বগুড়ায় প্রথম ফুডকোর্ট গড়ে উঠেছে রানার প্লাজার সপ্তম তলায়। ফুডকোর্টে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ১৭টি খাবারের দোকান রয়েছে। এখানকার বেশিরভাগ দোকানের মালিক নারী। পরিচালনাও করেন তারা। রাজধানীর শপিং মলের ফুডকোর্টের মতো এখানেও ক্রেতাদের বসার জন্য সব দোকানের সামনে চেয়ার-টেবিল সাজানো রয়েছে। অনেক দোকানের ভেতরেও বসার জায়গা রয়েছে। তবে এ ফুডকোর্টের বিশেষত্ব হচ্ছে, যে দোকানের খাবার অর্ডার করা হবে, সেই দোকানের সামনের চেয়ারেই যে বসতে হবে এমন নিয়ম বেঁধে দেওয়া নেই এখানে। তাই নিজেদের পছন্দমতো জায়গায় বসতে পারেন সবাই।
বছরের পর বছর বিভিন্ন পেশায় পুরুষের পাশাপাশি নারীও এগিয়ে চলেছে সমান তালে। তবে একই ছাদের নিচে নারীর ব্যবসা পরিচালনা করা বগুড়ায় একেবারে নতুন। শহরের রানার প্লাজা শপিং কমপ্লেক্সে একসঙ্গে খাবারের ব্যবসা করছেন ১২ নারী। আর এর মধ্যে ছয় নারী নিজ উদ্যোগে ব্যবসা করছেন। আর অন্যরা তাদের স্বামীর ব্যবসা পরিচালনা করছেন।
এক বছর আগে ফুডকোর্টে প্রথম দোকান খোলেন শাহানাজ। তার স্বামী ছিলেন বিদ্যুৎ বোর্ডের (পিডিবি) প্রকৌশলী। চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জেলায় বদলি হতেন স্বামী কাজের প্রয়োজনে প্রায় সারা দিন বাইরে থাকতেন। তাই সময় কাটাতে শাহানাজ সেলাই আর রান্নার শখে ডুবে থাকতেন। ঘরে বসে নিজ হাতে নতুন রান্নার প্র্যাকটিস করতে লাগলেন। তার রান্না করা খাবার খেয়ে মানুষ প্রশংসা করতেন। তখন থেকেই তার ব্যবসার প্রতি আগ্রহ জন্মে। নিজে কিছু করার স্বপ্ন দেখা শুরু করেন। সরকারি কোয়ার্টারের অনেক নারীর সঙ্গে ভাব জমে যেত। তাদের সঙ্গী করে প্রায়ই রান্না প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন। এভাবে চলতে চলতে একদিন বগুড়ায় শখের বশে তিনি একটি রেস্টুরেন্ট চালু করেন। নাম দিলেন ‘শখ’।
শখ নিয়ে সময় কাটানো থেকেই এখন সফল একজন উদ্যোক্তা শাহনাজ ইসলাম। বগুড়া শহরের অভিজাত এলাকা জলেশ্বরীতলায় তিনি প্রথম চাইনিজ রেস্টুরেন্ট চালু করেন। এপর তিনি শহরের নবাববাড়ি রোডের রানার প্লাজায় ফুডকোর্টে শখ রেস্টুরেন্টেরই আরেকটি শাখা খোলেন। দুই প্রতিষ্ঠানেরই এখন বেশ নামডাক। রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় তিনিই প্রথম নারী উদ্যোক্তা। তাকে অনুসরণ করে আরও কয়েক নারী একসঙ্গে একই ছাদের নিচে নারীবান্ধব পরিবেশে তৈরি ফুডকোর্ট চালু করেন।
শাহানাজ বলেন, সব শ্রেণির মানুষের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে আমিই প্রথম বগুড়ায় চাইনিজ সেট মেন্যু চালু করি। আমার ‘শখ’-এ রয়েছে প্রায় ২৫টি আইটেম। ক্রেতাদের পছন্দের শীর্ষে রয়েছে বার্গার, নাচোস, স্যুপ, চওমিন, অন্থন প্রভৃতি।
