ফুটপাতের চা বিক্রেতা বাবার দুই কন্যার সাফল্য

রফিক মজিদ, শেরপুর: জেসমিন আর সাবিনা সহোদর দুই বোন। বড় বোন জেসমিন মওলানা ভাষানী বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নে তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন। ছোট বোন সাবিনা এবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গণসংযোগ ও সাংবাদিকতায় ভর্তি হয়েছেন। শুধু তাই নয়, সাবিনা এবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও গুচ্ছ পরীক্ষায়ও ভার্সিটিতে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। তাদের এ সাফল্যের পেছনে ছিল না পারিবারিক কোনো সাপোর্ট, ছিল না কোনো ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ছিল না প্রাইভেট টিউশন, ছিল না প্রয়োজনীয় বই-খাতা-কলম ইত্যাদি। এমন কি পেট ভরে তিন বেলা খাবারও জুটে না তাদের পরিবারের সদস্যদের।

জেসমিন-সাবিনার বাবা জিয়াউল হক একজন ফুটপাতের চা বিক্রেতা। শেরপুর জেলা শহরের অদূরে গাজিরখামার ইউনিয়নের গাজিরখামার বাজারের ভেতরে ফুটপাতের পাশে প্রতিদিন চা বিক্রি করে মাত্র ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আয় করে ৫ কন্যা ও এক পুত্রসন্তানসহ ৮ সদস্যের পরিবারের ঘানি টানতে হচ্ছে। মাত্র ২০০ থেকে ৩০০ টাকায় বর্তমান বাজারে ৮ জন মানুষের তিন বেলা পেটের ভাত জোগাড় করা কাল্পনিক মনে হলেও ঘটনাটি চরম সত্য। মাঝে মধ্যে ব্যবসা খারাপ হলে এক থেকে দেড়শ’ টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয় জিয়াউল হকের। যেখানে পেট পুরে তিন বেলা খাওয়া জোগাড় করাই কষ্ট, সেখানে ৬ সন্তানের পড়াশোনা চালানোর বিষয় তো বিস্ময়কর। তারপরও জিয়াউল হক প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যাচ্ছেন বেঁচে থাকার তাগিদে।

অন্যদিকে শিক্ষার উপকরণ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নানা খরচ এবং চাহিদামতো ব্যবহারের পোশাকসহ ন্যূনতম কোনো সহযোগিতা ছাড়াই ওই পরিবার থেকে দুই বোনের উচ্চশিক্ষায় উঠে এসে রীতিমতো অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছেন ওই দুই সহোদর।

টাঙ্গাইলের মওলানা ভাষানী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জেসমিন জানান, ‘গাজিরখামার বাজারের কাছেই বাবার পৈতৃক মাত্র ৩ শতক জমিতে একটি মাত্র ঘর তুলে গাদাগাদি করে ৬ ভাইবোন ও মা-বাবাকে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করে আসছি। এসএসসিতে জিপিএ ৫ এবং ২০২০ সালে এইচএসসিতে জিপিএ ৪.৯২ পেয়ে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন থাকলেও সেই স্বপ্ন ছুঁতে প্রথমে সাহস করেননি আর্থিক দৈন্যতার কারণে। তাই ভার্সিটির কোচিং তো দূরের কথা, ভর্তি পরীক্ষা দেয়ারও চিন্তা করেননি। জেলা সদরের কলেজে ভর্তির টাকা জোগাড়ের জন্য ওই গ্রামে স্থানীয় একটি স্কুলে পাটটাইম শিক্ষকতাও শুরু করেন। এমন সময় শেরপুরের একটি বেসরকারি শিক্ষা সহায়ক সংস্থা ‘দরিদ্র ও অসহায় শিক্ষার্থী উন্নয়ন সংস্থা’ (ডপস)-এর প্রতিষ্ঠাতা সেনা সদস্য মো. শাহিন মিয়া এগিয়ে আসেন। সে সময় আগস্ট মাসে সারাদেশের সব ভার্সিটির পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলেও কেবল  মওলানা ভাষানী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার সময় ছিল। জেসমিনের ভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষার কোনো প্রস্তুতিও নেই। তারপরও শাহিন মিয়া তার ভর্তি পরীক্ষার আবেদনের খরচ এবং একটি গাইড কিনে দেন পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়ার জন্য। পরীক্ষা হয় ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে। মাত্র ১৫-২০ দিনে ওই গাইড পড়ে প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দিয়ে মেধা তালিকায় ১১৭তম স্থান অধিকার করে রসায়নে ভর্তি হন। তবে ভর্তি হতে কপালে তার চিন্তার ভাঁজ পড়ে। ভর্তির প্রায় ২০ হাজার টাকা তার বাবার পক্ষে কোনোভাবেই জোগাড় করা সম্ভব নয়। সে সময় ওই শাহিন মিয়ার প্রচেষ্টায় এবং কিছু হƒদয়বান ব্যক্তির সহযোগিতায় তিনি ভর্তি হন। এর পরের বছর ২০২১ সালে প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় তিনি সিজিপি ৩.৮৪ পেয়ে দ্বিতীয় হন। এবারও তিনি দ্বিতীয় বর্ষে সিজিপি ৩.৭২ পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন। বর্তমানে জেসমিন টিউশনি করে তার খরচ চালালেও ছোট বোন সাবিনাকে নিয়ে এবার চিন্তায় পড়ে যান। সাবিনা এবার রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও গুচ্ছতে ভর্তির সুযোগ পেয়ে ‘ডপস’-এর সহযোগিতায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গণসংযোগ ও সাংবাদিকতায় ভর্তি হয়েছেন।

