আবদুল মালেক ভূঞা: রিমান্ড শব্দের আভিধানিক অর্থ পুনঃপ্রেরণ। ‘রিমান্ড’ শব্দটি মূলত ফৌজদারি মামলায় আসামির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে রিমান্ড বলতে সাধারণ ভাষায় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে কোনো আসামিকে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আবার ফেরত নেয়াকে বোঝায়। কিন্তু রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন করাকে বোঝায় না। ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮-এর ১৬৭ ও ৩৪৪ ধারায় রিমান্ডের কথা বলা হলেও ওই কার্যবিধির কোথাও রিমান্ড শব্দটির সংজ্ঞা দেয়া হয়নি।
ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারায় বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তি পুলিশ কর্তৃক গ্রেপ্তার-পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত কার্য সমাপ্ত না হলে এবং ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ বস্তুনিষ্ঠ বিবেচিত হলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নিকটবর্তী আদালতের ক্ষমতাসম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে রিমান্ড প্রার্থনা করতে পারেন, যা একটি মামলায় বা একসঙ্গে ১৫ দিনের অধিক হবে না।
অপরদিকে দেয়ানি মোকদ্দমার ক্ষেত্রে রিমান্ড আদেশ হয়। আপিল আদালত বা ডিভিশনাল আদালতও ন্যায়বিচার পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বিচারিক আদালতে পুনঃফেরত পাঠানোর আদেশ দিয়ে থাকেন। দেয়ানি কার্যবিধি, ১৯০৮-এর ৪১ আদেশের যেসব বিধি রিমান্ডের পক্ষে ও বিপক্ষে আছে, তা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যই দেয়া হয়েছে। যদিও ৪১ আদেশের ২৭, ২৮, ৩৩ বিধিগুলোর ব্যবহার উল্লেখযোগ্য বটে, আপিল আদালতের সদিচ্ছায় অনেক রিমান্ড আদেশ নাও হতে পারে।
পুলিশ একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও একটি নিরাপদ হেফাজত। ‘দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন’ই পুলিশের নীতি। তবে পুলিশ হেফাজত অপরাধীদের জন্য প্রশ্নবহ। আবার মামলার তদন্তের ক্ষেত্রে বা কোনো পুলিশি আটকের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের হেফাজত অপরাধীর জন্য ভীতির কারণ হতে পারে। সমাজের সাধারণ মানুষ কিছু ব্যক্তি দ্বারা প্রতারিত ও শোষিত। বর্তমান অবস্থা ক্রমান্বয়ে এমন অবস্থায় ধাবিত হচ্ছে যে, নালিশের জায়গার অভাববোধ সৃষ্টি হবে, তবুও মানুষ আইনের আশ্রয় গ্রহণ করে।
আইনের জন্য মানুষ নয়, মানুষের কল্যাণই আইন। একজন অপরাধী অপরাধ করে স্বীকার করে না বা করতে চায় না, তাই ঘটনা উদ্ঘাটনে পুলিশ সংশ্লিষ্ট ধৃত ব্যক্তিকে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে তার কাছ থেকে তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বা সূত্র জিজ্ঞাসাবাদের পেতে পারে বা পাওয়া যায়। অভ্যাসগত ও স্বভাবগত অপরাধীকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে সেই এলাকার অপরাধীদের এবং অপরাধের সূত্র ও তথ্য পেতে নানারূপ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হতে পারে। পুলিশ রিমান্ডের ক্ষেত্রে দেশের বিদ্যমান আইনকানুন ও বিধিবিধানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। সভ্য জাতি হিসেবে স্বীকৃত জনগোষ্ঠী অপরাধ তদন্তে ও অপরাধীকে গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে পুলিশকে সহযোগিতা করে থাকে। এটি একটি দেশের সুনাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কোনো অপরাধে যুক্ত সন্দেহে কাউকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করতে পারে, ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় পুলিশেকে গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি বা এজাহারভুক্ত আসামি গ্রেপ্তার হলে পুলিশ ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় পুলিশ কাউকে আটক রাখতে পারে না বা পুলিশের লক-আপে রাখা আইনত বারিত। