ফোরজি চালুতে দক্ষিণ এশিয়ায় পিছিয়ে বাংলাদেশ  

 

থ্রিজি প্রযুক্তি চালু হয়েছে প্রায় পাঁচ বছর। যদিও এর সুফল খুব বেশি মেলেনি। এরই মধ্যে ফোরজি চালুর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। থ্রিজি প্রযুক্তির হালচাল ও ফোরজির প্রস্তুতি নিয়ে শেয়ার বিজের ধারাবাহিক আয়োজন। আজ ছাপা হচ্ছে তৃতীয় পর্ব

আহমেদ সাঈফ মুনতাসীর হামিদুর রহমান : চতুর্থ প্রজন্মের মোবাইল সেবা (ফোরজি) বা লং টার্ম ইভলিউশন (এলটিই) প্রযুক্তি বিশ্বে বাণিজ্যিকভাবে চালুর আট বছর পেরিয়ে গেছে। তবে এখনও বাংলাদেশে চালু হয়নি ফোরজি সেবা। যদিও ডিসেম্বরে সেবাটি চালুর ঘোষণা দিয়েছে সরকার। তবে এ প্রক্রিয়ায় দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের চেয়ে পিছিয়ে গেছে বাংলাদেশ।

সূত্রমতে, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা এমনকি আফগানিস্তানসহ বর্তমানে বিশ্বে ৮০টি দেশে ফোরজি সেবা চালু থাকলেও বাংলাদেশ এক্ষেত্রে বেশ পিছিয়ে। এক্ষেত্রে নেই পর্যাপ্ত প্রস্তুতিও। এমনিতেই থ্রিজি বিনিয়োগে লাভবান হতে পারেনি অপারেটরগুলো, এ অবস্থায় ফোরজির বাণিজ্যিক সফলতা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে তারা।

লন্ডনভিত্তিক টেলিযোগাযোগ গবেষণা সংস্থা ওপেন সিগন্যালের তথ্যমতে, প্রযুক্তির ধারাবাহিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বেশ পিছিয়ে বাংলাদেশে। ২০১২ সালে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে ফোরজি সেবা চালু করে ভারত। এরপর ২০১৩ সালে শ্রীলংকা, ২০১৪ সালে পাকিস্তান ও সর্বশেষ ২০১৭ সালের জুনে আফগানিস্তানে ফোরজি প্রযুক্তি চালু করা হয়। বিশ্বের ৮০তম দেশ হিসেবে আফগানিস্তান গত জুনে এ প্রযুক্তি চালু করে। কিন্তু প্রযুক্তিগত অদক্ষতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে বাংলাদেশে এখনও ফোরজি প্রযুক্তি চালু করা হয়নি।

সংস্থাটির গবেষণা রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ফোরজি সেবা প্রদানকারী দেশ দক্ষিণ কোরিয়া। দেশটির ৯৫ দশমিক ৭১ ভাগ এলাকা ফোরজি নেটওয়ার্কের আওতাধীন। আর দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারতের ৭১ দশমিক ছয় শতাংশ, পাকিস্তানের ৫২ দশমিক ৭১ শতাংশ ও শ্রীলংকায় ৪০ দশমিক ২৭ শতাংশ এলাকা এ নেটওয়ার্কের আওতাধীন। তবে গড়গতির দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় এগিয়ে রয়েছে শ্রীলংকা। ফোরজি নেটওয়ার্কে তাদের গড়গতি ১৭ দশমিক চার এমবিপিএস, এরপর অবস্থান পাকিস্তানের। পাকিস্তানে ১০ দশমিক ৭৭ ও ভারতে ছয় দশমিক ৩৯ এমবিপিএস নিয়ে পিছিয়ে আছে।

জানা যায়, ফোরজি-সংক্রান্ত বিটিআরসির খসড়া নীতিমালায় ফোরজি লাইসেন্সের ব্যাংক গ্যারান্টি হিসেবে ১৫০ কোটি টাকা জমা দেওয়ার শর্ত রয়েছে। যার মধ্যে বিটিআরসি নির্ধারিত সময়ে ফোরজি নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের সময়সীমার পূরণের নিশ্চয়তা হিসেবে ৭৫ কোটি টাকা ও ভবিষ্যতের বকেয়া পরিশোধের নিশ্চয়তা

হিসেবে জমা দিতে হবে আরও ৭৫ কোটি টাকা এবং লাইসেন্স গ্রহণের জন্য অপারেটরকে পুঁজি বাজারে নিবন্ধিত হওয়ার শর্ত জুড়ে দিয়েছে বিটিআরসি। কিন্তু এ শর্তানুযায়ী গ্রামীণফোন ছাড়া অন্য অপারেটরগুলো পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত না হওয়ায় গ্রামীণফোন ছাড়া অন্যান্য অপারেটরদের ফোরজি লাইসেন্স পাওয়ার সুযোগ নেই। এর আগে থ্রিজি তরঙ্গ বরাদ্দের সময় প্রতি মেগাহার্টজ ২১০০ ব্যান্ডের জন্য দুই কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার সরকারকে দিতে হয়েছে অপারেটরগুলোর। তাই ২৬০০ ব্যান্ডের ফোরজি বা এলটিই লাইসেন্স ও তরঙ্গ বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে উচ্চ ফির ব্যাপারটি বিবেচনার কথা বলছে কোম্পানিগুলো।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফোরজি সেবার জন্য চালু করার আগে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মোবাইল হ্যান্ডসেটগুলোতে ফোরজি প্রযুক্তি সাপোর্ট করার বিষয়টি। যদি গ্রাহকের হ্যান্ডসেটটি স্মার্টফোনও হয় কিন্তু সেটা ফোরজি সাপোর্ট না করে তাহলে হ্যান্ডসেট না থাকলে ব্যবহারকারীরা এ সেবা পাবেন না। বর্তমানে বাংলাদেশে থ্রিজি সেবা গ্রহণের জন্য মাত্র ৩০ শতাংশ ডিভাইসের সক্ষমতা রয়েছে, সেখানে ফোরজি সেবা গ্রহণের সক্ষমতা এক দশমিক পাঁচ শতাংশের কম। এ অবস্থায় ফোরজি সেবা চালু করা কতটা লাভজনক হবে, সেটাও প্রশ্নের সম্মুখীন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্যামসাং মোবাইল বাংলাদেশের প্রাক্তন হেড অব বিজনেস ও সিস্টেমস সলিউশনস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট টেকনোলজিসের (এসএসডি-টেক) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হাসান মেহেদী শেয়ার বিজকে বলেন, দেশে বর্তমানে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর মাত্র ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ স্মার্টফোন ব্যবহার করেন। এ ব্যবহারকারীদের বেশিরভাগেরই ফোরজি প্রযুক্তিযুক্ত হ্যান্ডসেট নেই। অর্থাৎ আমাদের দেশের মোবাইল ব্যবহারকারীদের বড় অংশ এখনও থ্রিজি প্রযুক্তি সেবা গ্রহণ করেনি।  ফোরজি চালুর ক্ষেত্রে এটা সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যবহারকারীদের ১০ শতাংশের কম স্মার্টফোনে ফোরজি সাপোর্ট করে। কিন্তু ফোরজি সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে  গ্রাহককে অবশ্যই ফোরজি সাপোর্টেড মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ফোরজি চালুর ক্ষেত্রে আরেকটি প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে ফোরজি সাপোর্টেড মোবাইল সিম। বর্তমানে জেনারেল প্যাকেট রেডিও সার্ভিস টেকনোলজি (জিপিআরএস) বা ইনহ্যান্স ডেটা জিএসএম এনভায়রনমেন্ট (ইউডিজির) প্রযুক্তির সাহায্যে মোবাইল ফোন সেবা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এলটিই প্রযুক্তি চালু করার জন্য অবশ্যই কোড ডিভিশন মাল্টিপল একসেস (সিডিএমএ) প্রযুক্তি চালু করতে হবে। বাংলাদেশে সিটিসেল বাদে বাকি সব মোবাইল অপারেটররা জিএসএম প্রযুক্তির মাধ্যমে গ্রাহকদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ফোরজি প্রযুক্তি চালুর আগে সিডিএমএ প্রযুক্তি সাপোর্টেড সিম নিতে হবে গ্রাহকদের। কিন্তু বাংলাদেশে বাধ্যতামূলক বায়োমেট্রিক সিম রেজিস্ট্রেশনে যেখানে গ্রাহকদের আগ্রহী করতে সরকারকে এত বেগ পেতে হয়েছে, সেখানে ঐচ্ছিকভাবে ফোরজি প্রযুক্তির সিম গ্রহণে গ্রাহকরা কতটুকু আগ্রহী হবেন, সেটা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এছাড়া এলটিই প্রযুক্তি চালু হলে গ্রাহকদের মধ্যে ভয়েস ওভার এলটিই (ভিওএলটিই) সেবা গ্রাহকদের কাছে আরও সহজলভ্য হয়ে যাবে। মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ইমোসহ অন্যান্য জনপ্রিয় ফ্রি টকসাইটগুলোর ব্যবহার আরও বেড়ে যাবে। ফলে বাড়তি চাপ পড়বে এলটিই নেটওয়ার্কের ওপর আর কমে আসবে মোবাইলের মাধ্যমে ভয়েস কলের সংখ্যা। এর ফলে অর্থনৈতিকভাবে চাপে পড়তে পারে টেলিকম কোম্পানিগুলো। এলটিই প্রযুক্তি চালুর অন্য চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে নিরাপত্তা, ব্যাকহল, রিটার্ন অব ইনভেস্টমেন্ট ইত্যাদি।

তবে মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের সুবিধার্থে ফোরজি চালু করার আগে সাশ্রয়ী মূল্যে ডেটা প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে অপারেটরদের বলে মনে করেন মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দীন আহমেদ। তিনি বলেন, ডেটা প্রাপ্তিসুলভ না হলে অধিকাংশ মুঠোফোন ব্যবহারকারীই এ সেবাটি গ্রহণে অনাগ্রহী হবেন। আর এজন্য ফোরজিতে বিনিয়োগে একটি সীমাও থাকা দরকার। অন্যথায় উচ্চ ব্যয়ের এ প্রযুক্তি থ্রিজির মতোই একটি লোকসানি প্রকল্প হবে অপারেটরদের জন্য।

Add Comment

Click here to post a comment

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০