জল্পনাকল্পনা কাটিয়ে শুরু হয়েছে ‘অমর একুশে বইমেলা, ২০২২’। এ বইমেলা বাঙালির আবেগ ও প্রাণের বইমেলা। কভিড-১৯-এর কারণে গত বইমেলা আশানুরূপ পাঠকপ্রিয়তা পায়নি, যা লেখক-প্রকাশক থেকে শুরু করে বই প্রকাশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। এবারও সংশয়ের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে বইমেলা। পরিবর্তনশীল কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই। তবুও একটাই চাওয়া সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন হোক প্রাণের বইমেলা। বইমেলা শুধু বই বেচাকেনার জন্য নয়। এ মেলা বাঙালির সংস্কৃতির শেকড় সন্ধানের মেলা, এ মেলা নিজস্ব সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার মেলা, এ মেলা রুচিবোধ ও মূল্যবোধ পাল্টানোর মেলা, এ মেলা জাতির মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর মেলা, এ মেলা ঘুমন্ত জ্ঞানকে জাগিয়ে তোলার মেলা, এ মেলা রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, আত্মশুদ্ধির মেলা, এ মেলা এফ টুরুপারের ভাষায় বন্ধুত্বের মেলা, এ মেলা লেখক, পাঠক ও প্রকাশকের মিলনমেলা। এ মেলা নিজের আত্মাকে বাঁচিয়ে রাখার মেলা। লেখক, প্রকাশক ও বইপ্রিয় পাঠকদের জন্য বইমেলা আবেগের জায়গা। বিশেষ করে, বইমেলাকে ঘিরে প্রচুর বই প্রকাশ করা হয়ে থাকে।
তরুণ লেখকদের কাছে বই প্রকাশের প্রধান আকর্ষণ বইমেলা। তরুণ প্রজন্মের উদীয়মান লেখকরা নিজস্ব অস্তিত্ব ঘোষণা করেন, নিজের লেখকসত্তাকে আবিষ্কার করেন।
কতজন তরুণ লেখক পারেন এই আবিষ্কৃত লেখকসত্তাকে প্রতিষ্ঠিত লেখক হিসেবে দাঁড় করাতে! এর সংখ্যা নেহাত কম। তরুণ লেখকদের বইয়ের সংখ্যা না বাড়িয়ে লেখার মান বৃদ্ধিতে মনোযোগ দিতে হবে। বইমেলা ঘিরে তরুণদের প্রচুর বই বের হচ্ছে। কেউ নিজ টাকা দিয়ে বই বের করছেন, আবার কেউ নিজ প্রতিভা ও সৃজনশীল লেখার মাধ্যমে প্রকাশকের নজরে পড়ায় বিনা খরচে বই বের করেন। তরুণ লেখক মানেই যে মানহীন বই, তা মোটেই সত্য নয়। অনেক তরুণ আছেন যারা চমৎকার লেখেন। এমনকি বেস্ট সেলারের তালিকায় নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করে নিচ্ছেন। এটা তরুণদের জন্য অনেক বড় পাওয়া।
তরুণ লেখকদের নিজেদের পরিচিতি পাওয়ার সহজ মাধ্যম হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। লেখকরা তাদের নিজস্ব সৃষ্টিশীল লেখা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করেন। এভাবে পাঠক তৈরি করে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করার ক্ষেত্রে তাদের প্রয়াস থেমে নেই।
এই পুঁজি ভর করেই তরুণদের এগিয়ে যেতে হবে। প্রবীণ লেখক ও তরুণদের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। জায়গা ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার তাড়না সৃষ্টি করতে হবে। তরুণদের মধ্য থেকে সম্ভাবনা বের করে আনতে হবে। পরামর্শ দিতে হবে। তরুণ লেখকদের ও প্রবীণদের কাছাকাছি থেকে পরামর্শ ও আশীর্বাদ নিতে হবে। তবেই এগিয়ে যাবে বাংলার সাহিত্যাঙ্গন।
জানা ও পড়ার প্রাচীন জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য মাধ্যম হলো বই পড়া। বই জ্ঞানের আধার। পৃথিবীর সব জ্ঞান বইয়ের পাতায় ঘুমিয়ে থাকে। এই ঘুমন্ত জ্ঞানকে চর্চা তথা পুড়িয়ে জাগ্রত করতে হবে। আলোকিত মানুষ হতে চাইলে বইয়ের বিকল্প নেই। বইয়ের কাছাকাছি থাকতে হবে। বইয়ের গন্ধ নিতে হবে। বইয়ের মাধ্যমে মানুষ ও মানুষের জীবন সম্বন্ধে পড়তে হবে। বইয়ের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে হলেও সত্য, বইয়ের সঙ্গে আমাদের দূরত্ব বেড়েই চলছে।
সরকারি বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আগের তুলনায় বর্তমানে বই কম কিনছে। দেশের জনসংখ্যা বাড়ছে, বৃদ্ধি পাচ্ছে বিদ্যাপীঠের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কিন্তু কমছে বই কেনার বাজেট। পাবলিক লাইব্রেরির অবস্থা দিন দিন উন্নতির দিকে না ধাবিত হয়ে তার চাকা চলছে পেছনের দিকে। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র প্রায় স্থবির হওয়ার পথে। পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সারাবছর ধরতে গেলে উল্লেখযোগ্য হারে বই কিনছে না। গ্রামকেন্দ্রিক পাঠাগার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন আজও আমরা গোপনে বয়ে বেড়াচ্ছি। তাহলে একুশের বইমেলা আমাদের জন্য কী সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিচ্ছে?
বইমেলায় যেতে হবে। সঙ্গে প্রিয়জনদের সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। নিজে বই কিনতে হবে। প্রিয়জনকে বই উপহার দিতে হবে। বই আত্মার খোরাক। বইমেলা শুরু হয়ে গেছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে বইমেলায় যান। বই কিনুন। বই পড়–ন। বইয়ের কথা ছড়িয়ে দিন।
তরুণ লেখকদের বই কিনুন। প্রশংসা করুন, সমালোচনা করুন। এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দিন। বইয়ের কথা ছড়িয়ে দিন। পৃথিবী বইয়ের হোক।
হাসান মাহমুদ শুভ
শিক্ষার্থী
ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর