্টগুলো অন্য নিউট্রিয়েন্টের সঙ্গে যৌথভাবেও কাজ করে বলে ধারণা করা হয়। আর একটি বিষয় হলো, ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট সম্পর্কিত গবেষণাগুলো সাধারণত যেসব দেশে হয় সেখানকার ফলমূল ও শাকসবজির উপকারিতা সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। জেনে রাখা ভালো, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম বৈচিত্র্যপূর্ণ ফলমূল ও শাকসবজি উৎপাদনকারী অঞ্চল। তাই দেশীয় খাবার থেকেই আমরা পেতে পারি প্রয়োজনীয় ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট। থাকতে পারি সুস্থ।
জুঁই ইয়াসমিন