খেলাপি ৪৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা

ফার্স্ট ফাইন্যান্সের লোকসান বাড়াল মাবিয়া গ্রুপ

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: জাহাজ ভাঙা ও ইস্পাত খাতের মাবিয়া গ্রুপের প্রধান ব্যবসা ছিল স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি, জাহাজ ভাঙা এবং ইস্পাত উৎপাদন। কিন্তু ব্যবসায়িক ব্যর্থতায় এটি ব্যাংক খাতে অন্যতম শীর্ষ ঋণখেলাপি গ্রুপগুলোর একটিতে পরিণত হয়। অন্যদিকে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ফার্স্ট ফাইন্যান্স লিমিটেড ২০১৭ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে লোকসানে আছে। এর মধ্যে লোকসানের বোঝা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে মাবিয়া গ্রুপ।

মাবিয়া গ্রুপের তিনটি জাহাজ ভাঙা ও ইস্পাত খাতের প্রতিষ্ঠানের কাছে ফার্স্ট ফাইন্যান্সের মোট খেলাপি পাওনা ৪৭ কোটি ৩০ লাখ ২১ হাজার টাকা। আর এ পাওনা আদায়ে অনেকবার চেষ্টা করা হলেও ব্যর্থ হতে হয় প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের।

ফার্স্ট ফাইন্যান্স লিমিটেড সূত্রে জানা যায়, ব্যবসার প্রয়োজনে ২০১৩ ও ২০১৪ সালের দিকে সীতাকুণ্ডের জাহানারবাদ এলাকার জাহাঙ্গীর আলম একাধিক প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নেন। তিনি মাবিয়া গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এ গ্রুপের ফাহিম স্টিল রি-রোলিং মিলস, মাবিয়া স্টিল কমপ্লেক্স এবং ব্রাদার্স ইস্পাত ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড প্রভৃতি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নামে ফার্স্ট ফাইন্যান্স লিমিটেড আগ্রাবাদ শাখা থেকে ঋণ সুবিধা গ্রহণ করে। এর মধ্যে ফাহিম স্টিল রি-রোলিং মিলসের নামে নেয়া ঋণ গত বছর ৩ আগস্ট খেলাপি হয়। প্রতিষ্ঠানটির কাছে ফার্স্ট ফাইন্স্যাসের সুদাসলে মোট খেলাপি পাওনার পরিমাণ হয় ১২ কোটি ৬৭ লাখ ২২ হাজার টাকা।

এ খেলাপি পাওনা আদায়ে প্রতিষ্ঠানটি সীতাকুণ্ড, খুলশী ও কুমিল্লায় মোট ১১৮ দশমিক ৯৬ শতক জমি নিলামে বিক্রির চেষ্টা করে। তাতে ব্যর্থ হয়ে গত ডিসেম্বরে অর্থঋণ আদালতে মামলা করে।

অপরদিকে চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারিতে মাবিয়া স্টিল কমপ্লেক্স এবং ব্রাদার্স ইস্পাত ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডও খেলাপিতে পরিণত হয়। এর মধ্যে মাবিয়া স্টিল কমপ্লেক্সের খেলাপি ১৩ কোটি ৪৭ লাখ ৮৮ হাজার টাকা এবং ব্রাদার্স ইস্পাত ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ২১ কোটি ১৫ লাখ ১১ হাজার টাকা। আর এই প্রতিষ্ঠানের খেলাপি পাওনা আদায়ে ঋণের বিপরীতে বন্ধক থাকা সীতাকুণ্ড ও কুমিল্লায় ২৬৩ শতাংশ জমি নিলামে বিক্রির উদ্যোগ গ্রহণ করেছে শাখা কর্তৃপক্ষ, যা আগামী ২১ মার্চ আগ্রাবাদ শাখায় অনুষ্ঠিত হবে।

