মুস্তাফা মাসুদ: বই উৎসব তথা পাঠ্যপুস্তক উৎসব সরকারের একটি বৈপ্লবিক চিন্তাপ্রসূত কর্মসূচি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই দেশে এই কর্মসূচি চালু করেন ২০১০ সালে। সৃজনশীল বইয়ের উৎসব, অর্থাৎ বইমেলা বা গ্রন্থমেলার চল আমাদের দেশে আছে; দুনিয়ার বহু দেশেই আছে। কিন্তু সৃজনশীলের বাইরে স্কুলের পাঠ্যপুস্তক নিয়ে আনুষ্ঠানিক উৎসবের চল কোথাও দেখা যায় না; এটি আমাদের দেশে এক অনন্য কর্মসূচি। প্রতিবছর জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে প্রধানমন্ত্রী বিদ্যালয়ের কোমলমতি শিশুদের মাঝে বিনা মূল্যে সে বছরের নতুন পাঠ্যবই বিতরণ কর্মসূচি উদ্বোধন করে যে অভূতপূর্ব আনন্দের উপলক্ষ সৃজন করেন, সারা দেশের লাখ লাখ শিশু সেই উৎসবে শরিক হয়ে যেন ভিন্নতর এক ঈদ-আনন্দ উপভোগ করে। এই উৎসবের মাধ্যমে খ্রিষ্টীয় নতুন বছরকে যেমন বরণ করে নেয়া হয়, তেমনিভাবে এর মধ্য দিয়ে সরকারের ভিন্নতর এক প্রত্যয়ও ঘোষিত হয়।
বছরের প্রথম দিনে সারা দেশের লাখ লাখ শিশুর হাতে নতুন বই পৌঁছে যাচ্ছে। এর তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। একদিকে বিনা মূলে বই বিতরণ কর্মসূচির মাধ্যমে নাগরিকদের একটি মৌলিক চাহিদা পূরণ, অন্যদিকে সেই মৌলিক চাহিদা পূরণকল্পে সরকারের বৃহত্তর লক্ষ্য অর্জনের পথে অগ্রসর। সরকারপ্রধান যখন একটি কর্মসূচি উদ্বোধন বা নিজহাতে চালু করেন, তখন তার গুরুত্ব বেড়ে যায় বহু গুণ। সেই গুরুত্বের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জনমনকে নাড়া দেয় অবশ্যম্ভাবিভাবে। বই উৎসবও ঠিক তেমনি। নতুন বছরের রৌদ্র-করোজ্জ্বল দিনে প্রধানমন্ত্রী শিশুদের মাঝে পাঠ্যবই বিতরণ কর্মসূচির উদ্বোধন করে যে প্রদীপ্ত আলোর মশাল ছড়িয়ে দেন, তা দ্রুতবেগে সঞ্চারিত হয় দেশের সকল কচি প্রাণে এবং সেখান থেকে বড়দের মনেও। বিনা মূল্যে বই বিতরণ উৎসব দৃশ্যত একটি আনন্দের উপলক্ষ হলেও এর গূঢ় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সুদূরপ্রসারী; তা হলো শিক্ষার বুনিয়াদ প্রাথমিক শিক্ষাকে টেকসই করে এক মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো। কারণ প্রাথমিক শিক্ষাকে সহজলভ্য ও ফলপ্রসূ করতে না পারলে পরবর্তী ধাপের শিক্ষার ভিত্তিও নড়বড়ে থাকে।
বাংলাদেশে শিক্ষা বিস্তারে সরকার আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। স্মরণযোগ্য, স্বাধীনতার সূচনালগ্নে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে মহান দেশনায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিরক্ষরতা দূরীকরণ তথা শিক্ষার বহুমাত্রিক বিস্তারে যে পরিকল্পিত কার্যক্রম হাতে নিয়েছিলেন, তারই পল্লবিত-সম্প্রসারিত রূপ দ্যুতি ছড়াচ্ছে তারই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক প্রচেষ্টায়। স্বাধীনতার আগে পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরে পূর্ব পাকিস্তানে একটিও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু এক অধ্যাদেশবলে ৩৭ হাজার প্রাইমারি স্কুল জাতীয়করণ তথা সরকারি করেন। এছাড়া তার সরকার ১১ হাজার প্রাইমারি স্কুল স্থাপন এবং ৪৪ হাজার প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের চাকরি সরকারিকরণ করেন। বঙ্গবন্ধু পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে পাঠ্যবই ও গরিব মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিনা মূল্যে পোশাক প্রদানের ব্যবস্থা করেছিলেন প্রাথমিক শিক্ষাকে দৃঢ়ভিত্তি দেয়ার সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়েই; যে লক্ষ্য দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই তিনি লালন করতেন। তাই তো ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে টেলিভিশনে দেয়া ভাষণে তিনি বলেছিলেন, সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা খাতে পুঁজি বিনিয়োগের চেয়ে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর কিছু হতে পারে না এবং নিরক্ষরতা অবশ্যই দূর করতে হবে। তাঁর এই সুনির্দিষ্ট অভিপ্রায় স্বাধীন দেশে তিনি বাস্তবে রূপ দিতে শুরু করেছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতের চেয়ে শিক্ষা খাতে সাত শতাংশ অর্থ বেশি বরাদ্দ রেখেছিলেন শিক্ষাপ্রসারে তাঁর লক্ষ্যকে অগ্রাধিকার প্রদানের কারণেই। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানের ১৭নং অনুচ্ছেদে একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, সমাজের প্রয়োজনের সঙ্গে শিক্ষাকে সংগতিপূর্ণ করা এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন, যা এখনও প্রাসঙ্গিক ও পালনীয়।
