কয়েক বছর ধরে ‘ফ্লু’ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বেড়েই চলেছে। সাধারণ মানুষও এ সম্পর্কে সচেতন। যে জানে, এই রোগে কী হয়Ñ লক্ষণ কী। মাথাব্যথা, নাক দিয়ে পানি পড়া প্রভৃতি। কিন্তু ফ্লু বলতে আমরা যা বুঝি তা কিন্তু ফ্লু নয়, সাধারণ সর্দি-জ্বর। ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জার জটিলতা সম্পর্কে জানার আগে সাধারণ সর্দি-জ্বর আর ফ্লুর পার্থক্য জানা প্রয়োজন।
নিজেদের অভিজ্ঞতায় সচেতন মানুষ জানেন, সাধারণ সর্দি-জ্বর ঋতু পরিবর্তনকালীন সময়গুলোতে হয়ে থাকে, যার প্রাথমিক লক্ষণগুলো হচ্ছে বন্ধ নাক, গলা ব্যথা, সঙ্গে মৃদু জ্বর এবং খুসখুসে কাশি থাকতে পারে। এই জ্বর ভাইরাসজনিত কারণে হলেও এর কারণে কোনো মারাত্মক জটিলতা হয় না। সর্বোচ্চ সাত দিনের মধ্যেই রোগী সুস্থ হয়ে যেতে থাকে। ফ্লুর উপসর্গ ভিন্ন। হঠাৎ করেই তীব্র জ্বর ওঠে, যা ৩ থেকে ৪ দিন মেয়াদি হয়ে থাকে। রোগীর সারা গায়ে এবং মাথায় তীব্র ব্যথা থাকতে পারে। এতে আক্রান্ত ব্যক্তি প্রচণ্ড ক্লান্তি বোধ করেন এবং তার দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। আর যদি রোগী শিশু বা বয়স্ক ব্যক্তি হন অথবা রোগীর অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্যগত সমস্যা যেমন ডায়াবেটিস, হƒদরোগ বা হাঁপানি থেকে থাকে, তাহলে জটিলতা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।
দেশে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসকে ফ্লু ভাইরাসের মৌসুম হিসেবে চিহ্নিত করেছেন আমাদের গবেষকরা। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এবং আইসিডিডিআর.বির গবেষকরা যৌথভাবে বছরব্যাপী ইনফ্লুয়েঞ্জা সারভাইল্যান্সের তথ্য পর্যালোচনা করে এ তথ্য জানিয়েছেন তারা। বুধবার রাজধানীর মহাখালীর আইইডিসিআর অডিটোরিয়ামে ‘ইনফ্লুয়েঞ্জা সার্ভিল্যান্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক সেমিনারে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। ওই সেমিনারে ২০০৭ সাল থেকে দেশব্যাপী বিভিন্ন হাসপাতালে পরিচালিত ইনফ্লুয়েঞ্জা সার্ভিল্যান্স থেকে প্রাপ্ত ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (ইউএস-সিডিসি) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কারিগরি সহায়তায় এই সার্ভিল্যান্সটি বাংলাদেশে পরিচালিত হয়ে আসছে। বর্তমানে দেশের ১৯টি হাসপাতালে চলমান এই সার্ভিল্যান্সের মূল লক্ষ্য বাংলাদেশে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সংক্রমণ ও মৌসুমি বৈচিত্র্য বোঝার পাশাপাশি ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের বিভিন্ন ধরন শনাক্ত করা। সার্ভিল্যান্সের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এপ্রিল-সেপ্টেম্বর সময়পর্বে দেশে ইনফ্লুয়েঞ্জা সংক্রমণের প্রকোপ বাড়ে। তাই এ সময়টাকে গবেষকরা ফ্লুর মৌসুম হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস থেকে সর্বোচ্চ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশে প্রতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের টিকা বা ফ্লু-শট নেয়ার সুপারিশ করেছেন গবেষকরা।
যেহেতু ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সময়পর্ব চিহ্নিত করা গেছে, তাই এ থেকে রক্ষায় প্রতিরোধী ব্যবস্থা নেয়া সহজই বলা যায়। ফ্লু হলে প্রতিকারের চেয়ে আগে থেকেই প্রতিরোধ করাই উত্তম পন্থা।
ফ্লুর টিকা বাংলাদেশসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই সহজলভ্য। এই টিকার কার্যকারিতা পরীক্ষিত এবং প্রমাণিত। প্রতি বছর এই জীবাণুর ধারা পরিবর্তিত হয় বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতি বছরই ফ্লুর সর্বশেষ ভাইরাসগুলো চিহ্নিত করে টিকায় ব্যবহারের অনুমতি দেয়। ফ্লুর বিরুদ্ধে সর্বোত্তম প্রতিরোধ গড়তে প্রতি বছরই ফ্লুর মৌসুম শুরুর আগে এই টিকা নেয়া প্রয়োজন। গবেষকদের তথ্য অনুযায়ী ফ্লুর মৌসুম সবে শুরু হয়েছে। তাই ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে ইনফ্লুয়েঞ্জা টিকা নিয়ে সুরক্ষিত রাখার প্রতি এবং ইনফ্লুয়েঞ্জার মৌসুমে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে নাগরিকদের অবলম্বন সতর্কতা জরুরি। সচেতনতায় সরকার যত দ্রুত সম্ভব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে বলেই প্রত্যাশা।