মেহেদী হাসান বিপ্লব: মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধভাবে থাকতেই মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আর এই সমাজবদ্ধভাবে থাকতে গেলে মানুষের মধ্যে নানা সংকট কিংবা সমস্যার সৃষ্টি হয়। আবার এই মানুষই সৃষ্ট সংকট কিংবা সমস্যার সমাধানে কাজ করে থাকে। একপর্যায়ে, এই মানুষই নির্দিষ্ট সংকটটির সমাধানও করে ফেলে। তো যারা যেকোনো সংকট মোকাবিলায় কাজ করে থাকে কিংবা সংকট নিরসনে সদা তৎপর থাকে, কীভাবে নির্দিষ্ট সংকট নিরসন করা যায়Ñএই নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকে, মানুষের অধিকার নিয়ে সোচ্চার থাকে, কিসে সব মানুষের মধ্যে শান্তিপূর্ণ স্থিতিশীলতা বজায় থাকে ইত্যাদি নিয়ে সমাজ, রাষ্ট্র অথবা বিশ্বে যাদের সর্বদা তৎপর দেখা যায়, তাদেরই মূলত মানবতাবাদী মানুষ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। আর এই মানবতাবাদী মানুষগুলো সব ক্ষেত্রেই জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার বিষয়ে অর্থাৎ সব সংকটে একই রকম সোচ্চার থাকবে; যা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বসবাসরত শান্তিপ্রিয় মানুষ কামনা করে।
কিন্তু এই মানবতাবাদী মানুষগুলো যখন একটি নির্দিষ্ট জাতি কিংবা ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে মানবতাবাদী স্বরূপ ত্যাগ করে মানবতাহীন আচরণ করে, তখন বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষদের কাছে তাদের মানবতাবাদী পরিচয়ের মূল্য কতটুকুইবা থাকে?
আজ তেমনি একটি রাষ্ট্রের বিষয়ে আলোচনা করব যেখানে মানবতাবাদী মানুষগুলো শুধু নিশ্চুপই নয়, বরং মানবতাহীন আচরণের বহিঃপ্রকাশও ঘটাচ্ছে। আর সেই রাষ্ট্রটি হলো ফিলিস্তিন। এখন চেঙ্গিস খান নেই, নেই হালাকু খান, নেই বর্বর, মানবতাহীন, রাষ্ট্রখেকো কোন শাসক। কেননা আমরা মানুষ হিসেবে সবাই পরিচয় দেয় যে, আমরা সভ্য। বর্তমানে আমরা সভ্য সমাজে বাস করি। যেখানে বর্বরতা, জুলুম, মানবতাহীন কর্মকাণ্ড ও সাম্রাজ্যবাদের কোনো স্থান নেই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমানে এই সভ্য সমাজে বসবাস করেও যদি প্রশ্ন করা হয়, মানবাধিকারের চরম বিপর্যয় কোথায় হচ্ছে? কোথায় এখন বর্বরতা, জুলুম চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে? কোথায় ভূমিখেকো প্রতিনিয়ত একটি ভূখণ্ডকে গ্রাস করছে? কোথায় একটি জাতিকে নির্মূল করতে প্রতিনিয়ত তৎপরতা চালানো হচ্ছে? কোথায় একটি স্বাধীন জাতিকে এখন পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হচ্ছে? কোথায় আজ মানব জীবন বিপন্ন?
সব শান্তিপ্রিয়, প্রকৃত মানবতাবাদী মানুষের থেকে এই সবগুলো প্রশ্নের কান্নাজড়িত উত্তর আসবে : ফিলিস্তিন, ফিলিস্তিন কেবল ফিলিস্তিন। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে কোনো শান্তিপ্রিয়, প্রকৃত মানবতাবাদী মানুষ ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া কিংবা চলমান কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করতে পারে না। অথচ হতাশার বিষয় হলো বিশ্বের মানবতার ফেরিওয়ালা, মানবতাবাদী লোকগুলো আজ চুপ। তারা ফিলিস্তিনে মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড দেখতে পাচ্ছে না। প্রশ্ন হলো কেন? আবার জাতিসংঘ আজ বড়ই অসহায়। তাহলে কেন জাতিসংঘ গঠন করা হলো? মেরুদণ্ডহীন জাতিসংঘ কীইবা কাজে লাগবে? এসব প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে শান্তিপ্রিয় মানুষের মাথায়। তবে কি বর্তমানে, এই সভ্য বিশ্বে অসভ্য, বর্বরতা, জুলুম, মানবতাহীন কর্মকাণ্ড চলতে থাকবে? তবে কি এই সভ্য বিশ্বে একটি জাতিকে প্রকাশ্যে শেষ করা হবে? তাদের ভূখণ্ড কেড়ে নেয়া হবে ? এটা কী ধরনের সভ্য বিশ্বের পরিচয়? যদি এটাই সভ্য বিশ্বের পরিচয় হয়, তবে এটা কখনও বন্ধ হবে না। বিশ্ববাসীকে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, আজ যদি তারা দখলদারিত্বকে, দাখলদারদের দ্বারা সৃষ্ট বর্বরতা, জুলুম, মানবতাহীন কর্মকাণ্ডকে সমর্থন যোগায়, তবে একদিন এটি পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আজ ফিলিস্তিন, কাল অন্য জায়গায়। এভাবে চলতেই থাকবে। তাই এখনই ফিলিস্তিন সংকট সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। এখনই মানবতার জলন্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করার উপযুক্ত সময়। ফিলিস্তিনিদের অধিকার নিশ্চিত করা এবং দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানই সংকট নিরসনের একমাত্র উপায়। সে দিকে বিশ্বনেতাদের গুরুত্ব দেয়া উচিত। আজ যদি ফিলিস্তিনিদের অধিকার নিশ্চিত করতে বিশ্ব নেতারা ব্যর্থ হয়, তবে এটি হবে দখলদারিত্বকে প্রোমোট করার শামিল, যা অন্যান্য শক্তিধর রাষ্ট্রকে দখলদারিত্বের প্রতি উৎসাহ জোগাবে। ফলে বিশ্বের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হবে। তখন আজকের নিশ্চুপ বিশ্ব নেতারা ও মানবতাবাদী মানুষগুলো নৈতিকভাবে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে না। তাই বিশ্বনেতাদের অবিলম্বে দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক ফিলিস্তিন সংকট সমাধান করার মধ্য দিয়ে দাখলদারিত্বকে না বলতে হবে। অথচ দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, পশ্চিমা দেশগুলো বরাবরই সেদিকে না গিয়ে নগ্নভাবে দখলদারিত্বকে সমর্থন করে। শুধু সমর্থনই না বরং তারা অস্ত্র দিয়ে, অর্থ দিয়ে এককথায় সমস্ত দিক থেকে দখলদার ইসরায়েলকে শক্তি জোগায়। যার ফলে উৎসাহিত হয়ে দখলদার ইসরায়েল তার দখলদারিত্বকে বজায় রাখার জন্য নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ওপর অমানবিক জুলুম- নির্যাতন, বর্বরতা চালায়। নির্বিচারে তাদের হত্যা করে, যা দখলদার ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত চলমান। কিন্তু যখনই ফিলিস্তিনিরা প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছে, তখনই দখলদার ইসরায়েল ও তার মিত্ররা সন্ত্রাসী বা জঙ্গি বলে আরও তীব্রভাবে তাদের ওপর আক্রমণ করেছে। যার ফলে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি মারা যায়। দুঃখের ব্যাপার হলো, বরাবরই মৃতদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধরাই থাকে বেশি। এরকম একটি অবস্থার আবার পুনরাবৃত্তি হয়েছে গত ৭ অক্টোবর থেকে। এখন পর্যন্ত মৃত্যু ৭ হাজার ছাড়িয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানিয়েছে, ইসরায়েল ৭ অক্টোবর গাজায় হামলা শুরু করার পর ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ এ উপত্যকার ৭ হাজার ২৮ জন নিহত হয়েছেন। এর প্রায় অর্ধেকই শিশু। ২৭ অক্টোবর বিকালে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আগের ২৪ ঘণ্টায় ৪৮১ জন নিহত হওয়ার তথ্য জানায়। (প্রথম আলো, ২৮ অক্টোবর)
এই সংখ্যার পাল্লা প্রতিনিয়ত ভারী হচ্ছে। এদিকে দখলদার ইসরায়েলের তরফ থেকে বলা হয়েছে, তারা ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় স্থল অভিযান চালাবে। ইতোমধ্যেই তারা সর্বাত্মকভাবে স্থল অভিযান চালানোর জন্য অগ্রসরমান। এটি যদি সংঘটিত হয় তাহলে প্রাণহানির সংখ্যা ভয়াবহ আকারে বাড়বে; যা কখনই মেনে নেয়ার মতো না। এরই মধ্যে গাজায় মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে বিদ্যুৎ নেই। জালানি নেই। পর্যাপ্ত খাবার নেই। পর্যাপ্ত ওষুধ নেই। চিকিৎসা সহায়তা দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত লোকবল নেই। এখন দখলদাররা গাজায় যে মানবতাকে পিষ্ঠ করছে, সেটা বিশ্ববাসীদের থেকে গোপন রাখতে ইন্টারনেট সুবিধাও বন্ধ করে দিয়েছে। এসব অমানবিক, বর্বর আচরণ এই সভ্য বিশ্বে যেকোনো বিবেকবান মানুষকে নাড়া দেয়।
তাই জাতিসংঘ ও বিশ্বনেতাদের ফিলিস্তিন সংকট সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। জরুরিভিত্তিক ফিলিস্তিনের গাজায় দখলদার ইসরায়েলের অমানবিক বিমান হামলা বন্ধ করতে হবে। স্থল অভিযান চালানো বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি অবরুদ্ধ গাজায় যাতে মানবিক সহায়তা যথাযথভাবে পৌঁছাতে পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা ও তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তাদের স্বাধীনভাবে বাঁচতে দিতে হবে। তারই ধারাবাহিকতাই দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান নিশ্চিত করতে হবে। আর এগুলো করতে যদি বিশ্বনেতারা ব্যর্থতার পরিচয় দেয়, জাতিসংঘ যদি ব্যর্থতার পরিচয় দেয়, তবে পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সংঘাত-যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। এতে অনেক প্রাণহানি ও ক্ষতি হবে। এমনকি এর ফলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধেরও সম্ভাবনা রয়েছে, যা কখনোই কাম্য নয়।
শিক্ষার্থী, দাওয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়