ফেনীতে ভোরে চলে শ্রমিক বিকিকিনি

কামরুল হাসান নিরব, ফেনী: তখন ভোরের আলো সবে ফুটছে। ফেনীর ট্রাংক রোডের দোয়েল চত্বর থেকে খেজুর চত্বর পর্যন্ত কয়েকশ শ্রমিক রাস্তার দুপাশে কোদাল ও কাস্তে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। উদ্দেশ্য কিছুসংখ্যক ঠিকাদার এসে তাদের নিয়ে যাবেন। এরই নাম ফেনীর শ্রমের হাটবাজার। এমন এক শ্রমিক ইউসুফ আলি। তিনি নোয়াখালীর বাসিন্দা। কাজের সন্ধানে স্ত্রী-সন্তানসহ ফেনীতে থাকেন। তিন বছর ধরে নিয়মিত ফেনী শহরের ট্রাংক রোডে শ্রমের হাটে আসেন।

মেরাজ আলী নামের এক শ্রমিক বলেন, ছয় বছর ধরে এই হাটে তারা শ্রম বিক্রির জন্য আসেন। কৃষিজমি পরিষ্কার, মাটি কাটা, নতুন সড়ক নির্মাণ, পরিত্যক্ত দালান, ব্রিজ ও কালভার্ট ভাঙা, ধান রোপণ, আলু, ভুট্টা, তরমুজ লাগানোসহ চুক্তিতে সব ধরনের কৃষিকাজ করেন। ছয় থেকে আট মাস চলে তাদের কাজ। যে টাকা আনা হয়, সেটা নিয়ে বাসাভাড়া ও সারাবছর সংসার চালান তারা। আলির মতো এমন ২০০ থেকে ৩০০ নারী ও পুরুষ শ্রমিক এখানে আসেন কাজের সন্ধানে। তাদের কারও বাড়ি উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও নোয়াখালীতে। নরসিংদী, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর ও রামগতির শ্রমিকদেরও পাওয়া যায় এখানে।

গত শনিবার সকালে জিরো পয়েন্ট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, শহরের দোয়েল চত্বর থেকে খেজুর চত্বর জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত সড়কের দুপাশে অন্তত ৩০০ থেকে ৪০০ শ্রমিক কাজের সন্ধানে বসে আছেন। এ সময় কাউকে কেউ সারিবদ্ধভাবে বসে আবার কাউকে এলোমেলোভাবে বসেও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।

স্থানীয় দালালরা এসব শ্রমিকের মধ্য থেকে দরদাম করে বিভিন্ন কাজের জন্য শ্রমিক নিয়ে যাচ্ছেন। আবার অনেক শ্রমিক দিন-চুক্তিতে কাক্সিক্ষত মূল্যে কাজ করতে দর কষাকষি করছেন। জেলার সোনাগাজী উপজেলার চর চান্দিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ চর চান্দিয়া গ্রাম থেকে শ্রমিক নিতে এসেছেন দালাল মোশাররফ মিলন। তিনি বলেন, ভুট্টার জমিতে বিভিন্ন কাজ করার জন্য ১০০ থেকে ১২০ শ্রমিক দরকার। একসঙ্গে এত শ্রমিক শুধু এই হাটেই পাওয়া যায়। দিনপ্রতি ৬০০-৭০০ টাকা পারিশ্রমিকে একেকজন শ্রমিক পাওয়া যায়। তাই তিন বছর ধরে ২৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এই হাটে এসে শ্রমিক নিয়ে যান তিনি। একসঙ্গে অনেক শ্রমিক পাওয়ার জন্য এই হাটের ওপর ভরসা করেন ফেনীর গৃহস্থরা। স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, প্রবাসী অধ্যুষিত জেলা ফেনীর প্রতিটি উপজেলায় বিভিন্ন কাজের জন্য প্রতিনিয়ত প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। এছাড়া ফেনীতে প্রতিবছর কয়েক হাজার হেক্টর জমিতে আলু, ভুট্টা, সূর্যমুখী, সরষেসহ বিভিন্ন ধরনের ফসলের আবাদ হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সরষে ও ভুট্টার আবাদ হয়ে থাকে। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আবাদ ও ফসল তুলতে হয়, সেজন্য অনেক শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। তবে ফেনীতে চাহিদার তুলনায় শ্রমিকের সংখ্যা অনেক কম বলে জানান গৃহস্থরা।

স্থানীয় লোকজন জানান, বছর দশেক আগে উত্তরাঞ্চলের শ্রমিকেরা শ্রম বিক্রির জন্য এদিকে আসতে শুরু করেন। প্রথম দিকে অল্প কিছুসংখ্যক শ্রমিক এখানে আসতেন। পরে এই সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১০ বছর আগের চেয়ে এই সংখ্যা বেড়ে এখন দুই থেকে তিন হাজার হয়ে গেছে। এখন ৫০০ থেকে ৭০০ শ্রমিক প্রতিদিন এখানে শ্রম বিক্রি করতে আসেন।

কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিবছর অক্টোবর থেকে পরবর্তী বছরের মে মাস পর্যন্ত তাদের কাজের চাহিদা থাকে। এ সময় তারা জেলা শহরের বিভিন্ন স্থানে কম দামে অনেকে মিলে একসঙ্গে বাসা ভাড়া করেন। আবার কেউ কেউ আশপাশের বসতি, স্কুলের বারান্দা ও রেললাইনের পাশে অস্থায়ী বসতি করে থাকেন। কাজ শেষ করে অনেকে ফেনী থেকে নিজ এলাকায় ফিরে যান। কেউ কেউ আবার নিজেকে অন্য কাজে লাগিয়ে এখান থেকে চলে যান।

রংপুরের পীরগঞ্জের বাসিন্দা এক নারী শ্রমিক হাসিনাতুন্নেছা বলেন, সবকিছুর দাম বেশি। পেটের দায়ে কাজ করতে ফেনীতে আসেছেন। এখানেও কাজের চাহিদা কমে গেছে। গত বছর দিনভিত্তিক ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা মজুরি পেলেও এবার ৪০০ টাকার বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। কাজ সমান হলেও পুরুষের চেয়ে নারীদের মজুরি কম দেয়া হয়। গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর এলাকার সফিক মিয়া স্ত্রী, দুই ছেলেসহ ফেনীতে কাজের সন্ধানে এসেছেন।

তিনি বলেন, প্রতিদিন ভোরের আলো ফোটার আগে তারা শ্রম বিক্রির হাটে এসে বসে থাকেন।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০