রহমত রহমান: অর্থ ফেরতের একটি আবেদন নিষ্পত্তিতে সময় লাগে এক সপ্তাহ। কখনও কখনও আরও বেশি সময় লেগে যায়। স্থানীয় ও বৈদেশিক অংশীজনদের সেই আবেদন এক দিন বা এক ঘণ্টায় নিষ্পত্তি করতে আসছে ‘ডেডোপে’ অ্যাপ। শুল্ক রেয়াত ও প্রত্যর্পণ পরিদপ্তর (ডেডো) এই অ্যাপ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ১৯৮৭ সালে ডেডো প্রতিষ্ঠার পর প্রথমবারের মতো একটি আধুনিক ও ডায়নামিক ওয়েবসাইট চালু করা হয়েছে।
ডেডোর কর্মকর্তারা বলছেন, ‘ডেডোপে’ অংশীজনদের ফেরত দাবি অনলাইনে নির্ভুল ও দ্রুত নিষ্পত্তির একটি প্লাটফর্ম। এই অ্যাপ ডেডোর ওয়েবসাইট থেকে সরাসরি সংযুক্তিযোগ্য হবে। আবেদনকারীর আবেদনের প্রকৃতি ও ধরন বিশ্লেষণ করে অনলাইনের আবেদনের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ও সঙ্গতিপূর্ণ তথ্য এবং সেবাদানই হবে এর অন্যতম উদ্দেশ্য। স্থানীয় ও বৈদেশিক অংশীজনদের প্রদেয় অর্থ ফেরত দেয়ার প্রক্রিয়া এই অ্যাপের মাধ্যমে সহজে দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ডেডো এ অ্যাপস তৈরির পরিকল্পনা করেছে। গতানুগতিক প্রক্রিয়ায় প্রদত্ত আবেদনে যেখানে সপ্তাহের বেশি লাগে, সেখানে মাত্র এক দিনে বা এক ঘণ্টায় নিষ্পত্তি করা যাবে।
৩১ মার্চ এনবিআর সম্মেলন কক্ষে ডেডোর নতুন ওয়েবসাইট উদ্বোধন করেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। চেয়ারম্যান বলেন, অনলাইনে ভ্যাট পরিশোধ হয়েছে কি না অনলাইনে ইএফডিএমএসসহ অন্যান্য করদাতার আইভাসের মাধ্যমে যাচাইয়ের সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। ভবিষ্যতে রাজস্ব সেবার সব কার্যক্রম অনলাইনে সম্পন্ন করতে হবে। প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে মাঠের অন্য দপ্তরগুলোকে ডেডোর মতো এগিয়ে আসতে হবে।
সভায় ডেডো ওয়েবসাইট ও প্রস্তাবিত অনলাইন রিফান্ড অ্যাপ ডেডোপে সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেন মহাপরিচালক মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন চৌধুরী। পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপনায় যুগ্ম পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম ওয়েবসাইট ও পরিকল্পনাধীন ডেডোপের বিভিন্ন সম্ভাব্য ব্যবহারিক দিক উপস্থাপন করেন।
সভায় মহাপরিচালক বলেন, বিদেশি সংস্থাগুলো তাদের রিফান্ড আবেদনগুলো অনলাইনে দাখিল করার সুযোগ তৈরির লিখিত অনুরোধ করে আসছেন। ৮ মার্চ ডেডোতে অনুষ্ঠিত এক সভায় জাতিসংঘের দশটি বিশেষায়িত সংস্থার প্রতিনিধিরা ডেডোর ওয়েবসাইট চালু ও অনলাইনে রিফান্ড আবেদন দাখিল ও দাবি নিষ্পত্তির অনুরোধ জানান। ১৯৮৭ সালে ডেডো প্রতিষ্ঠার পর ওয়েবসাইট চালু হচ্ছে। তিনি বলেন, ডেডোর ওয়েবসাইট চালুর মধ্য দিয়ে ডেডোর অংশীজন বিশেষ করে বিদেশি সংস্থাগুলোর দীর্ঘদিনের চাহিদা পূরণ করল এনবিআর এবং ডেডোতে কর্মরত সব পর্যায়ের কর্মকর্তার কর্মভার লাঘব হবে। এনবিআরের অনুমোদন প্রাপ্তির পর ডেডোপে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করবে।
