Print Date & Time : 16 June 2025 Monday 3:16 pm

ফিলিস্তিনের ধ্বংসস্তূপের নিচে অবরুদ্ধ মানবতা

সুকান্ত দাস: পৃথিবীতে বারবার সাধারণ, মুক্তিকামী, শান্তিপ্রিয় মানুষের সুখ শান্তি কেড়ে নিয়েছে কোনো না কোনো সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী। নিদারুণ নির্যাতন এবং নিপীড়ন চালিয়েছে সাধারণ মানুষের ওপর। এ বিষয় আমরা দেখে আসছি সেই আদিমকাল থেকে। যখন রাজতন্ত্র চালু ছিল তখনও শান্তিপ্রিয় মানুষের ওপর লোভী রাজারা আক্রমণ করেছে। এখন আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায়ও একই ঘটনা ঘটছে। ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের শাসন, পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ আমাদের এই ভূখণ্ডের উদাহরণ মাত্র।
সর্বশেষ সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর তোষণের মাত্রাতিরিক্ত প্রতিফলন ঘটেছে ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলের চরম আগ্রাসনের ঘটনায়। গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনের নিরীহ জনগণের ওপর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে, ইসরায়েলের এবারের চলমান হামলায় এখন পর্যন্ত ৪২ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন এবং আহতের সংখ্যা লক্ষাধিক। ইসরায়েলি বাহিনীর এক বছরের অভিযানে গাজায় নিহতদের অধিকাংশই শিশু, নারী এবং বেসামরিক লোকজন।

প্রাচীনকাল থেকেই এই ভূমি নিয়ে সংঘাত চলছে। অ্যাসিরিয়ান, ব্যাবিলেনিয়ান, পার্সিয়ান, মেসিডোনিয়ান এবং রোমানরা সেখানে বহুবার সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে। ইসরায়েল ফিলিস্তিন সংঘাত নতুন কোনো ঘটনা নয়। এর আগে জেরুজালেম এবং পবিত্র আল আকসা মসজিদ নিয়ে খ্রিষ্টানদের সঙ্গে সংঘাত হয় আরবদের। ব্রিটিশ শাসনের শেষে সৃষ্ট বিভিন্ন দেশের মধ্যকার দ্বন্দ্বের মধ্যে এটা অন্যতম।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের ইহুদি নিধনযজ্ঞ শুরুর পর বেশিরভাগ ইহুদিরা সেখান থেকে পালিয়ে চলে আসে। যদিও এর আগে থেকেই দলে দলে ফিলিস্তিনে আসে ইহুদিরা। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তা তীব্র আকার ধারণ করে। ফিলিস্তিনে তখন একদিকে যেমন আরব এবং ইহুদি দ্বন্দ্ব শুরু হয়, অন্যদিকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘে এক ভোটাভুটির মাধ্যমে ফিলিস্তিনকে দুই ভাগে ভাগ করার কথা বলা হয় এবং জেরুজালেমকে আন্তর্জাতিক নগরী করার প্রস্তাব করা হয়। ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করে উদ্বাস্তু এবং আশ্রয় নেয়া ইহুদিদের দেয়া হয় ৫৭ শতাংশ ভূমি আর দেশীয় স্থানীয় জনগণকে দেয়া হয় মাত্র ৪৩ শতাংশ। জাতিসংঘ সমর্থিত এ ঘটনা দেখে মনে হয় যেন একই তরকারিতে এক জায়গায় ঝাল আর এক জায়গায় মিষ্টি। কিন্তু ইসরায়েল এ প্রস্তাব মেনে নিলেও ফিলিস্তিনের পক্ষে এটা মেনে নেয়া সম্ভব ছিল না। এর মধ্যে ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশরা ফিলিস্তিন থেকে চলে যায়। ইসরায়েল ফিলিস্তিন সংঘাত শুরু তখন থেকেই।

প্রথম সেই যুদ্ধে লাখো ফিলিস্তিনিদের তাদের ঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়। ফিলিস্তিনিরা এ ঘটনাকে ‘আল নাকবা’ বলে। সেই থেকে প্রতিবছর ১৫ মে ফিলিস্তিনিরা নাকবা দিবস পালন হিসেবে পালন করে আসছে। ফিলিস্তিনিদের ফেলে যাওয়া হাজার হাজার ঘরবাড়ি, দোকানপাট, কারখানা, কৃষিপণ্য, খাদ্যশস্য, গবাদিপশু, গাড়ি যেখানে যা পেয়েছে সবই লুট করেছে ইসরায়েল। ইসরায়েল ১৯৪৮ সাল থেকে ফিলিস্তিনিদের ওপর বিরামহীন নির্যাতন চালাচ্ছে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীর, সিরিয়ার গোলান মালভূমি, গাজা এবং মিসরের সিনাই অঞ্চল দখল করে নেয়।
মিত্রদেশগুলোর সাহায্য সহযোগিতা এবং আশকারায় এখন অপ্রতিরোধ্য ইসরায়েল। শক্তি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের ওপর বর্বরতা এবং নির্যাতনের তীব্রতাও বেড়েছে।

ইসরায়েল সেনা বারবার আল-আকসা মসজিদে নামাজরত মুসল্লিদের ওপর গুলি চালিয়েছে। ১৯৯০ সালের ৮ অক্টোবর ইসরায়েলের সেনাবাহিনী পবিত্র আল আকসা মসজিদে প্রবেশ করে নামাজরত মুসল্লিদের ওপর গুলি চালায়। এতে ২২ জন ফিলিস্তিনি শাহাদাতবরণ করেন এবং আহত হন আরও অনেকে। হামলা থেকে রক্ষা পায়নি গির্জাও। এমন ভয়াবহ অবস্থা যে ফিলিস্তিনিদের ঘুম ভাঙছে বোমা বিস্ফোরণের শব্দে।
এবারের সংঘাতে শিশুদের মৃত্যুর হার অনেক বেশি। আর এটা সব থেকে বড় মানবতাবিরোধী অপরাধ। ওইসব শিশুদের কী দোষ ছিল? প্রতিবারের ন্যায় এবারও মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর তেমন কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। তারা যদি ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষের পাশে না দাঁড়ায় তাহলে সাধারণ মানুষগুলোর দুর্দশা কারা দূর করবে? তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলেছেন। কিন্তু তা ওই কথা পর্যন্তই থেকেছে। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।

সব থেকে বেশি অবাক হতে হয় আরব দেশগুলোর বিভিন্ন পদক্ষেপ দেখে। তাদের মধ্যে কোনো একতা লক্ষ্য করা যায় না। যে তুরস্ক আজ সারাবিশ্বের মুসলমানদের একটা অন্যরকম আস্থার জায়গা হিসেবে পরিচিত তারাই কিন্তু ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়। মিসর, জর্ডানও স্বীকৃতি দিয়েছে। সৌদি আরবের সঙ্গে তো খুব ভালো সম্পর্ক ইসরায়েলের। যদিও মাঝে মধ্যে ভিন্ন সুর শোনা যায় কিন্তু ইসরায়েলের ব্যাপারে কঠোর কোনো সিদ্ধান্ত তারা নেয় না। এমন অবস্থায় যদি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো এক হয়ে ফিলিস্তিনের পাশে না দাঁড়ায় তাহলে তাদের কান্না থামানোর কেউ নেই। ইসরায়েলের এই আগ্রাসন ঠেকাতে সমগ্র আরব দেশগুলোকে একতাবদ্ধ হতে হবে। যদিও আপাতদৃষ্টিতে তা অনেকটাই অসম্ভব।
এসব দিক থেকে বাংলাদেশ ব্যতিক্রম। বাংলাদেশ এখনও ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়নি। ইসরায়েল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেও বাংলাদেশ তা গ্রহণ করেনি। সব সময় ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষের পাশে থেকেছে বাংলাদেশ।

ফিলিস্তিনের সাধারণ জনগণের প্রতি ইসরায়েলের সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানানো এবং বিশ্বে ফিলিস্তিনের পক্ষে জনমত গঠনের জন্য বর্তমান জাতিসংঘের মহাসচিবকে নিষিদ্ধ করেছে ইসরায়েল। যদিও পূর্বে ফিলিস্তিনের ব্যাপারে জাতিসংঘের ভূমিকা আহ্বান পাল্টা আহবানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত। এবার কিছুটা তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্রদের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অন্যতম। ২০১৩ সালে বিবিসি ২২টি দেশে একটি জরিপ চালিয়েছিল। সেখানে দেখা যায় পুরো পশ্চিমা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র হলো একমাত্র দেশ যেখানে জনমত ইসরায়েলের পক্ষে সহানুভূতিশীল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক সাহায্যও ইসরায়েল পায়। জাতিসংঘের পর বড় সংগঠন ৫৭টি দেশের জোট ওআইসিকে এ বিষয়ে কোনো কার্যকর ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি। ইসরায়েলি নিষ্ঠুরতা বন্ধে কোনো কার্যকর উদ্যোগ তো দূরের কথা, জোরালো কোনো শব্দও উচ্চারণ করছে না তারা। তাদের এই নিস্তব্ধতা ইসরায়েলের হিংস্রতা আরও উস্কে দিচ্ছে।

