Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 5:18 am

ফ্ল্যাট-জমিতে কালোটাকা সাদা করার সুবিধা বাতিল হচ্ছে

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক: ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল করা হয় ২ সেপ্টেম্বর। তবে জমি ও ফ্ল্যাটে বিনিয়োগে কালোটাকা সাদা করা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এবার এই দুটি খাতেও অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ বন্ধ করতে চায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এরই মধ্যে এ দুই খাতে বিনিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় তা বাতিলের বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সবুজ সংকেত পেলেই এনবিআর তা বাতিল করে দেবে। এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, এ দুটি খাতে বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এরপরও এ দুটি খাত নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সরকার সংকেত দিলেই আমরা বাতিলের উদ্যোগ নেব। তবে এ খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, জমি ও ফ্ল্যাটে অপ্রদর্শিত বিনিয়োগের সুযোগ না দিলে এই টাকা পাচার হয়ে যাবে।

এনবিআর সূত্রমতে, সমালোচনার মুখে ২ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল করে। এসআরও জারির পাশাপাশি এনবিআর থেকে বিজ্ঞপ্তিও জারি করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ১৫ শতাংশ হারে আয়কর পরিশোধ করে অপ্রদর্শিত পরিসম্পদ প্রদর্শন করার বিধান অর্থ আইন, ২০২৪-এর মাধ্যমে সংযোজন করা হয়েছে। একজন নিয়মিত করদাতাকে তার আয়ের ওপর সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত আয়কর প্রদান করতে হয়। আর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে প্রদেয় করের ওপর আরও সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ হারে সারচার্জ প্রদান করতে হয়। কিন্তু মাত্র ১৫ শতাংশ হারে কর প্রদান করে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ করে দেয়া হয়। একটি ন্যায়নিষ্ঠ সমতাভিত্তিক রাজস্ব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এনবিআর ১৫ শতাংশ আয়কর পরিশোধ করে নগদ অর্থসহ অপ্রদর্শিত সমজাতীয় পরিসম্পদ প্রদর্শনের বিশেষ ব্যবস্থা-সংক্রান্ত বিধান বিলুপ্ত করল। এনবিআর একটি সত্যিকারের বৈষম্যমুক্ত, ন্যায়ানুগ ও প্রগতিশীল কর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে অঙ্গীকারবদ্ধ।

অপরদিকে, এ আদেশের ফলে পুঁজিবাজার, নগদ, ব্যাংকে থাকা অর্থ, ফাইন্যান্সিয়াল স্কিম অ্যান্ড ইনস্ট্রুমেন্টসহ সব ধরনের আমানতের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা বৈধ করার সুবিধা বাতিল হলো। এসব ক্ষেত্রে কালোটাকা সাদা করতে হলে এখন প্রযোজ্য কর, যা সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ, সেটি দিতে হবে। ওই প্রদেয় করের ওপর ১০ শতাংশ জরিমানা দিতে হবে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সম্প্রতি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা বৈধ করার নিয়ম চালু করে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ১০ শতাংশ কর পরিশোধ সাপেক্ষে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছিল তৎকালীন সরকার। চার বছর পর আবারও কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়। তৎকালীন সরকারের এ সিদ্ধান্ত তখন তীব্র সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিল। কারণ বৈধ করদাতাদের ৩০ শতাংশ পর্যন্ত আয়করের পাশাপাশি অতিরিক্ত সারচার্জ দিতে হয়।
এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে কালোটাকা সাদা করার বিতর্কিত সুযোগটি বাদ দেয়ার উপায় খোঁজা হচ্ছে। নতুন সরকার গঠনের পর গত ২৮ আগস্ট রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার বিধান বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়। এর আগে ২৭ আগস্ট রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এনবিআর সদর দপ্তরে অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে বৈঠকে এনবিআর কর্মকর্তারা কালোটাকা সাদা করার সুবিধা বাতিলের সুপারিশ করেছিল।