শাহানাজের পরে ফুডকোর্টে দোকান খোলেন তহমিনা পারভীন শ্যামলী। রেস্টুরেন্টের নাম দিয়েছেন ম্যান্ডোলিন ক্যাফে। বগুড়ার প্রাণকেন্দ্র সাতমাথার সপ্তপদী মার্কেটের তৃতীয় তলায় ১৯৮৯ সালে প্রথম চাইনিজ রেস্তোরাঁ চালু করেন তার বাবা ব্যবসায়ী তাইফুল ইসলাম তোহা। পৌরসভানিয়ন্ত্রিত মার্কেটটির সময়সীমা শেষ হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়। শ্যামলী বলেন, বাবার প্রতিষ্ঠানটি বাঁচিয়ে রাখতে রানার প্লাজায় আমার রেস্টুরেন্টের নাম রেখেছি ম্যান্ডোলিন। তিনি আরও বলেন, বাবার ঐতিহ্য শুধু ছেলেরাই কেন ধরে রাখবে, মেয়েরা নয় কেন এ চিন্তাধারা থেকে এ ব্যবসায় এসেছি। তার মতে, নারী কোনো কাজে অংশ নিলে বাধা আসে। সমস্যা সমাধান করে এগিয়ে যেতে হবে। সমাধান হিসেবে প্রথমত কৌশল জানতে হবে। তার ম্যান্ডোলিনে চাইনিজ, ফাস্টফুড, ইন্ডিয়ান প্রভৃতি খাবার পাওয়া যায়।
শ্যামলীর পরে ফুডকোর্টে দোকান দেন উম্মে ফাতেমা লিসা। লিসা পরিবারের অনুপ্রেরণায় শখ করে খাবারের দোকান দেন। নাম দেন মাইডাস-৪। লিসা বলেন, আমাদের বাসার আশেপাশে কয়েকটি কফি শপ চালু হয়। প্রায় প্রতিদিনই কোল্ড কফি খেতাম। আর তাদের সঙ্গে কথায় কথায় প্রোসেসিংটা শুনে নিতাম। তারপর বাসায় বানানো শুরু করি। সঙ্গে রাখি বিভিন্ন ফলের জুস। আর তখন থেকে মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে শুরু করে, আমিও কফি শপ চালু করব। কিন্তু কীভাবে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। হঠাৎ বগুড়ার প্রতিষ্ঠিত মাইডাস রেস্টুরেন্টে পার্টনার হওয়ার সুযোগ পাই। যেদিন ডিড সাইন করি, সেদিন মনে হয়েছে আমি স্বপ্নপূরণের পথে। এরপর শুরু হলো আমার কুকিং লাইফ। আমি নিজ উদ্যোগে এ
নারীবান্ধব পরিবেশে মাইডাস-৪ রেস্টুরেন্ট দিই। তার মাইডাসে ক্রেতাদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে হায়দরাবাদের বিরিয়ানি, কাচ্চি বিরিয়ানি, দই-ফুচকা, গ্রিল নানরুটিসহ হরেক আইটেম।
লিসার মতে, আমি মনে করি সব নারীর পায়ের নিচের মাটি শক্ত হওয়া উচিত। আর তাদের মধ্যে থাকা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়া দরকার। আমার এখানে প্রায় ৩৫ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। পুরুষশাসিত সমাজকে বুঝিয়ে দেওয়া উচিত আমরাও পারি।
তাদের দেখানো পথে হাঁটছেন আরও কয়েক নারী উদ্যোক্তা। একই সঙ্গে পরিবারের অনুপ্রেরণায় শখ করে খাবারের দোকান চালু করেছেন ফারহানা, সুমা, বিপাশাসহ আরও অনেকে। নারীবান্ধব পরিবেশে একই ছাদের নিচে ব্যবসার সুযোগ তৈরি হয়েছে, বললেন উদ্যোক্তারা। এক ছাদের নিচে খাবার ব্যবসায় এত নারীর সম্পৃক্ততা বগুড়ায় এটাই প্রথম। নারীবান্ধব পরিবেশে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পেরে নারী উদ্যোক্তারা আনন্দিত। তাদের সময় কাটে আনন্দে। প্রতিদিন শত ব্যস্ততার মাঝেও আন্তরিকতার সঙ্গে সেবা দিয়ে চলেছেন তারা।
পারভীন লুনা, বগুড়া