কয়েক দিন পরেই শুরু হবে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। শুরুতেই এ মেলায় গত বছর বই বিক্রির পরিসংখ্যানে দৃষ্টি দিই। বহুল প্রচারিত একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত বছর এ পরিমাণ ছিল প্রায় ৪০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ২০১৫ ও ২০১৪ সালে এটি ছিল যথাক্রমে ২১ কোটি ৯৫ লাখ ও ১৬ কোটি টাকা। এটি যে এ দেশের মানুষের প্রাণের মেলা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রতি বছর এ মেলায় ঠিক কত মানুষ উপস্থিত হয়, সে ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত কোনো তথ্য হাতে নেই। তবে পরিসংখ্যান বলছে, বই বিক্রি বাড়ছে প্রতি বছর। এতে অবশ্য তৃপ্ত হওয়ার কিছু নেই। কেননা প্রতিদিন মেলায় যেমন ভিড় দৃষ্টিগোচর হয়, তাতে টাকার হিসাবে মাথাপিছু বই কেনার অঙ্ক সন্তোষজনক হবে বলে মনে হয় না। মোটা দাগে হিসাব কষলে দেখা যায়, ১৬ কোটি মানুষের
দেশে অমর একুশে গ্রন্থমেলা উপলক্ষে গত বছর বই কেনা বাবদ মাথাপিছু খরচ হয়েছে মাত্র ২ টাকা ৫০ পয়সা।
এ পরিসংখ্যানে আরও একটি বিষয় স্পষ্ট, প্রবেশপথসহ মেলার বিভিন্ন স্টলে মানুষের ভিড় লক্ষণীয় হলেও এরা আসলে ক্রেতা নন দর্শক। রাজধানীর অধিবাসী সোয়া কোটি। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় যে শুধু রাজধানীর অধিবাসীরাই উপস্থিত হন, তা নয়। ঢাকার বাইরের লোকেরাও আসেন এ মেলায়। আসেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। বলা বাহুল্য, বইমেলায় উপস্থিত হয়ে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, লেখক-পাঠকের সঙ্গে সম্মিলিত হতে এ সময় ঢাকায় আসেন কেউ কেউ। তারা মেলায় আসেন সপরিবারে। যতো মানুষ এ আয়োজনে আসেন, তারা সবাই যদি ক্রেতা হতেন, তাহলে বিক্রি যে আরও কয়েক গুণ বাড়তো, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই।
ওই পরিস্থিতিতে বিক্রির অঙ্ক কোন পর্যায়ে পৌঁছতে পারতো, সে ব্যাপারে একটা ধারণা দিই। প্রতিদিন মেলায় গড়ে যদি ৫০ হাজার লোক আসে, তাহলে সারা মাসে এ সংখ্যা দাঁড়াবে ১৪ লাখ। ৪০ হাজার ও ৩০ হাজারের হিসাবে মোট উপস্থিতি দাঁড়ায় ১১ লাখ ২০ হাজার এবং ৮ লাখ ৪০ হাজার। ১৪ লাখ মানুষ ন্যূনতম ১ হাজার টাকার বই কিনলে মোট বিক্রি দাঁড়াবে ১৪০ কোটি, ১১ লাখ ২০ হাজারের হিসাবে ১১২ কোটি, ৮ লাখ ৪০ হাজারের হিসাবে তা দাঁড়াবে ৮৪ কোটি। সর্বনি¤œ হিসাবেও বিক্রি হবে বর্তমানের দ্বিগুণ।
আর মোট উপস্থিতির ১ লাখ লোকও যদি চাকরিজীবী হন এবং তারা মেলা উপলক্ষে বছরের বাকি অংশের জন্য (ফেব্রুয়ারি-ডিসেম্বর) প্রতি মাসে ৩০০ টাকা হিসেবে মোট ৩ হাজার টাকা বই কেনার জন্য বাজেট করেন, তাহলে এদের কাছেই মোট বিক্রি দাঁড়ায় ৩০ কোটি টাকা। অন্যদের কাছে বিক্রি মিলিয়ে মোট অঙ্ক ৪০ কোটির চেয়ে বেশি হবে, নিঃসন্দেহে। ১ লাখ লোক ঢাকার মোট অধিবাসীর ১ শতাংশেরও কম। এ নগরে যেসব শিক্ষিত ও চাকরিজীবী বাস করেন, তাদের সংখ্যা আরও বেশি বলেই ধারণা। তাদের পক্ষে কি মাসে বই কেনার জন্য ৩০০ টাকা বরাদ্দ রাখা অসম্ভব?
