মানসিক স্বাস্থ্য নির্ভর করে আবেগ ও মনস্তাত্ত্বিক সুস্থতার ওপর। একজন ব্যক্তি কীভাবে চিন্তা করবে, কাজ করবে, তার অনুভূতিগুলো কেমন হবে, কীভাবে সে বিপর্যস্ত পরিস্থিতির পাশাপাশি হতাশা ও উদ্বেগ সামলাবে তার সবই মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং সঠিক শিক্ষার অভাবে আমরা প্রায়ই মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি উপেক্ষা করি। ভুলে যাই মানসিক ব্যাধি ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে পারে।
আন্তর্জাতিক উদরাময় কেন্দ্রের (আইসিডিডিআর,বি) অ্যাসিস্ট্যান্ট সায়েন্টিস্ট কামরুন নাহার কলি গবেষণায় দেখেছেন, সমাজের পারিপার্শ্বিকতায় মানসিক স্বাস্থ্যকে উপেক্ষা করার বিষয়টি। তিনি বিষয়টি বেশ উপলব্ধি করেন। বিশেষ করে যেসব নারী মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, তারা জানে না কোথায় ও কখন সাহায্য নিতে হবে। এসব বিষয় মাথায় রেখে কামরুন একজন পাবলিক হেলথ রিসার্চার হিসেবে আইসিডিডিআর,বিতে যোগ দেন, যাতে তিনি মানসিক স্বাস্থ্যের নানা দিক নিয়ে কাজ করতে পারেন। এভাবে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ২০১৮ সালে ‘উইমেন সাপোর্ট ইনিশিয়েটিভ ফোরাম’ (ডব্লিউএসআইএফ) গঠন করেন, যা ফেসবুকে নারীদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করে। পাশাপাশি নানা ধরনের মানসিক সমস্যা মোকাবিলা করতে করণীয় ও পিয়ার সাপোর্ট দেয়।
কামরুন নাহার বলেন, আমি ডাব্লিউএসআইএফ গঠন করার সময় বুঝতে পারি, সমাজের জন্য বিশেষ করে নারীদের জন্য কিছু করার সুযোগ আছে। অনেক মানুষের কাছে অল্প সময়ে সহজে পৌঁছানোর জন্য ফেসবুকের চেয়ে ভালো কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের নারীরা যদিও তাদের দৈনন্দিন গৃহস্থালির কাজ, কর্মক্ষেত্র ও পরিবারের দেখাশোনা করতে বেশ ব্যস্ত সময় পার করেন, তবু তারা ফেসবুকে সক্রিয়।
কামরুন ফেসবুকে দুটি কমিউনিটি তৈরি করেন। এর একটি ক্লোজড গ্রুপ যার নাম ‘উইমেন ফর ইচ আদার’। এখানে নারীরা একজন অন্যকে তাদের জীবনের নানা সমস্যার সঙ্গে মানসিক সমস্যা সমাধানের উপায় বাতলে দেন। এখানে তারা নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন, যাতে অন্যরা তা থেকে শিক্ষালাভ করতে পারেন। যেসব পোস্টে ব্যক্তিগত সমস্যার কথা উল্লেখ থাকে, সেসব পোস্টের উত্তরে পিয়ার দিয়ে থাকেন। এগুলো মডারেটররা নিরীক্ষণ করেন। এ মডারেটররা পেশায় ডাক্তার। তারা পোস্ট দেখে শুরুতেই বুঝতে পারেন যে কাদের সাহায্য দরকার। পরে তারা অন্য ডাক্তারদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। কামরুন প্রায় ৩০ স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে সরাসরি কাজ করেন, যাদের তিনি বলেন, সাইকোলজিক্যাল সাপোর্টার্স (পিএসএস)। যেসব নারীর সমস্যা ব্যক্তিগত, পিএসএস তাদের সঙ্গে মেসেঞ্জারে কথা বলে সমাধানের চেষ্টা করেন। আরও মারাত্মক সমস্যার জন্য পিএসএস সক্রিয়ভাবে তাদের নেটওয়ার্কে থাকা বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের সঙ্গে নারীদের যোগাযোগ করিয়ে দেয়। এ সবকিছুই করা হয় বিনা খরচে।
কামরুনের অন্য পেজটির নাম উইমেন সাপোর্ট ইনিশিয়েটিভ ফোরাম (ডব্লিউএসআইএফ), যা বাংলাদেশীদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা তৈরিতে কাজ করে। পেজটি নানা ধরনের মোটিভেশনাল ও ইনফরমেটিভ পোস্টের মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করে এবং কখন সাহায্য চাইতে হবে তা বুঝতে সহায়তা করে।
মাত্র দুই বছরের মধ্যে দুটি কমিউনিটির সদস্যসংখ্যা ২৭ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। বেড়েই চলেছে এর সদস্য। তবে কামরুন এখানেই থামতে চান না। তিনি হতাশা ও রাগ নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে মানসিক চাপ ও উদ্বেগ প্রভৃতি নিয়ে আরও গভীর নিরীক্ষার জন্য মনোবিজ্ঞানী ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সাহায্যে নিয়মিত গ্রুপ ওয়র্কশপের আয়োজন করেন। বিশেষজ্ঞরা সব বিষয়ের সমাধানগুলো পুনর্নিরীক্ষা করে ফিডব্যাক দেন। এ ওয়ার্কশপগুলো ফেসবুকে লাইভও করা হয়, যাতে সদস্যরা সশরীরে অংশ না নিয়েও সুবিধাজনক স্থানে থেকে তা দেখতে ও শুনতে পারেন। এখন পর্যন্ত ২২টি ওয়ার্কশপে দুই হাজার মানুষ অংশ নিয়েছেন।
কামরুন নাহার বলেন, আমাদের সবাইকে ডব্লিউএসআইএফের ফেসবুক কমিউনিটিতে যোগ দিতে আহ্বান করা উচিত, যাতে সবাই বুঝতে পারে মানসিক সুস্থতা কেমন হওয়া উচিত। কেউ কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে যাতে তাড়াতাড়ি চিকিৎসা নিতে পারে, সে বিষয়ে সচেতন হওয়া উচিত। মানসিক সমস্যা ও এর সমাধান নিয়ে বাংলাদেশে প্রথাগত যে ধারণা রয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসার সময় এখন।
রাহুল সরকার