সংবাদমাধ্যমের কাজ প্রকৃত তথ্য মানুষের সামনে তুলে ধরা। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো প্রায়ই এটা করে আসছে। কিন্তু ফিলিস্তিন ইস্যুতে আন্তর্জাতিক এবং পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলোর একচোখা মনোভাব অনেকটাই পরিষ্কার। তাদের সংবাদ প্রচার বা বিভিন্ন সংবাদের শিরোনাম দেখলে মনে হয় ইসরায়েল নয় বরং ফিলিস্তিন সহিংসতা চালাচ্ছে। তাদের এই একচোখা মনোভাব ইসরায়েলকে নির্বিচারে ফিলিস্তিনের সাধারণ জনগণকে হত্যা করার পরোক্ষ সমর্থন দেয়া বললেও ভুল হবে না। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৮ থেকে ২০১৯ সাল এই এক বছরে ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্যাতনের যতগুলো ঘটনা রয়েছে তার মধ্যে ১৮২ ঘটনা মূল ধারার গণমাধ্যম চেপে গেছে। এর মধ্যে বিশ্বখ্যাত নিরপেক্ষ কিছু গণমাধ্যমও রয়েছে। যেখানে ইসরায়েলের মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন নিয়ে মিডিয়াগুলো বিশ্ব তোলপাড় করে দেবে, আমেরিকার প্রকাশ্য সমর্থন এই সন্ত্রাসবাদে তা ফলাও করে প্রকাশ করবে তা না করে তারাও ঘাতক ইসরায়েলের পক্ষে পরোক্ষভাবে কাজ করছে।

জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৬৭ সালে যখন ইসরায়েল পূর্ব জেরুজালেম, গাজা উপত্যকা ও পশ্চিম তীর দখল করে, তখন তারা আনুমানিক ১০ লাখ ফিলিস্তিনিকে বন্দি করে।
তখন প্রতি পাঁচজন ফিলিস্তিনির মধ্যে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ১ হাজার ৬০০টি সামরিক আদেশের আওতায় তাদের অভিযুক্ত করা হয়। এভাবে ইসরায়েলের দখল করা অংশে থাকা ফিলিস্তিনিদের জীবনের প্রতিটি বিষয় নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ফিলিস্তিনি পুরুষদের মধ্যে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে অন্তত দুজন ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। ইসরায়েলের ভেতরে ১৯টি কারাগার আছে এবং অধিকৃত পশ্চিম তীরে আছে আরেকটি কারাগার। যেখানে ফিলিস্তিনি বন্দিদের রাখা হয়েছে। (তথ্যসূত্র-ডেইলি স্টার বাংলা) ফিলিস্তিনে যেন মানবতা অবরুদ্ধ হয়ে আছে। মানবতাবিরোধী এত অপরাধ করার পরও ইসরায়েলের বিপক্ষে বিশ্ব মানবতাবাদী সংগঠনগুলোর কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ছে না। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো একপ্রকার মুখে কুলুপ এঁটে আছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো সংগঠনগুলোর দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। নির্বিচারে নারী-শিশু এবং সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন করা হচ্ছে। মানবতাকে রুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। অথচ তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই এদিকে। নাকি তাদের কার্যক্রম ফিলিস্তিন বাদে অন্য দেশগুলোতে? এটাও একটা বড় প্রশ্ন। অনেক ছোটখাটো বিষয় নিয়েও তারা বড় তাদের বড় বড় পদক্ষেপ ছিল এর আগে। কিন্তু ফিলিস্তিনে যখন বিশ্বমানবতার ধ্বংস করা হচ্ছে তখন তারা কোথায়? নিরপরাধ সাধারণ মানুষের ওপর এত নির্যাতন-নিপীড়ন ও তাদের পাশে কেউ দাঁড়াচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন ফিলিস্তিনের ধ্বংসস্তূপের নিচে মানবতা অবরুদ্ধ হয়ে আছে।

উল্লেখ্য, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায়। সেই হামলায় প্রায় ১ হাজার ২০০ মানুষ নিহত এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়েছিল। ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষের পাশে মূলত কেউ নেই। পশ্চিমা বিশ্ব, আরব দেশগুলো, মিডিয়া কেউ না। তাদের চোখের জল মুছার কেউ নেই। মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর উচিত এই পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়ানো। কারণ ইসরায়েলের পক্ষে সরাসরি কয়েকটি রাষ্ট্র থাকলেও ফিলিস্তিনের পক্ষে সেভাবে কেউ দাঁড়াচ্ছে না। ইসরায়েলের এই ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে সারাবিশ্বে জনমত গড়ে তুলতে হবে। আর এটা করতে হবে মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোকে। এভাবে চলতে পারে না। সাধারণ শান্তিকামী মানুষের ওপর এমন অত্যাচার কোনোভাবেই কাম্য নয়।

শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়