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত কাজ সমাপ্ত করতে না পারলে সে কারণে তার বিরুদ্ধে অপরাধের সম্পৃক্ততা সম্পর্কে রিপোর্টসহ নিকটস্থ প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে উপস্থিত করতে হয়। মামলার তদন্তের স্বার্থে প্রয়োজন হলে ১৫ দিনের কম যে কদিন পুলিশ হেফাজতে নেয়ার প্রয়োজন, তার সংগত কারণ উল্লেখপূর্বক আবেদন করলে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট যাবতীয় কাগজপত্র, পুলিশ ডায়েরি প্রভৃতি পর্যালোচনা করে তার বিবেচনা মোতাবেক যে কদিন পুলিশ হেফাজতে পাঠানোর প্রয়োজন বোধ করে সেই কদিন পুলিশ ওই ব্যক্তিকে হেফাজতে নিতে পারে। যদি ওই ব্যক্তি মামলার সঙ্গে যুক্ত এবং অপরাধ স্বীকার করে তবে তার জবানবন্দি তিনি নিজে অথবা অন্য কোনো উপযুক্ত ম্যাজিস্ট্রেটকে দিয়ে রেকর্ড করাতে পারেন। বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ও ৩৬৪ ধারায় বিধিবিধান পালনপূর্বক নির্ধারিত ফরমে বা ফরম না থাকলে সাদা কাগজে ফরমের আকারে বা ফরমে বর্ণিত চাহিদামতো আইনানুগভাবে জবানবন্দি রেকর্ড করতে পারেন। আটককৃত ব্যক্তি যদি জবানবন্দি দিতে অস্বীকার করে তবে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট তাকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেবেন। বিশেষ কারণবশত পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আবার রিমান্ডের আদেশ দিতে পারেন।
যদি চোরাই বা ডাকাতির মাল বা মৃতদেহ বা ঘটনার কোনো আলামত উদ্ধার করার প্রয়োজন হয়, তখন তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট আসামিকে রিমান্ডের আদেশ দিতে পারেন। রিমান্ডের আদেশ প্রদানের ক্ষেত্রে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট আসামির শারীরিক অবস্থা, সুবিধা-অসুবিধা প্রভৃতি শুনানির পরে যুক্তিসংগত কারণে ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে আদেশ দেবেন। বারবার রিমান্ডের পর কেউ দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি করলে অন্য কোনো বৈধ সাক্ষ্য প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত না হলে তা সন্দেহভাজন দৃষ্টিতে বিবেচনা করা হয়। রিমান্ডের পর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ও সত্য হিসেবে বিবেচনা না করার সংগত কারণ সৃষ্টি হয়।
যখন কোনো ব্যক্তিকে যে মামলায় বা যে কারণে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তার কারণ পুলিশ অফিসার কেস ডায়রিতে লিপিবদ্ধ করবেন এবং কেস ডায়রিতে পিআরবি ৩২৪(বি) বিধি অনুযায়ী সিল ও সহি স্বাক্ষর করবেন। তবে পুলিশ অফিসার বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪-এর ৩ ধারায় আটক রাখার জন্য কাউকে ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮-এর ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করতে পারবে না। ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮-এর ৬১ ধারামতে, কেস ডায়রিসহ নিকটস্থ উপযুক্ত বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করবেন। তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিবরণ যথাযথ ও সুগঠিত কি না পুলিশ অফিসার বিপি ফরম নং ৩৮ বর্ণিত লিপিবদ্ধকৃত বর্ণনার এক কপি বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রদান করবেন। তখন বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮-এর ১৬৭(১) ধারায় বর্ণিত রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখবেন, কেন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্তকার্য সমাপ্ত করা সম্ভব হয়নি এবং ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮-এর ১৬৭(৩) ধারা অনুযায়ী, বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট রিমান্ড আদেশ প্রদানের আগে রিমান্ডের কারণ বা যুক্তিগুলো উল্লেখ করবেন।
