ফার্নেস অয়েল আমদানিতে এলসি খুলছে না ব্যাংকগুলো!

ইসমাইল আলী: বর্তমানে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার প্রায় ২৭ শতাংশ ফার্নেস অয়েলের। এর বেশিরভাগই বেসরকারি খাতের রেন্টাল ও আইপিপি (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) কেন্দ্র। তবে বেসরকারি এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ফার্নেস অয়েল আমদানি নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। ফার্নেস অয়েল আমদানিতে এলসি খুলতে চাচ্ছে না বিভিন্ন দেশীয় ব্যাংক। আবার বিদেশি ব্যাংকগুলোও তেল আমদানির এলসি কনফার্ম করছে না। ফলে ফার্নেস অয়েল সংকটে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এতে বিদ্যুৎ খাতের চলমান সংকটের বিভিন্ন কারণ তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি লোডশেডিং নিয়ন্ত্রণে বেশকিছু সুপারিশও তুলে ধরা হয়েছে।

প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা (আমদানিসহ) ২১ হাজার ৭১০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা পাঁচ হাজার ৯২৫ মেগাওয়াট। বর্তমানে ফার্নেস অয়েলচালিত সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা ৮২৮ মেগাওয়াট। আর বেসরকারি (রেন্টাল ও আইপিপি) বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা পাঁচ হাজার ৯৭ মেগাওয়াট। তবে তেলের সংকটে এখন বেসরকারি বেশকিছু ফার্নেস অয়েলের বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রয়েছে।

সরকারি কেন্দ্রগুলো বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) আমদানিকৃত তেল ব্যবহার করে। তবে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর প্রায় পুরোটাই সরাসরি তেল আমদানি করে থাকে। এজন্য গত অর্থবছর ৪৪ লাখ ৭৪ হাজার ৮৬৬ মেট্রিক টন ফার্নেস অয়েল আমদানি করা হয়। তবে ডলার সংকটের কারণে বর্তমানে তেল আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। আবার ভর্তুকির অর্থ ছাড় না করায় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চরম আর্থিক তথা তারল্য সংকটে রয়েছে। এছাড়া ফার্নেস অয়েল আমদানির ওপর উচ্চহারে শুল্ক করারোপ করা হয়েছে। এতে তেল আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পিডিবির অনুকূলে বরাদ্দকৃত ভর্তুকির অর্থ ছাড় করতে বিলম্ব করছে। এতে পিডিবি যথাসময়ে কোম্পানিগুলোর বিল পরিশোধ করতে পারছে না। ফলে ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর এলসি নিষ্পন্ন বিলম্বিত হচ্ছে। পাশাপাশি তেল আমদানির জন্য নতুন এলসি খুলতেও সমস্যা হচ্ছে। এছাড়া বিল পরিশোধ বিলম্বিত হওয়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পরিচালনায় লুব অয়েল ও খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানি ব্যাহত হচ্ছে।

এদিকে বর্তমানে টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং ডলার সংকটের কারণে ফার্নেস অয়েল আমদানিতে এলসি খোলার সিঙ্গেল বরোয়ার এক্সপোজার বা গ্রুপ এক্সপোজার লিমিট অতিক্রান্ত হওয়ায় এলসি সেটেলমেন্ট ব্যতীত নতুন এলসি খোলাও সম্ভব হচ্ছে না।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বৈশ্বিক জ্বালানি পরিস্থিতি ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ফার্নেস অয়েল আমদানির জন্য দেশীয় ব্যাংকগুলো এলসি খোলায় অনীহা প্রকাশ করছে। আবার দেশীয় ব্যাংকগুলোর এলসি খোলার আগে বিদেশি ব্যাংকগুলো এলসি কনফার্ম করতে অনাগ্রহ প্রকাশ করছে। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরে জেটি সংখ্যা কম থাকায় ও কিছু জেটি রক্ষণাবেক্ষণ চলায় প্রতিটি শিপমেন্টে তেল আনলোডিংয়ে অন্যান্য সময়ের চেয়ে অধিক সময় লাগছে।

অন্যদিকে বেসরকারি খাতে পরিচালিত ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের তেল আমদানির বিল অব লেন্ডিং তারিখ থেকে বিল প্রাপ্তির পরবর্তী কার্যদিবসের ডলারের বিনিময় হারের মধ্যে পার্থক্য হওয়ায় কোম্পানিগুলো লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছে। এতে কোম্পানিগুলোর বড় ধরনের লোকসান হচ্ছে। এজন্য কোম্পানিগুলো ওই অর্থ সমন্বয়ের জন্য তেলের মূল্য পরিশোধের জন্য ট্র–আপ পেমেন্ট প্রদানের জন্য আবেদন করেছে। এক্ষেত্রে বিল প্রদানের দিনের ডলারের বিনিময় হার চাচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো।

ফার্নেস অয়েল আমদানি শুল্কারোপের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিপিসি কর্তৃক আমদানিকৃত ফার্নেস অয়েলের ট্যারিফ মূল্য প্রতি লিটারে ৪০ সেন্ট। এতে প্রতি মেট্রিক টনের অ্যাসেসেবল ভ্যালু (মূল্যায়নযোগ্য মান) দাঁড়ায় ৪০৮ ডলার বা ৩৮ হাজার ৭৯৬ টাকা (এক ডলার = ৯৫ টাকা)। এর ওপর বিপিসিকে শুল্ককর পরিশোধ করতে হয়। তবে বেসরকারি খাতে প্রতি মেট্রিক টনের অ্যাসেসেবল ভ্যালু বাজারদর তথা ৬৭৭ ডলার বা ৬৪ হাজার ৩৫৫ টাকা। বেসরকারি কেন্দ্রগুলোকে এর ওপর শুল্ককর পরিশোধ করতে হয়।

যদিও ২০১১ সালের ২৫ জানুয়ারি নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের স্বার্থে ফার্নেস অয়েল আমদানির ওপর শুল্ককর প্রত্যাহার করেছিল সরকার। তবে ২০২০ সালের ৩০ জুন তা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। ফলে আমদানি পর্যায়ে বর্তমানে ১০ শতাংশ কাস্টম শুল্ক, ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর ও দুই শতাংশ অগ্রিম আয়কর পরিশোধ করতে হয়। এতে প্রতি টনে বিপিসিকে শুল্ককর দিতে হয় ১১ হাজার ৫৭ টাকা ও বেসরকারি খাতকে দিতে হয় ১৮ হাজার ৩৪১ টাকা। অর্থাৎ প্রতি টনে বেসরকারি খাতকে সাত হাজার ২৮৪ টাকা বেশি শুল্ককর দিতে হয়। এতে বছরে প্রায় তিন হাজার ২৬০ কোটি টাকা অতিরিক্ত শুল্ককর দিতে হচ্ছে।

এদিকে ফার্নেস অয়েল আমদানির জন্য গত অর্থবছর বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে মোট শুল্ককর পরিশোধ করতে হয়েছে সাত হাজার ৭০৩ কোটি টাকা। যদিও এ অর্থ কোম্পানিগুলোকে ভর্তুকি হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে পরবর্তী সময়ে পরিশোধ করা হয়। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পর বিল আকারে এ অর্থ ফেরত পেতে কোম্পানিগুলোর ছয় থেকে সাত মাস বা তারও বেশি সময় লেগে যাচ্ছে। এতে বিদ্যুৎ খাতে এক ধরনের তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে শুল্ককর প্রত্যাহার করা হলে বেসরকারি কেন্দ্রগুলোর সংকট কমে আসবে। ফলে তাদের পক্ষে তেল আমদানি সহজ ও দ্রুত হবে বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০