এ প্রশ্নের সহজ উত্তর আমারও জানা নেই। প্রসঙ্গত একটি অভিজ্ঞতা এখানে উল্লেখ করি। এ নিবন্ধ লেখার আগে নিজস্ব পরিমণ্ডলে গত কয়েক দিনে কথা বলি প্রায় ১৫ জনের সঙ্গে। এরা সবাই ঢাকার অধিবাসী। বয়সও ত্রিশের কোঠায়। সবারই শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতকোত্তর। এদের কারও মাসিক উপার্জন ২৫ হাজারের কম নয়। তাদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, আসন্ন বইমেলা উপলক্ষে আপনার প্রস্তুতি কী? লেখক বা পাঠক নয় ক্রেতা হিসেবে? একজন জানিয়েছেন, মেলা উপলক্ষে তার বাজেট ৫ হাজার টাকা। দুজন বলেছেন ২ হাজার। আর বাকিদের বক্তব্য মোটা দাগে বললে, এ নিয়ে তারা এখনও ভাবেননি। সময় পেলে একবার ওদিকে গিয়ে ঢুঁ মেরে আসবেন। মেলায় ঘুরে পছন্দ হলে এক-দুটি বইও কিনবেন তারা।
তাদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, বইমেলা উপলক্ষেও আর্থিক প্রস্তুতি নেওয়া দরকার, এটা অনেকের ভাবনায় নেই। অথচ রাজধানীতে থাকাকালে বিভিন্ন উৎসবে এদেরকেই দেখেছি বড় বাজেট করতে। কবে মার্কেটে যাওয়া হবে, কোন মার্কেটে যাওয়া হবে, কোন সময় গেলে সুবিধা হবে রাত জেগে এসব বিষয়ে পরিকল্পনা করতে। শুধু এই কয়জন নন, আরও বেশি মানুষকে এ প্রশ্ন করলে একই ধরনের উত্তর পাওয়া যাবে বলে মনে হয়। এ থেকে মনে একটি প্রশ্ন জাগলো, অন্যান্য উৎসবে যে মানুষ বাজেট ও নানা পরিকল্পনা করে, বইমেলা উপলক্ষে তাদের এমন নির্লিপ্ত মনোভাবের কারণ কী?
বস্তুত বইমেলা ঘিরে পাঠকেরও নানা রকম প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। বাজেট তো আছেই। এছাড়া ঠিক করতে হবে পছন্দের ক্যাটাগরি, লেখক তালিকা, মেলা উপলক্ষে আগত নতুন বইয়ের তালিকা, তা প্রকাশ হচ্ছে কোন প্রকাশনী থেকে। মেলায় ওই প্রকাশনীর স্টল নম্বর কতো হবে, ওই প্রকাশনী বইটি কবে প্রকাশ করবে ইত্যাদি। এসব ব্যাপারে একটু আগে থেকে পরিকল্পনা না করলে হয় কী সময় করে ঢুঁ মারার জন্য বইমেলায় যাওয়া হয় ঠিকই; বই কেনা হয়ে ওঠে না। আর বাজেট না থাকলে তো কথাই নেই।
এমন অনেককে জানি, তারা বই কিনতে আগ্রহী। পড়তেও ভালোবাসেন। শুধু বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকতে সাপ্তাহিক ছুটির সঙ্গে আরও এক-দুদিন নৈমিত্তিক ছুটি নেন কেউ কেউ। অন্যান্য খরচ চালিয়ে বইমেলার জন্য বড় বাজেট করা সম্ভব হয়ে ওঠে না তাদের পক্ষে। কিন্তু মেলায় বই কেনার জন্য তারা প্রয়োজনে ধার করতেও আগ্রহী। উল্লিখিত ব্যক্তিরা চাইলে নিকটজনের কাছে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ধার করতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিকতা চালু করা গেলে বই কেনা আরও উৎসাহিত হবে বলে মনে হয়।