“আদালত যদি মনে করেন আসামিকে রিমান্ডে দিলে জোরালো সাক্ষ্য পাওয়া সম্ভব হবে, যাতে সন্দেহ দূরীভূত হবে এবং পুলিশ ওই আসামির বিরুদ্ধে উৎকৃষ্ট সাক্ষ্য দ্বারা তার অভিযুক্তকরণ সুদৃঢ় করতে পারবে, এ মর্মে বিজ্ঞ আদালতকে সন্তুষ্ট করতে হবে। ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮-এর ১৯০(১)(বি) ধারার বিধানমতে, পুলিশের রিপোর্ট ছাড়া রিমান্ডের আদেশ প্রদান করবে না [পিএলডি ১৯৫৭ করাচি ২১০]।” “রিমান্ড মঞ্জুর করার পূর্বে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ কেস ডায়রিতে সুনির্দিষ্ট ও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে কি না ইত্যাদি পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট না হলে আসামিকে জেলহাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেবেন [২০ ডিএলআর(ইউপি)২৬৪]।” “কেস ডায়রির অস্তিত্ব না থাকলে শুধু আসামিকে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে প্রেরণ করা যাবে না [১৯৭৩ সিআর. এল. জি. ৮৬৯]।”
ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় বাংলাদেশের জনগণের কাছে ‘রিমান্ড’ শব্দটি যেন এক মূর্তিমান আতঙ্ক। রিমান্ডের নামে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা আইন ও বাংলাদেশ সংবিধানবিরোধী। বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট শুনানির পরে পুলিশের কাছে আসামিকে ফেরত দিতে পারেন, অথবা জেলহাজতে প্রেরণের আদেশ দিতে পারেন। রিমান্ড ন্যায়বিচার কার্যক্রমের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত। সেজন্য রিমান্ড উদ্দেশ্যমূলক না হয়ে আইনানুগ কারণে হতে হবে। অন্যথায় ন্যায়বিচারবিরোধী ও মানবাধিকারবিরোধী হিসেবে গণ্য হবে। ইদানীং লক্ষ করা যায়, প্রায় পুলিশি মামলায় তদন্ত কর্মকতা আসামিকে কোর্টে চালান করে তিন বা পাঁচ অথবা সাত দিনের রিমান্ডের প্রার্থনা করে। আবার অনেক ক্ষেত্রে দোষ স্বীকার করানোর জন্য পুলিশ রিমান্ডের আবেদন করে। তা আইনে অনুমোদিত নয়। রাষ্ট্র বনাম লালু মিয়া এবং অন্যান্য মামলায় [৩৯ ডিএলআর(এডি) প্যারা নং ৬৬, পৃষ্ঠা নং ১৪৫] আসামি লালু মিয়াকে একাধিকবার পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করে। রিমান্ড শেষে লালু মিয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবাববন্দি প্রদান করেন। যদিও পরবর্তী সময় আসামি লালু মিয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবাববন্দি প্রত্যাহার করেন।
প্রতিটি দেশের সংবিধান নাগরিকের রক্ষাকবচ হিসেবে অভিহিত। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকই স্বাধীন ও মুক্ত। অন্যায়ভাবে জোরপূর্বক আটক রাখা বেআইনি, তা ক্ষমতার অপব্যবহার হিসেবে গণ্য হবে। বাংলাদেশ সংবিধানের নিম্নোক্ত অনুচ্ছেদগুলো লক্ষণীয়Ñসংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের ও সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত, আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম ও সম্পত্তির হানি ঘটে।
৩২ অনুচ্ছেদ মোতাবেক জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী না হলে জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না এবং ৩৩ অনুচ্ছেদ গ্রেপ্তার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচÑ(১) গ্রেপ্তারকৃত প্রত্যেক ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শিগগির গ্রেপ্তারের কারণ জ্ঞাপন না করে প্রহরায় আটক রাখা যাবে না এবং কাউকে গ্রেপ্তারের পর কোনো আত্মীয়স্বজনের সাক্ষাৎ এবং বিজ্ঞ আইনজীবীর পরামর্শ গ্রহণে বারণ করা যাবে না। (২) গ্রেপ্তারকৃত ও প্রহরায় আটক প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিকটতম বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হাজির করতে হবে এবং বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতিরেকে তাকে তদতিরিক্ত কাল প্রহরায় আটক রাখা যাবে না।
