প্রতিনিধি, বগুড়া: ‘বিশত’ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বিশেষ অনুষ্ঠান উদ্যাপনের ঐতিহ্যগত একটি পোশাক। ২০২২ সালে কাতার বিশ্বকাপে অধিনায়ক লিওনেল মেসির গায়ে পরিয়ে দেয়া হয় বিশত। সে সময় পোশাকটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। শত শত বছর ধরে উপসাগরীয় দেশগুলোয় বিশেষ সব অনুষ্ঠানে পরা হয় পোশাকটি। সুদূর আরবের ঐতিহ্যবাহী এ পোশাক বাংলাদেশের বগুড়ার এক পল্লিগ্রামে তৈরি হচ্ছে। নিয়মিত সরবরাহও হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে। আসন্ন ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে জেলার বিশত কারিগরদের ব্যস্ততাও বেড়েছে ব্যাপকভাবে।
জানা যায়, ২০০০ সাল নাগাদ শ্রমিক হিসেবে সৌদি আরবে যান নুর আলম। সেখানে ‘বিশত’ নামে বিশেষ ধরনের এক পোশাক তৈরির কারখানায় কাজ করেন তিনি। পাতলা কাপড়ে বিভিন্ন ধরনের সুতা দিয়ে নকশা করা তার কাজ ছিল। একপর্যায়ে ‘বিশত’ তৈরিতে হাতের কাজের সবগুলোয় দক্ষ হয়ে ওঠেন তিনি।
সৌদিতে কাজ করার কয়েক বছর পর নূর আলম কাতারে যান। সেখানেও নুর আলম এই বিশেষ ধরনের পোশাক তৈরির কারখানায় কাজ শুরু করেন। পরে সেখানকার মালিককে প্রস্তাব দেন, এমন একটি কারখানা তিনি বাংলাদেশে স্থাপন করতে চান। দেশে কম মূল্যের শ্রমিক দিয়ে কাজ করাতে চান। তখন তার কাতারের তৎকালীন মালিক রাজি হলে দেশে এসে নুর আলমসহ ১০ শ্রমিক মিলে বিশত তৈরির কাজ শুরু করেন।
নুর আলম এখন দেশে থাকেন না। বেশিরভাগ সময় কাতার কিংবা সৌদি আরবে থাকেন। কারণ কাতারে ‘বিশত’ বিক্রি হয় বেশি। তার মেয়ে জামাইও একই কারণে কাতারে থাকেন। আর সৌদি আরবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা দোকানে তিনি দেশে তৈরি ‘বিশত’ পাইকারি মূল্যে জোগান দেন।
বিশত আল নুর কারখানার কলেবর বাড়ছে। দুবছর আগেও যেখানে কাজ করতেন ৩০ জন, এখন সেখানে নারী-পুরুষ মিলে ৫০ শ্রমিক কাজ করছেন। আর এই কারিগররা সবাই স্থানীয়। ‘বিশত’ তৈরি করে এই শ্রমিকরা অনেক সচ্ছলও হয়েছেন। অনেকে নিজেদের পড়ালেখার খরচ এখান থেকেই বহন করছেন।
কারখানার কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ‘কাঁচামাল’ কাপড় থেকে পূর্ণ একটি ‘বিশত’ তৈরি হতে ছয়টি ধাপ পার করতে হয়। ঐতিহ্যবাহী এই পোশাক তৈরি করতে একজন শ্রমিকের অন্তত সাত দিন সময় লাগে। প্রথমে কাপড় কেটে নিয়ে সেখানে নকশার কাজ শুরু করতে হয়। নকশার প্রথম ধাপকে বলা হয় হেলা। এরপর করা হয় তোপ তাশরিফ। ব্রুজ, মাকসার, বরদাক, সিলালাসহ প্রায় আট ধরনের নকশার সমন্বয়ে পূর্ণতা পায় ‘বিশত’।
হাপুনিয়া গ্রামের আব্দুল্লাহ আল মুরাদ ইংরেজি বিভাগে সম্মান তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন। পাশাপাশি ‘বিশত’ তৈরির কাজ করে নিজের পড়ালেখার খরচ চালান। বিশত তৈরির প্রথম ধাপের অংশ যাকে হেলা (নকশার নাম) বলে, সেই কাজটি করেন মুরাদ। জানান, এখানে প্রতিদিন একটি করে বিশতের কাজ শেষ করার চেষ্টা করা হয়। বিশত তৈরির প্রথমে হেলার কাজ হয়। সেটি করে কলারের খেজুরের (নকশার নাম) সেলাই হয়। একটি বিশত তৈরি করতে মোটামুটি আট ধাপে কাজ করতে হয়।