অন্যদিকে, অ্যাপের ব্যবহার সম্পর্কে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অ্যাপের সুবিধাগ্রহণকারী প্রত্যেকের নিজস্ব পরিচিতি নম্বর (ইউনিক আইডি) থাকবে। আবেদন পেশের পর নির্ধারিত ই-মেইল বা মোবাইল ফোনে একটি ওটিপি যাবে। একজন দেশি-বিদেশী আবেদনকারী ডেডোতে আবেদন দাখিল হতে নিষ্পত্তি পর্যন্ত তার আবেদনের হালনাগাদ অবস্থা ট্র্যাকিং নম্বর দিয়ে জানতে পারবেন। আবেদনকারীর আবেদনটি গৃহীত, আংশিক, অসম্পূর্ণ, প্রমাণের অপ্রতুলতা প্রযোজ্য বিষয়ে তাৎক্ষণিক ই-মেইলে জানতে পারবেন। বিদেশি সংস্থার আবেদনকারীদের পাশাপাশি একই অ্যাপ দপ্তরের কর্মকর্তাদেরও কার্যনিষ্পত্তিতে ব্যবহারে সুযোগ থাকবে। দপ্তরের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ক্লেম ভাউচার প্রণয়ন, অনলাইনে ভ্যাট চালান যাচাই, অটোমেটেড নোট শিট তৈরি, রিফান্ড সংক্রান্ত তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। ফলে সপ্তাহের কাজ ঘণ্টায় শেষ করা সম্ভব হবে।
কর্মকর্তারা আরও জানান, ৬ মাস বা ১৮০ দিনের মধ্যে আবেদনের বাধ্যবাধকতা এ অ্যাপের মাধ্যমে নির্ণয় করা যাবে। ফলে মেয়াদোত্তীর্ণ দাবির জন্য আবেদনের সুযোগ থাকবে না। প্রদত্ত ইনপুট থেকে সরকারি নথির জন্য স্বয়ংক্রিয় নোটশিট প্রস্তুত হওয়া, এই অ্যাপটির অন্যতম আকর্ষক দিক হিসেবে তৈরি করা হবে। এ অ্যাপের মাধ্যমে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ থাকবে। এ প্রযুক্তির মাধ্যমে সহজে রিফান্ড আবেদনের সঙ্গে সম্পর্কিত সব দলিল ক্রুটিমুক্তভাবে বাছাই করা সম্ভব হবে। ফলে আগে একটি নথি নিষ্পত্তি করতে যেখানে এক সপ্তাহ থেকে মাস, বছর সময় লেগে যেত; সেখানে এই অ্যাপ ও প্রযুক্তিতে উভয় পক্ষের ট্র্যাকিং ও মনিটর থাকবে এবং দ্রুত নিষ্পত্তি হবে।
ডেডোর কর্মকর্তারা জানান, নতুন মহাপরিচালক যোগদানের পর মাত্র দুই মাসে বিদেশি সংস্থার অনিষ্পন্ন ২৬ হাজার দাবি নিষ্পত্তিতে ডেডোর উদ্যোগ সম্প্রতি দেশি-বিদেশিদের কাছে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। স্বল্পতম সময়ে ওয়েবসাইট নির্মাণ উদ্বোধন ও ডেডোপের মতো একটি নিপুণ ও দক্ষ উদ্ভাবনে ডেডোর সক্ষমতা দৃশ্যমান হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ডেডোর মহাপরিচালক মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন চৌধুরী বলেন, ভবিষ্যতে একটি সুশৃঙ্খল ও সুসংহত ডেডো গঠনে কিছু পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছেÑবিদেশি অংশীজনের কাছে কাস্টমসের ভাবমূর্তি রক্ষায় অনলাইনে ফেরত দাবির অ্যাপ তৈরিসহ অফিস মানসম্মত ভবনে স্থানান্তরের উদ্যোগ, সহগ কার্যক্রমে দ্রুত সম্পন্নের জন্য নিবিড় দল গঠন ও দুই দিনের মধ্যে সহগ দানের লক্ষ্যে দল গঠন, অ্যাপের মাধ্যমে এক দিনের মধ্যে দূতাবাস ও বিদেশি মিশনের নথি নিষ্পত্তির উদ্যোগ, নতুন উদ্ভাবিত অ্যাপ ব্যবহারে কর্মকর্তা ও অংশীজনের বিশেষ প্রশিক্ষণ, ডেডোর রিফান্ড পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া বিষয়ে কাস্টমস একাডেমিতে প্রশিক্ষণের জন্য পূর্ণাঙ্গ প্রশিক্ষণ মডিউল প্রস্তুত, ডেডোকে পরিদপ্তর থেকে অধিদপ্তরে রূপান্তরের উদ্যোগ।
ডেডোর তথ্যমতে, দেশের রপ্তানি শিল্পকে উৎসাহ দেয়ার লক্ষ্যে ১৯৮৭ সালে এনবিআরের অধীন ডেডো প্রতিষ্ঠিত হয়। ডেডো বর্তমানে দেশে কর্মরত জাতিসংঘ ও বিশেষায়িত বিদেশি সংস্থা, কূটনৈতিক মিশন ও দূতাবাসসহ প্রায় ৪৮টি সংস্থার ভ্যাট ফেরত আবেদন নিষ্পত্তি করে। এছাড়া শুল্ক ও ভ্যাট রিফান্ড, সহগ নির্ধারণ, প্রকৃত ও সমহার নির্ধারণ ও চেক ইস্যু প্রভৃতি নিয়েও ডেডো কাজ করে।