এ বিষয়ে ফার্স্ট ফাইন্যান্স লিমিটেডের নামে প্রকাশে অনচ্ছিুক একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, ‘মাবিয়া গ্রুপের একাধিক প্রতিষ্ঠানের নামে নেয়া ঋণ এখন খেলাপি। এর মধ্যে মাবিয়া গ্রুপের ফাহিম স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেডের সুদাসলে ১২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা খেলাপি পাওনা আদায়ে নিলামে বিক্রির চেষ্টা করেছি, যদিও কিছু হয়নি। পরে অর্থঋণ আদালতে মামলা করা হয়। এছাড়া মাবিয়া স্টিল ও ব্রাদার্স ইস্পাতের নামে নেয়া ঋণও খেলাপি হয়ে পড়েছে। এগুলোর নামেও এনআই অ্যাক্টে মামলা চলমান আছে। আর পাওনা আদায়ে আমরা আইন অনুসারে কাজ করছি। তবে আমার মনে হয় তারা আমাদের ঋণ আবার নিয়মিত করবে। আগামী সোমবার কিছু পেমেন্ট দেবে বলেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘তাদের অনেক জমি ও সম্পদ আছে। কিছু কিছু জমি বিক্রি করলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ শোধ করতে পারবে। কিন্তু তারা তা করছে না। অথচ প্রয়োজনের জন্যই তো এসব সম্পদ কেনা হয়েছিল। এ সাধারণ কথা তারা কেন বোঝে না তা আমি বুঝি না।’

জানা যায়, ফার্স্ট ফাইন্যান্স লিমিটেড পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ২০০৩ সালে। প্রতিষ্ঠানটির অনুমোদিত মূলধন ৫০০ কোটি টাকা। আর পরিশোধিত মূলধন ১১৬ কোটি টাকা। ২০১৭ সাল থেকে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় ফার্স্ট ফাইন্যান্স লিমিটেড। সর্বশেষ প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরে প্রতিষ্ঠানটির নিট লোকসান হয় ৩৮ কোটি ২৩ লাখ টাকা, যা আগের বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ছিল ৩৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা। আর ২০১৮ সাল শেষে প্রতিষ্ঠানটির মোট লোকসানের পরিমাণ ৪০ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বরে এর লোকসানের পরিমাণ ছিল ৩০ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে মালিকানা বদল হয়ে পরিচালনায় আসেন সদ্যপ্রয়াত সংসদ সদস্য ইসরাফিল আলম।

সর্বশেষ ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন খাতে মোট ৮৭৪ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে বিতরণ করা হয়। এর মধ্যে বেশিরভাগ বিনিয়োগই খেলাপি ঋণে পরিণত হয়। এছাড়া জেড ক্যাটেগরির কোম্পানিটিতে উদ্যোক্তা পরিচালকদের শেয়ার ৪১ দশমিক ৩১ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ২৩ দশমিক ৯২ শতাংশ ও ৩৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মালিকানা রয়েছে। আর কোম্পানিটি সর্বশেষ ২০১৪ সালে পাঁচ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ দেয়।

সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সূত্রে সীতাকুণ্ডের জাহানারবাদ এলাকার মহরম আলীর তিন সন্তান জাহাঙ্গীর আলম, ফরিদুল আলম ও খোরশেদ আলমÑএ তিন সহোদর ২০০৮ সালের পর একে একে গড়ে তোলেন মেসার্স জিলানী ট্রেডার্স, ফাহিম স্টিল রি-রোলিং মিল, মাবিয়া স্টিল কমপ্লেক্স এবং ব্রাদার্স ইস্পাত ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, মাবিয়া শিপ ব্রেকার্স, মাবিয়া শিপ ব্রেকার্স ইউনিট-২, এফএমএস ইস্পাত শিপ ব্রেকিং, আলী স্টিল এন্টারপ্রাইজ এবং মেসার্স খাজা আজমীর করপোরেশন, যেগুলোর সমন্বয়ে গড়ে ওঠে মাবিয়া গ্রুপ। সময়ের সঙ্গে আস্তে আস্তে তারা ব্যবসার পরিধি বাড়াতে থাকেন। কিন্তু তাদের অদূরদর্শী প্রকল্প গ্রহণ, প্রাতিষ্ঠানিক অসক্ষমতা ও ব্যবসায়িক অনভিজ্ঞতা প্রভৃতি বিবেচনা না করে দি সিটি ব্যাংক, এবি ব্যাংক, মাকেন্টাইল ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা প্রায় ৮০০ কোটি টাকা দাঁড়ায়, যা এখন গলার কাঁটা হয়ে আছে সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য। ঋণের টাকা ফেরত পেতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো চেক প্রত্যাখ্যানের জন্য এনআই অ্যাক্ট ও অর্থঋণ আদালতে শতাধিক মামলা করে, যা চলমান আছে।

খেলাপি পাওনা পরিশোধের বিষয়ে জানতে মাবিয়া গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এছাড়া খুদেবার্তা পাঠানো হলেও উত্তর পাওয়া যায়নি। ফলে তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০