সাবিনার অন্য ছোট ভাইবোনরাও অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে পিছপা না হয়ে লেগে আছে শিক্ষা গ্রহণের পেছনে। সাবিনার ছোট বোন শারমিন এবার ৯ম শেণিতে, তার ছোট বোন নাসরিন জাহান ৭ম শেণিতে, তার ছোট ভাই নূরে আলম সিদ্দিক ৩য় শেণিতে স্থানীয় একটি মাদরাসায় এবং সবার ছোট বোন জান্নাতুল ফেরদৌস জিনিয়া প্রথম শ্রেণিতে স্থানীয় সৃজন পাবলিক স্কুলে পড়ছেন। স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের পারিবারিক ও মেধার বিষয়ে বিবেচনা করে স্কুলের সব খরচ ফ্রি করে দিয়েছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণসংযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে এবার ভর্তি হওয়া সাবিনা বলেন, ‘তাদের বাড়ি থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে অটোরিকশায় শহরের কলেজে এসে ক্লাস করতেন। এরপর প্রতিদিন ক্লাস শেষে তার পড়াশোনার খরচ সংগ্রহের জন্য প্রথমে তিনি নিজে শহরের বিভিন্ন বাসাবাড়িতে প্রাইভেট পড়াতেন এবং পরে তার নিজের কোচিং করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতেন। দুপুরে খিদে পেলে একটি-দুটি বিস্কুট বা শিঙাড়া-পুরি খেয়েই দিন পার করতেন।’

এ অবস্থায় জেসমিন-সাবিনার বাবা জিয়াউল হক হিমশিম খাচ্ছেন তার পরিবারকে নিয়ে। সম্প্রতি ডপস পরিবারের আয় বাড়াতে সুদবিহীন ঋণ দিয়ে দুটি গরু কিনে দেয়। কিন্তু ওই গরু থেকে আয় পেতে অনেক সময়ের ব্যাপার। তারপরও কিছুটা হলেও আশার আলো দেখছে জেসমিনের পরিবার। 

জেসমিন-সাবিনার বাবা জিয়াউল হক জানান, ‘আমি মূর্খ মানুষ। একসময় কাঠমিস্ত্রির কাজ করতাম। প্রায় এক যুগ ধরে এ বাজারে ফুটপাতের পাশে বসে চা-পান বিক্রি করেও দিন চালাতে পারি না। বিকাল ৩টার পর এখানে দোকান বসাই। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘরের কাজ, রিকশা চালানো আর মাঝে মধ্যে ক্ষেতকামলার কাজও করি। আল্লাহ তায়ালা আমার মেয়েদের মেধা দিলেও আমি তাদের জন্য কিছুই করতে পারিনি। তবে ডপস ও শাহিন মিয়াসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং স্কুলের শিক্ষকরাও তাদের পড়াশোনার সহযোগিতা করেছেন। খাতা-কলম, বইও ডপস দিয়ে যাচ্ছে। এখন জেসমিন ও সাবিনার জন্য খুব বেশি চিন্তা নেই। তবে অন্য ছেলেমেয়েকে নিয়ে পেটের ভাতই জোগাড় করা সম্ভব হয় না। সরকারি কোনো সহযোগিতা পেলে বাজারের প্রধান সড়কে একটি ঘর নিয়ে ব্যবসা করতে পারলে বাকি ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু করতে পারতাম।

এ বিষয়ে ‘ডপস’ প্রতিষ্ঠাতা শাহিন মিয়া জানান, পরিবারটির সব ছেলেমেয়ে খুবই মেধাবী। তাদের বাবার আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ বিধায় আমরা তাদের সহযোগিতা করে যাচ্ছি। তবে আমাদেরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০