এনবিআর সূত্রমতে, চলতি করবর্ষে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাই-টেক পার্কে কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ বাতিল করা হয়েছে। আগে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাই-টেক পার্কে বিনিয়োগ করা অর্থের ওপর ১০ শতাংশ কর দিলে উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করার সুযোগ ছিল না। এর আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাই-টেক পার্কে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য লভ্যাংশ আয়কে করের বাইরে রেখেছিল।
আয়কর আইনের প্রথম তফসিল ‘বিনিয়োগে বিশেষ করহার’ অংশে ফ্ল্যাট ও প্লটে’ কত বর্গমিটারে কত টাকা জরিমানা দিয়ে কালোটাকা সাদা করা যায়, তা উল্লেখ করা হয়েছেÑযাতে বলা হয়েছে, ঢাকার গুলশান, বনানী, মতিঝিল, তেজগাঁও, ধানমন্ডি, ওয়ারী, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, শাহবাগ, রমনা, পল্টন, কাফরুল, নিউমার্কেট ও কলাবাগান থানার সব মৌজায় স্থাপনা, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্লোর প্রতি বর্গমিটারে কর দিতে হবে ছয় হাজার টাকা। আর জমির ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটারে দিতে হবে ১৫ হাজার টাকা। অপরদিকে বংশাল, মোহাম্মদপুর, সূত্রাপুর, যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, ক্যান্টনমেন্ট, চকবাজার, কোতোয়ালি, লালবাগ, খিলগাঁও, শ্যামপুর, শাহজাহানপুর, মিরপুর, দারুস সালাম, দক্ষিণখান, উত্তরখান, তুরাগ, শাহ আলী, সবুজবাগ, কদমতলী, কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ, ডেমরা, আদাবর, গেণ্ডারিয়া, খিলক্ষেত, মুগদা, রূপনগর, ভাষানটেক, বাড্ডা, পল্লবী, ভাটারা থানা, চট্টগ্রামের খুলশী, পাঁচলাইশ, পাহাড়তলী, নারায়ণগঞ্জের সদর, সোনারগাঁও, ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ, বন্দর থানা, গাজীপুর সদর থানার সব মৌজার ফ্ল্যাট-স্থাপনা প্রতি বর্গমিটারে তিন হাজার ৫০০ টাকা। আর জমিতে প্রতি বর্গমিটারে ১০ হাজার টাকা। ঢাকার দোহার, নবাবগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, সাভার, ধামরাই, চট্টগ্রামের আকবর শাহ, ইপিজেড, কর্ণফুলী, চকবাজার, চান্দগাঁও, ডবলমুরিং, পতেঙ্গা, বন্দর, বাকলিয়া, বায়েজিত বোস্তামি ও সদরঘাট থানা, গাজীপুরের জয়দেবপুর, কালীগঞ্জ, বাসন, কোনাবাড়ী, গাছা, টঙ্গী পূর্ব, টঙ্গী পশ্চিম, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ, আড়াইহাজার থানার সকল মৌজার ফ্ল্যাট-স্থাপনায় প্রতি বর্গমিটারে এক হাজার ৫০০ টাকা। আর জমিতে প্রতি বর্গমিটারে তিন হাজার টাকা। এসব থানা এলাকা বাদে ঢাকা দক্ষিণ, ঢাকা উত্তর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর সিটি করপোরেশন ব্যতীত অন্যান্য সিটি করপোরেশন ও অন্য কোনো উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং জেলা সদরে অবস্থিত সকল পৌরসভার সকল মৌজার ফ্ল্যাট-স্থাপনায় প্রতি বর্গমিটারে এক হাজার টাকা। আর জমিতে প্রতি বর্গমিটারে দুই হাজার টাকা। পৌরসভার অন্তর্গত সকল মৌজায় ফ্ল্যাট ৮৫০ টাকা ও জমি এক হাজার টাকা; এছাড়া অন্যান্য যেকোন এলাকার সকল মৌজার ক্ষেত্রে ফ্ল্যাট-স্থাপনায় প্রতি বর্গমিটারে ৫০০ ও জমিতে প্রতি বর্গমিটারে ৩০০ টাকা হারে কর দিতে হয়।

এনবিআর সূত্রমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে ১০ শতাংশ কর দিয়ে আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত নগদ অর্থ ও ব্যাংক আমানত প্রদর্শনের সুযোগ দেয়া হয়। একইসঙ্গে বর্গমিটারপ্রতি নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে প্লট-ফ্ল্যাট প্রদর্শনের সুযোগও ছিল। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ওই অর্থবছরে ১১ হাজার ৮৩৯ জন মোট ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বৈধ করেছেন, যা ছিল দেশের ইতিহাসে এক বছরে সর্বোচ্চ কালোটাকা সাদা করার ঘটনা। এই বৈধ করা থেকে সরকার রাজস্ব পেয়েছে দুই হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সাত হাজার ৫৫ জন ব্যাংকে জমা বা নগদ ১৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা বৈধ করেছেন। বাকি টাকা জমি, ফ্ল্যাট বা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা হয়। এর পরের বছর অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছর কালোটাকা সাদা করার ক্ষেত্রে সাড়া না পাওয়ায় এ সুবিধা বাতিল করা হয়।

এ বিষয়ে রিহ্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট এমএ আউয়াল বলেন, কালোটাকা জমি ও অ্যাপার্টমেন্ট এ বিনিয়োগের সুযোগ থাকলে এই সেক্টর ডেভেলপড হয় এবং টাকা দেশে থাকে। কিন্তু এই সুযোগ না থাকলে এই টাকা বিনিয়োগের সুযোগ থাকবে না। ফলে টাকা পাচার হয়ে যাবে। এই সুযোগ থাকায় এই সেক্টরে প্রাণচাঞ্চল্য এসেছিল। কিন্তু এ সুযোগ বাতিল হলে আবার মুখ থুবড়ে পড়বে।