কারখানার পাশের বাসিন্দা রিহাদ হোসেন ২০২২ সালে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে ডিপ্লোমা করে দুটো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছিলেন। কিন্তু আট মাস হলো বাড়ির পাশের এই বিশত কোম্পানিতে যুক্ত হয়েছেন। কাজ করছেন তোপ তাশরিফ সেলাইয়ের।
রিহাদ হোসেন বলেন, ঈদের সময় এই কাজের চাহিদা বাড়ে। কোরবানির ঈদ পর্যন্ত চলবে বিশত তৈরির চাহিদা। এরপরও সারা বছর ধরে এই কাজ চলে। একেকটি সেলাইয়ের কাজ করতে দেড় দিন সময় লাগে। আমরা যারা নতুন, তাদের একটি বিশতে তোপ তাশরিফের কাজ শেষ করতে দুদিন লাগে। একটি বিশতের কাজ করে এক হাজার টাকা পাওয়া যায়। মাসে ১০-১২টি কাজ করা সম্ভব হয়।
নুর আলমের কারখানায় শুধু পুরুষ শ্রমিক নেই। অন্তত ১০ জন নারী এই কাজ করছেন। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের সংসারে আয়ের জোগান দিচ্ছেন।
মোছা. তাসলিমা বলেন, আলহামদুলিল্লাহ এখানে কাজ করে সংসার অনেক ভালো চলে। আমি এখানে তিন বছর ধরে কাজ করি। সপ্তাহে দুই হাজার ৫০০ টাকা করে পাই।
সারা বছর চাহিদা থাকলেও ঈদ উপলক্ষে কাজের পরিমাণ বেড়েছে। এই চাহিদা ঈদুল আজহা পর্যন্ত থাকবে বলে জানান কারখানার ব্যবস্থাপক ও মালিকের মেয়ে জামাই মেহেরুল ইসলাম তুষার।
নুর আলম ও তার বড় মেয়ের জামাই রবিউল ইসলাম মধ্যপ্রাচ্যের ব্যবসা ও বিশতের অর্ডার নেয়ার কাজ করেন। আর দেশের অংশটি দেখেন ছোট মেয়ের জামাই তুষার।
মেহেরুল ইসলাম তুষার বলেন, আমাদের চাহিদা ভালো। এখন যে কাজ শুরু হয়েছে, সেটি কোরবানির ঈদ পর্যন্ত চলবে। এই বিশতের দামটা ফিক্সড নয়। জরির কাজের ওপর এর দাম নির্ধারণ হয়। তারপরেও একেকটি বিশত ৩০-৪০ হাজার টাকা দামে বিক্রি হয়।
বিশতের বাজার সম্পর্কে এই ব্যবস্থাপক জানান, মধ্যপ্রাচ্যের যে পাঁচটি মুসলিম দেশ আছে, সেখানে এর চাহিদা রয়েছে। আমাদের দেশে বিশতের কোনো চাহিদা নেই। বছরে কত টাকার বিশত হয়, এটা সঠিক বলা যাবে না। কারণ এটা কারিগরের ওপর নির্ভর করে। তবে বছরে গড়ে এক হাজারটি বিশত তৈরি করা যায়।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশনের (বিসিক) বগুড়া কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক একেএম মাহফুজুর রহমান বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের এই বিশত ওখানকার অনেক ডিমান্ডের পোশাক। আমাদের বগুড়ায় এটি তৈরি হচ্ছে। এই কাজটি বগুড়ায় প্রসারিত হচ্ছে। এই একটি কারখানার দেখাদেখি সেখানে আরও দুটি কারখানা স্থাপিত হয়েছে। তিনটি কারখানায় প্রায় শতাধিক শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে এর মাধ্যমে।