তা ছাড়া বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫(৩) অনুচ্ছেদের ফৌজদারি অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইবুন্যালে দ্রুত ও প্রকাশ্যে বিচার লাভের অধিকারী। (৪) কোনো অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাবে না। (৫) কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেয়া যাবে না, কিংবা নিষ্ঠুর অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেয়া যাবে না, কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাবে না। কাউকে অন্ধকার কুঠুরিতে আটক রেখে নির্যাতন করা যাবে না।
অফিসার অন স্পেশাল ডিওটি (ওএসডি) শব্দের মতো রিমান্ড শব্দটি শুনতে খুবই ভালো লাগে। বাস্তবে দুটিই সরষের মধ্যে ভূত। আটক বা গ্রেপ্তারের সময় অনেকেই স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করলেও বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করার সময় দেখা যায় প্রায়ই আটককৃত ব্যক্তিকে হুইলচেয়ারে করে বিজ্ঞ আদালতে হাজির করে। চোর, ডাকাত এমনকি রাজনৈতিক নেতা ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদেরও রিমান্ডের নামে চলে নির্যাতন। এজন্য ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় রিমান্ড উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রিমান্ডে নিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায়সহ নানা অভিযোগ রয়েছে, যা বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার এবং ১৬৭ ধারায় গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করে (রিট পিটিশন নম্বর ৩৮০৬/১৯৯৮)।
এ প্রেক্ষাপটে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল হাইকোর্ট বিভাগ রায় দেন। রায়ে ছয় মাসের মধ্যে ফৌজদারি আইন সংশোধন করতে সরকারকে ১৫ দফা নির্দেশনা দেয়া হয়। ২০১৬ সালের ২৫ মে ওই রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। উচ্চ আদালতে বহুবার এটির বৈধতা চ্যালেঞ্জ হয়েছে, আদালত থেকেও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কিন্তু তার পরও রিমান্ডের অপব্যবহার বাড়ছে, যা সত্যিকার অর্থেই দুঃখজনক।
রিমান্ডের অপব্যবহার রোধ করার জন্য উপমহাদেশের বিভিন্ন আদালতের মতো বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতও সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন, যা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও অধস্তন আদালতগুলোর জন্য মেনে চলার বাধ্যবাধকতা রয়েছে. বোধগম্য নয় যে, কীভাবে সংবিধান ও কার্যবিধির বিধান ভঙ্গ করে পুলিশের কাছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে দেয়ার আদেশ হতে পারে। বাংলাদেশ সংবিধানের বিধানের সঙ্গে অন্য আইনের যে অসংগতি আছে, তা দূরীভূত হওয়া প্রয়োজন [৫৫ ডিএলআর(এইসসি)৩৬৩]। কোনো তথ্য পাওয়ার জন্য শক্তি প্রয়োগ ও নির্যাতন করা কখনও আইনসংগত নয়। তাতে স্পষ্ট বলা যায়, জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন করার জন্য কাউকে রিমান্ডে নেয়া যাবে না, যা সংবিধান পরিপন্থিও বটে।
সাইফুজ্জামান ও অন্যান্য বনাম রাষ্ট্র মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হয়েছে: সন্ত্রাস দমন করতে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী কার্যক্রম কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। রিমান্ডের নামে তদন্তকারী অফিসারের স্বেচ্ছাচারমূলক আচরণ ক্ষমতার অপব্যবহার হিসাবের মধ্যে গণ্য হবে।
গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা হলেই তাকে রিমান্ডে দিতে হবে, এটি কোনো জুডিশিয়াল আদেশ হতে পারে না? যদিও ‘রিমান্ড আদেশ একটি জুডিশিয়াল আদেশ [এআইআর ১৯২৫ (বোম্বে) ৩৮৭ বিডিবি]’। রিমান্ডের আদেশ হলেই গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি আসামি হিসেবে সাব্যস্ত হবেন। বিচারিক আদেশ প্রদানের আগে বিজ্ঞ বিচারককে আইন ও ঘটনার খুঁটিনাটি চিন্তাভাবনা করে রিমান্ড আদেশ প্রদান করতে হবে। গ্রেপ্তারকৃত আসামি ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮-এর ৩৪০ ধারার বিধানের সুবিধা পাবেন। আইনের কোনো বিধান ভঙ্গ করে রিমান্ড আদেশ প্রদান করা যাবে না বা উচিত নয়। যে বন্দি স্বীকারোক্তি করবে বা বিবৃতি দেবে বলে প্রত্যাশা করা হয়েছে, সে যদি তা করতে বা দিতে ব্যর্থ হয় এবং তাকে পুলিশি হেফাজতে আটক করার আদেশ প্রদানের জন্য আবেদন করা হয়, তবে সেই আবেদন মঞ্জুর করা উচিত নয়।
বিজ্ঞ আদালত মন্তব্য করেন, পুলিশ হেফাজতে প্রেরণের আবেদন সতর্কতার সহিত করতে হবে। শুধু সেই অবস্থায় তা মঞ্জুর করা হবে, যখন ইহা প্রতীয়মান করা যাবে যে, লোকদিগকে শনাক্তকরণ, সম্পত্তি শনাক্তকরণ, কিংবা উদ্ধার অথবা এইরূপ বিশেষ বিশেষ কারণে পুলিশের সঙ্গে আসামির উপস্থিতি একান্ত প্রয়োজন। “রিমান্ড দেয়া এবং না দেয়া সহজাত ক্ষমতা (উরংপৎবঃরড়হধৎু চড়বিৎ) ম্যাজিস্ট্রেটের আছে। ম্যাজিস্ট্রেটের রিমান্ড না মঞ্জুরের আদেশ বিজ্ঞ দায়রা জজ নাকচ করে রিমান্ডের আদেশ দিতে পারবেন না [এআইআর ১৯৫১ (এল.) ৪৬০]।” “বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট সাংবিধানিক বিধান অবশ্যই অনুসরণ করবেন। নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন হয়, এইরূপ আদেশ দেয়া উচিত হবে না [পিএলডি ১৯৬৯ (লাহোর) ১০২০]।”
এছাড়া সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২-এর ২৫ ধারায় উল্লেখ আছে, যেকোনো অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি পুলিশ অফিসারের কাছে দোষ স্বীকার করলে তা তার বিরুদ্ধে প্রমাণ করা যাবে না; সাক্ষ্য আইনের ২৬ ধারায় আরও উল্লেখ আছে, পুলিশের হেফাজতে থাকাকালে কোনো ব্যক্তি দোষ স্বীকার করলে তা যদি ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে না হয়, তবে তা ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রমাণ করা যাবে না এবং সাক্ষ্য আইনের ২৭ ধারায় বর্ণিত আছে, পুলিশের কাছে স্বীকৃতি গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং পুলিশ রিমান্ডের প্রয়োজন অর্থহীন। তা ছাড়া জেল-কারাগারেও জিজ্ঞাসাবাদ করা যায়।
আইন সব সময় নাগরিকের স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিত করে। ক্ষমতার অপব্যবহার নাগরিকের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করতে পারে। এটি বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ অফিসার উভয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। আইনের কোনো বিধানে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, সেদিকে পুলিশ প্রশাসন ও বিচার প্রশাসনকে লক্ষ রাখতে হবে। অন্যায়ভাবে কারও অধিকার ক্ষু ্ন করা হলে ওই ব্যক্তি ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারেন এবং এ বিষয়ে উচ্চ আদালত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সংস্থাকে আদেশ প্রদান করতে পারেন। বাংলাদেশ সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগকে এই ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।
রিমান্ডের পর বিগত বছরগুলোয় পুলিশ হেফাজতে ভিকটিমের মৃত্যু হওয়া দুঃখজনক বলে আদালত মন্তব্য করেন। মানবাধিকারবিষয়ক একটি সেমিনারে মহামান্য রাষ্ট্রপতি এরূপ মৃত্যুকে সভ্যতাবিরোধী বলে মন্তব্য করেন। রিমান্ডের নামে পুলিশের কার্যকলাপ সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ের বিধান পরিপন্থি। সুতরাং ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮-এর ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনান্তে সাংবিধানিক বিধানের সমন্বয় করার জন্য উচ্চ আদালত সুপারিশ করেছেন। যেহেতু পুলিশের কাছে মৃত্যুকালীন ঘোষণা ছাড়া আর কোনো স্বীকৃতিই ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় গ্রহণযোগ্য নয়, তাই পুলিশি রিমান্ড বাতিল করে জুডিশিয়াল রিমান্ড ব্যবস্থা প্রচলন করা প্রয়োজন।