প্রসঙ্গক্রমে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ এখানে উল্লেখ করতে হয়। গৃহসামগ্রী ক্রয় প্রকল্পের আওতায় কর্মীকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিয়ে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। বলা বাহুল্য, বইও রয়েছে এই গৃহসামগ্রীর তালিকায়। অর্থাৎ চাইলে বই কেনার জন্য ২ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারবেন ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মী। কথা হলো, এ ঋণ সুবিধা নিচ্ছেন অনেকেই। ক্রয় করা গৃহসামগ্রীর তালিকায় উপরের দিকে থাকছে গহনা, খাট, পালঙ্ক, আলমারি, টিভি, ফ্রিজ ইত্যাদি। বই কয়জন কিনছেন, কে জানে! এখন অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও কর্মীকে দিয়ে থাকে নানা ধরনের ঋণ বা ধার সুবিধা। সাধারণত এগুলো হয়ে থাকে চিকিৎসা, বিয়ে কিংবা অন্য কোনো আকস্মিক প্রয়োজন ঘিরে। এসব ঋণ সমন্বয় করা হয় মাসিক ভিত্তিতে। তাতে দেখা যায়, বেতন থেকে নির্ধারিত হারে কেটে রাখা হয় বলে কর্মী খুব একটা চাপ অনুভব করেন না। আবার তার প্রয়োজনও সমাধা হয়ে যায়। অমর একুশে গ্রন্থমেলা উপলক্ষে বই কেনার জন্য প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কর্মীকে এ ধরনের ঋণ দেওয়া কি অসম্ভব?
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে বোনাস দেওয়ার নিয়ম আগে ছিল না। এখন অনেক প্রতিষ্ঠানই কর্মীদের বাংলা নববর্ষে মূল বেতনের ২০ শতাংশ বোনাস দিচ্ছে গত বছর থেকে। বইমেলাও যে এ দেশে এক ধরনের উৎসব, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। একে ঘিরে অন্তত ঋণ নেওয়ার ব্যবস্থা রাখা গেলে প্রতিষ্ঠানের খরচ বাড়বে না। বরং বই পাঠের মধ্য দিয়ে কর্মীর যে ব্যক্তিগত উন্নয়ন হবে, তার সুফল পাবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। সর্বোপরি বই কেনার জন্য কর্মীকে সুযোগ-সুবিধা জোগানো গেলে এটা জ্ঞান অর্জনে যেমন উৎসাহ জোগাবে, তেমনি এর মাধ্যমে বাড়বে মেলায় বই বিক্রি।
বই কেনা ও পড়া ভালো কাজ নিঃসন্দেহে। কোনো ভালো কাজে ব্যক্তি যখন নিজ থেকে উৎসাহ বোধ করেন না, তখন এগিয়ে আসতে হয় প্রতিষ্ঠানকে। বই পাঠের অভ্যাস আমাদের মধ্য থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমে। কেনার অভ্যাস কমে আসছে বলে লেখক আর প্রকাশকদেরও মোকাবিলা করতে হচ্ছে নানা প্রতিকূলতা। এই বিপুল জনসংখ্যার দেশে এমন প্রতিকূলতা কাটিয়ে ওঠা কঠিন কিছু নয়। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পদক্ষেপ নেওয়া গেলে এক্ষেত্রে অল্প সময়েই অগ্রগতি অর্জন সম্ভব।
নিকট অতীতে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উত্তীর্ণ হয়েছে বাংলাদেশ। এখন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার জন্য চলছে প্রচেষ্টা। উচ্চ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনে নানা পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে সরকারকে। বস্তুত আয় বাড়লে মানুষের চাহিদার পরিবর্তন হয়, পরিবর্তন আসে রুচিতেও। কিন্তু এর সঙ্গে জ্ঞান যদি সমানভাবে উৎকর্ষ লাভ না করে, তাহলে উন্নয়ন সুষম হয় না। এজন্য যে কোনো প্রতিষ্ঠানেই থাকা দরকার জ্ঞান অর্জন ও বিকাশে কাঠামোগত পদক্ষেপ। ফেব্রুয়ারি মাসে বই উৎসব ঘিরে প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তার ব্যবস্থা করা গেলে জ্ঞান অর্জন ও বিকাশে তা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে নিঃসন্দেহে।
ব্যাংক কর্মকর্তা
zahirul.duÑgmail.com