জয়নাল আবেদিন: পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ফার্স্ট ফাইন্যান্সের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) তুহিন রেজাকে অব্যাহতি দিয়েছে পরিচালনা পর্ষদ। ব্যবসা উন্নয়ন খরচে নয়-ছয় ও আমানত সংগ্রহে কমিশন বাণিজ্য ও নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগে এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা বাস্তবায়নে প্রতিষ্ঠানটি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে।
গত ১৩ মার্চ কমিশন বাণিজ্য বন্ধে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান আমানত সংগ্রহ করতে কমিশন দিচ্ছে, উন্নয়ন ব্যয় দেখাচ্ছে বা ব্যবসা উন্নয়ন খরচ করছে। এর ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তহবিল ব্যয় ‘অযৌক্তিকভাবে’ বাড়ছে বলে ঋণ বা বিনিয়োগের সুদ বা মুনাফার হারও বেড়ে যাচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ফার্স্ট ফাইন্যান্সের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক তুহিন রেজার বিরুদ্ধে ব্যবসা উন্নয়ন খরচে নয়ছয় ও আমানত সংগ্রহে কমিশন বাণিজ্য, ব্যক্তিগত সিআইবি তথ্য গোপন, কোনো বিজ্ঞপ্তি ও নিয়োগ পরীক্ষা ছাড়াই একক সিদ্ধান্তে ২২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির সার্ভিস রুলের ব্যত্যয় ঘটানের অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, উল্লিখিত অভিযোগ যাচায়ের জন্য প্রতিষ্ঠানের ৩৩৪তম বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সুপারিশ মোতাবেক ৩৩৭তম বোর্ড সভায় চলতি বছরের ৬ মার্চ তুহিন রেজাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। জারি করা হয় কারণ দর্শানোর নোটিস। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৬ মার্চ অভিযোগের উত্তর হিসেবে একটি লিখিত জবাব দেন তুহিন রেজা। লিখিত জবাব পর্যালোচনা করে এবং অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাকে চলতি মাসের ২৪ তারিখ ডিসমিস বা চূড়ান্তভাবে অব্যাহতি দেয়া হয়। এছাড়া কমিশন বাণিজ্য বাবদ প্রাপ্ত সাড়ে ৮০ লাখ টাকা ফেরত দেয়ার নির্দেশ দেয় বোর্ড।
বিষয়টি নিশ্চিত করে গতকাল ফার্স্ট ফাইন্যান্সের চেয়ারম্যান খান মোহাম্মদ মইনুল হাসান শেয়ার বিজকে বলেন, তুহিন রেজার অনিয়মের সত্যতা যাচাইয়ে তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তাদের সুপারিশ অনুযায়ী, গত ২৪ তারিখে চূড়ান্তভাবে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে চায়। সে লক্ষ্যে আমরা সবাই চেষ্টা করছি। প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে বোর্ড ও ম্যানেজমেন্ট একসঙ্গে কাজ করছি। সম্মিলিত চেষ্টায় ফার্স্ট ফাইন্যান্স আবার ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশাবাদী মইনুল হাসান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সাল শেষে ফার্স্ট ফাইন্যান্সের বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ৮৯৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ৭৪২ কোটি। সুতরাং ঋণের ৮৩ শতাংশই খেলাপি হয়ে পড়েছে। একই সময়ে ১৫৭ কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতি দেখা দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে। এতে উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন আমানতকারীরা।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ফার্স্ট ফাইন্যান্স দীর্ঘদিন ধরে জেড ক্যাটেগরিতে রয়েছে। তালিকাভুক্তির পর থেকে কোনো বছরই বিনিয়োগকারীদের নগদ লভ্যাংশ দিতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। দিয়েছে বোনাস। তবে ২০১৫, ১৬, ১৭ ও ১৮ সালে কোনো লভ্যাংশই দিতে পারেনি ফার্স্ট ফাইন্যান্স। সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার ফেসভ্যালুর চেয়ে কমে ৬ টাকা ৪০ পয়সা থেকে ৭ টাকায় কেনাবেচা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, কয়েক মাস ধরে নানা অনিয়মে টালমাটাল ব্যাংকবহির্ভূত বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ইতোমধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠানে আমানত রেখে সময়মতো অর্থ ফেরত পাচ্ছেন না গ্রাহক। শুধু গ্রাহকই নয়, ব্যাংক বা বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান টাকা রাখলেও তা যথাসময়ে তাদের ফেরত দিতে পারছে না অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান। আমানত না বাড়ায়, দায় পরিশোধেও স্থবিরতা তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমানতকারীরা কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ করেছেন। তারা বলছেন, সময়মতো আমানত ফেরত দিতে পারছে না তারা। ফলে নতুন করে অনেকে এসব প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখতে ভরসা পাচ্ছেন না। সাধারণ আমানতকারীদের পাশাপাশি বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক কিংবা আরেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানও এসব প্রতিষ্ঠানে আগের মতো আর টাকা রাখছে না। আবার নানা অনিয়মের মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণও সময়মতো ফেরত আসছে না। যে কারণে উচ্চ সুদের অফার করেও আশানুরূপ আমানত পাচ্ছে না আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো।’
বর্তমানে দেশে চারটি সরকারি ও ৩০টি বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ঋণের নামে প্রচুর অর্থ বের করার ঘটনা ঘটেছে। এ কারণে এ খাতের আর্থিক ভিত অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে।
২০১৯ সালে পিপলস লিজিং অবসায়নের উদ্যোগের পর এ খাতের অবস্থা বেশি খারাপ হয়েছে। এর কিছু দিনের মধ্যে আবার এনআরবি গ্লোবাল ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার (পি.কে) হালদারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দখল করে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের বিষয়টি সামনে আসে। এ ছাড়া ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও বিআইএফসিতে চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়েছেন আদালত। অত্যন্ত নাজুক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘রেড জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করে বিশেষ তদারকিতে রেখেছে।