নাজমুল ইসলাম ফারুক : রক্ষক কখনও কখনও ভক্ষকের ভূমিকা পালন করে। একইভাবে প্রতিষ্ঠানপ্রধান কর্তৃক আমানতকারীর অর্থ আত্মসাতের নজিরও রয়েছে। তবে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) মাধ্যমে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের এফডিআর আত্মসাতের দুঃসাহস নজিরবিহীন। এ রকমই এক ঘটনা ঘটেছে ফিনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টে। প্রতিষ্ঠানটির এমডি এসএম ইন্তেখাব আলম ওই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের পাঁচ কোটি টাকার এফডিআর আত্মসাতের চেষ্টা করেছেন। আর এমন অভিযোগ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা দীন মোহাম্মদ। এ নিয়ে তোলপাড় ফিনিক্স ফাইন্যান্সে।
শেয়ার বিজের অনুসন্ধানে জানা গেছে, দীন মোহাম্মদ ফিনিক্স ফাইন্যান্সে বিভিন্ন সময়ে পাঁচ কোটি টাকার এফডিআর করেন। সম্প্রতি ব্যবসায়িক প্রয়োজনে তিনি এফডিআরগুলো নগদায়ন করার জন্য তার এমডিকে ফোন করেন। এমডির হাত দিয়ে এফডিআরগুলো করা হলেও তিনি তা অস্বীকার করেন। এ ঘটনার পর দীন মোহাম্মদ হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। তিনি তার নিজ হাতে নিয়োগ দেওয়া এমডির দুঃসাহস ও বিশ্বাসঘাতকতায় মুষড়ে পড়েন। অবশেষে তিনি এফডিআরের নথি খুঁজে পরের দিন আবারও ফোন করেন ইন্তেখাব আলমকে। পরদিন তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেন। এ ঘটনার পর দীন মোহাম্মদ তার ছেলে সিটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সোয়েবের সঙ্গে কথা বলেন। পাশাপাশি বোর্ডের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন। এ অমার্জনীয় ঘটনা তদন্ত করে এমডিকে সরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে সবাই সম্মত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, দীন মোহাম্মদের এফডিআর হাতিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টায় ইন্তেখাবকে সহযোগিতা করেছেন তারই অধস্তন তিন কর্মকর্তা। বৃদ্ধ দীন মোহাম্মদ এফডিআরের বিষয়টি ভুলে বসে আছেন এ রকম ধারণা করে তারা এ পরিকল্পনা আঁটেন। এ অর্থ ভাগাভাগিরও নীলনকশা করেন তারা। দীন মোহাম্মদের টাকা মেরে একটি মার্সিডিজ বেঞ্জ কেনার আগ্রহ দেখিয়েছিলেন ইন্তেখাব। মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ি কেনার বিষয়ে তিনি দীন মোহাম্মদের সঙ্গে আলোচনাও করেছিলেন বলে জানা গেছে।
এ সম্পর্কে ফিনিক্স ফাইন্যান্সের প্রতিষ্ঠাতা দীন মোহাম্মদ শেয়ার বিজকে বলেন, আমি সিটি ব্যাংক ও ফিনিক্স ফাইন্যান্সের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। পাশাপাশি এ দুটি প্রতিষ্ঠানের বর্তমান চেয়ারম্যানদের পিতা। আমার টাকা আমারই এমডি মেরে দেওয়ার চিন্তা করবে এটা আমার কল্পনারও বাইরে। ইন্তেখাব আমার বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে। সে কীভাবে এত বড় দুঃসাহস দেখাতে পারল?
তিনি আরও বলেন, যে ব্যক্তি প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের সঙ্গে এ ধরনের কর্মকাণ্ড করতে পারে, তার হাতে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান মোটেই নিরাপদ নয়। তার চলে যাওয়া এখন সময়ের ব্যাপার। প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য শিগগিরই একটি নিরপেক্ষ অডিট ফার্ম নিয়োগ করা হবে। এর মাধ্যমে ফিনিক্স ফাইন্যান্সের যাবতীয় হিসাব-নিকাশ তথা ব্যালান্স শিট নিরীক্ষা করা হবে। তারপর এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।
এ সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র দেবাশিস চক্রবর্ত্তী শেয়ার বিজকে বলেন, কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা যদি গ্রাহকের আমানত তসরুফ করার চেষ্টা করে তা হবে অসদাচরণ। আর এ অসদাচরণের জন্য আইন অনুযায়ী সাজা হতে পারে ওই কর্মকর্তার। বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানালে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানা গেছে, সাউথইস্ট ব্যাংকের মধ্যম সারির কর্মকর্তাকে ইন্তেখাব আলমকে ফিনিক্স ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক করে এনেছিলেন দীন মোহাম্মদ। কিন্তু এমন এক বিশ্বস্ত কর্মচারী তাকে পিঠে ছুরি মারবেন তা আশা করেননি তিনি। ইন্তেখাব প্রতিষ্ঠানটির এমডি হলেও চেয়ারম্যানের দুর্বলতা ও সরলতার সুযোগে মালিকের চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান বনে যান। এর ধারাবাহিকতায় ইন্তেখাব একটি প্রতিষ্ঠানের এমডি থাকা অবস্থায় অ্যাপোলো ইস্পাতসহ নানা প্রতিষ্ঠানে নগদ অর্থ লেনদেন করে উচ্চহারে মুনাফা হাতিয়ে নেয়, যা ব্যাংক কোম্পানি আইনের লঙ্ঘন। কোনো কোম্পানির এমডির দায়িত্ব পালন করে অন্য কোথায়ও বিনিয়োগের বিধান নেই বলে ব্যাংক কোম্পানি আইনে বলা হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এমডি ইন্তেখাব ব্যাংক কোম্পানি আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অ্যাপোলো ইস্পাতে নামে-বেনামে বিনিয়োগ করে আসছেন।
সাবেক চেয়ারম্যানের ৫ কোটি টাকার এফডিআর গায়েব করার প্রসঙ্গে এমডি এসএম ইন্তেখাব আলম শেয়ার বিজকে বলেন, এফডিআরের নথির খোঁজে পেয়েছি। বিষয়টি দ্রুত সুরাহা করা হবে। তিনি অ্যাপোলো ইস্পাতে ব্যবসা করার বিষয়টিও স্বীকার করেন। তিনি বলেন, এটি আমাদের প্রতিষ্ঠান, সুতরাং আমি বিনিয়োগ করতেই পারি। প্রতিষ্ঠানটিতে আমার নিজের বিনিয়োগ আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর অর্থনীতিবিদ খন্দকার ইব্রাহীম খালেদ শেয়ার বিজকে বলেন, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থেকে একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিনিয়োগ করার কোনো বিধান নেই। যদি বিনিয়োগ করতে হয় তাহলে ওই কোম্পানির পর্ষদের অনুমোদন নিতে হবে। যদি অনুমোদন না নিয়ে বিনিয়োগ করে তা হবে অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলার পরিপন্থী। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা নষ্ট হয়। সেক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
এফডিআর তসরুফ করার চেষ্টা করার বিষয়ে তিনি বলেন, যদি কেউ গ্রাহকের আমানত অস্বীকার করার চেষ্টা করে তাহলে তিনি আইন ভঙ্গ করল। বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানালে আইন অনুযায়ী তারা পদক্ষেপ নেবে।