বঙ্গবন্ধুর এসব প্রয়াসেরই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাইমারি স্কুল জাতীয়করণ করেন। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা সরকারি কর্মচারী হিসেবে সমাজে মর্যাদার সঙ্গে অধিষ্ঠিত হন; হতাশা-গ্লানির কুয়াশা ভেদ করে তাদের সামনে দ্যুতি ছড়ায় সূর্যকরোজ্জ্বল সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ। তিনি বঙ্গবন্ধু-আমলের প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বিনা মূলে বই দেয়ার কার্যক্রমকে আরও সম্প্রসারিত করেছেন। এখন ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুল-মাদ্রাসার সব শিক্ষার্থীকে বিনা মূল্যে বই প্রদান করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী প্রতিবছর জানুয়ারি মাসের শুরুতে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে উৎসবমুখর পরিবেশে বই তুলে দেন এবং সরাদেশে একযোগে বই পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। এসময় যে আনন্দ-উৎসবময় পরিবেশের সৃষ্টি হয় সারাদেশে, তা অভূতপূর্ব; এ উৎসব এখন ‘বই উৎসব’ নামে নন্দিত হয়েছে এবং পরিচিতি লাভ করেছে। এটি এখন ‘জাতীয় উৎসবের’ মর্যাদা লাভ করেছে। এই কর্মসূচি শিক্ষার্থীদের মাঝে যেমন প্রবল জ্ঞানস্পৃহা জাগ্রত করছে, তেমনি অভিভাবকদেরও সচেতন ও উৎসাহিত করছে তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর জন্য।
বিনা মূল্যে বই বিতরণ, শিক্ষা-উপবৃত্তি প্রদান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংস্কার/আধুনিকায়ন প্রভৃতি পদক্ষেপ ছাড়াও প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত উৎকর্ষের দিকেও নজর দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর গতিশীল নির্দেশনা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সতর্ক ব্যবস্থাপনায় তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত এখন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পরিদর্শন-তদারকি-মনিটরিং-মূল্যায়ন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেগবান ও সিস্টেমেটিক হয়েছে। এই ব্যবস্থা প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে সহায়তা করছে। শিক্ষার্থীদের জন্য পুষ্টিসমৃদ্ধ বিস্কুট বিতরণসহ অন্য নানা ধরনের সুযোগ সৃষ্টি করে তাদের বিদ্যালয়ের প্রতি আকৃষ্ট করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যাপারেও সরকারের নিবিড় উদ্যোগ লক্ষণীয়। আজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকদের সংখ্যা প্রচুর। তাদের প্রশিক্ষণলব্ধ দক্ষতা শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মানোন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এখন প্রতিটি গ্রামেই প্রাইমারি স্কুল রয়েছে এবং অধিকাংশ প্রাইমারি স্কুলই সরকারিকরণ করা হয়েছে। দেশে প্রাইমারি স্কুলের সংখ্যা এক লাখ ১৮ হাজার ৮৯১টি এবং সেসব স্কুলের শিক্ষকের সংখ্যা ছয় লাখ ৯৭ হাজার ২০৩। দেশজুড়ে প্রাথমিক শিক্ষাকে ঘিরে বিশাল এক কর্মযজ্ঞ চলছে। শুধু সংখ্যায় নয় শিক্ষার মানও বেড়েছে; উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হারও। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মহিলা শিক্ষকের সংখ্যা চার লাখ তিন হাজার ১৯১। ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা তিন কোটি ৮১ লাখ ২৭ হাজার ৬৩০ এবং বই বিতরণ করা হবে ৩০ কোটি ৭০ লাখ ৮৩ হাজার ৫১৭টি।
আর মাত্র কদিন পরেই আসছে পাঠ্যপুস্তক উৎসবের সেই শুভলগ্ন। শিক্ষার্থীরা হাতে পাবে নতুন বই; তার ম-ম সুরভিতে ভরে উঠবে তাদের মন। এদিন প্রধানমন্ত্রী একটি নির্দিষ্ট স্থানে গুটিকয়েক শিক্ষার্থীর হাতে বই তুলে দিয়ে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের সব শিশুর মাঝেই বই তুলে দেবেন; তার হাতের স্পর্শ আর প্রাণঢালা আদর পৌঁছে যাবে সবার কাছে। সফল হোক ২০২৪ বই উৎসব; শুভ হোক ২০২৪ সাল।
পিআইডি নিবন্ধ