পারভীন লুনা, বগুড়া: বগুড়ায় ২৪১টি ইটভাটার মধ্যে ২২৪টিরই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই। লোকালয়ে গড়ে ওঠা এসব ইটভাটার ধোঁয়ায় বগুড়ার শাজাহানপুরের সুজাবাদ এলাকার অনেক মানুষ শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। চলতি বছরে জেলার ধুনটের মথুরাপুর ইউনিয়নে ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৫০০ একর জমির ধান। অথচ এসব অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে জোরালো কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের নজির নেই।
পরিবেশ অধিদপ্তরের বগুড়া কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলায় মোট ২৪১টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে বৈধ ইটভাটা মাত্র ১৭টি। বাকি ২২৪টি ইটভাটা অবৈধ। বগুড়া সদরে ১৫টি ইট প্রস্তুতকারী ভাটা রয়েছে। সবগুলোই অবৈধ। একই অবস্থা শাহাজানপুরেও। অবৈধ ৩৭টি ইটভাটা লোকালয়জুড়ে গড়ে উঠেছে। শেরপুরে একটি ইটভাটা বৈধ। অবৈধের তালিকায় সেখানে রয়েছে ৩০টি।
ধুনট উপজেলায় ২৩টি ইটভাটা অবৈধ। সেখানে বৈধ ইটভাটা মাত্র পাঁচটি। সারিয়াকান্দিতে চারটি ইটভাটার সবগুলোই অবৈধ। সোনাতলায় একটি বৈধ থাকলেও অবৈধ রয়েছে চারটি। শিবগঞ্জে দুটি বৈধ ভাটার বিপরীতে অবৈধ রয়েছে ৪৫টি। গাবতলীতে বৈধ ইটভাটা রয়েছে পাঁচটি। অবৈধের তালিকা বেশ বড়। সেখানে আইন অমান্য করে ৪০টি ইটভাটা বহল তবিয়তে। দুপচাঁচিয়ায় একটি বৈধ ইটভাটার বিপরীতে আটটি অবৈধ ভাটা রয়েছে। কাহালুতে দুটি বৈধ, অবৈধ ১০টি। আদমদীঘিতে আটটি ইটভাটা পরিবেশ অধিদপ্তরে তালিকায় রয়েছে। সেখানে সবগুলোই অবৈধ।
ইটভাটা মালিকদের দাবি, পরিবেশের ছাড়পত্র নেয়া কিংবা নবায়ন করা প্রক্রিয়া খুব জটিল। অনেক সময় আবেদন করেও ছাড়পত্র নবায়ন হয় না। এ কারণে অবৈধ ইটভাটাগুলো বৈধ করা যাচ্ছে না।
এতগুলো ইটভাটা বছরের পর বছর ধরে অবৈধভাবে চালু রয়েছে। যদিও পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, তারা আইন অনুযায়ী অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বলছে, ‘প্রশাসন কিংবা পরিবেশের নাকের ওপর দিয়ে এতগুলো ইটভাটা বছরের পর বছর ধরে চলছে। অথচ তারা এখনও আইনের কথা বলে মানুষের মগজ ধোলাইয়ের ভূমিকায় রয়েছে।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) বগুড়া জেলার সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান বলেন, ‘অবৈধভাবে এতগুলো ইটভাটা জেলায় কীভাবে চলে? পরিবেশের জন্য হুমকি এসব ইটভাটার বিরুদ্ধে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যবস্থা না নিলে এর সঙ্গে জড়িত সরকারি কর্মকর্তাদের জবাবহিদির আওতায় আনতে হবে। জনজীবনের ক্ষতিসাধন করে কোনো অবৈধ ইটভাটা চলতে পারে না।’
ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় শাজাহানপুরের সুজাবাদ এলাকায় গাছের পাতা পুড়ে গেছে। গাছেই লিচু অর্ধেক পচে গেছে। ধান পাকার আগেই শুকিয়ে গেছে। বেগুনের ক্ষেতের অবস্থা নাকাল। বাঁশ, বিভিন্ন প্রজাতির গাছ এমনকি টিনের চাল পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কলাবাগানের পাতাগুলোও পুড়ে গেছে। এলাকাবাসীর দাবি, বিষাক্ত ধোঁয়া নির্গতের কারণে মাঠের ঘাসও বিষাক্ত হচ্ছে। এমনকি ঘাস থেকে গবাদিপশুগুলোও অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
ধুনটের মথুরাপুর ইউনিয়নের খাদুলী, কুড়িগাতি, উজাল শিং গোবিন্দপুর ও জোলাগাতী গ্রামের মাঝখানে প্রায় ৫০০ মিটার এলাকার ভেতর তিন ফসলি জমিতে অনুমতি ছাড়াই অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে আটটি ইটভাটা। এসব ইটভাটার মালিকরা শুধু উপজেলা কৃষি অফিসের ছাড়পত্রের ওপর ভিত্তি করে গড়ে তুলেছেন একতা, ফাইভ স্টার, বস, গ্রামীণ, আদর্শ, বন্ধু, বিবিসি ও দিগন্ত নামে ইটভাটাগুলো।
গত মে মাসে এসব ভাটা থেকে নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়ার কারণে উপজেলায় প্রায় দেড় হাজার বিঘা জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সে সময় ফসলের ক্ষতি হওয়ার কথা স্বীকারও করেন গ্রামীণ ইটভাটার মালিক ফরিদুল ইসলাম।
অবৈধ ইটভাটার কথা স্বীকার করেছেন জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ। এমনকি গাবতলীর গোলাবাড়ি এলাকায় তার নিজের ইটভাটারও পরিবেশের ছাড়পত্র নবায়ন করা নেই। তিনি বলেন, ‘আমাদের ভাটাগুলো আইনকানুন মেনেই চলছে। ছাড়পত্র না দিলে প্রশাসনের সঙ্গে তো যুদ্ধ করা যাবে না। সরকার চাইলে এখন ভেঙে দিতে পারে। আমাদের করার কিছু নেই। ভাটাগুলো ভেঙে দিলে মানুষ কষ্ট পাবে। উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন উন্নয়ন করতে গেলে ইটের দরকার। এই যে বগুড়া অঞ্চলে ফোরলেন হচ্ছে; এখানে কোটি কোটি ইট লাগবে। কোথায় পাবে সরকার। এখন সরকার উন্নত ইট তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু এর জন্য কাঁচামাল ভারত থেকে আনতে হবে। তাহলে ইটের দামও বৃদ্ধি পাবে। গ্রামের সাধারণ মানুষের ওপর দামের প্রভাব পড়বে।’
রাজশাহী বিভাগীয় ইটভাটা মালিক সমিতির আহ্বায়ক সদরুল ইসলাম বলেন, ‘ইটভাটায় পরিবেশের ছাড়পত্র নিতে ব্যাংকে ২৫ হাজার টাকা জমা দিতে হয়। আমরা ২৫ হাজার টাকা জমা দিয়ে ছাড়পত্র নেয়ার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু তা হয় না। কারণ এই প্রক্রিয়া খুব জটিল। এ কারণে অনেক আবেদন পড়ে আছে অফিসে। মূলত ভোগান্তির কারণে ছাড়পত্র নবায়ন হয় না। আমরা চাই, ঝুলিয়ে না রেখে সরকার সরাসরি একটি সিদ্ধান্ত দিক। হয় ইটভাটা নবায়ন হবে অথবা হবে না।’
এসব অবৈধ ইটভাটার বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক সুফিয়া নাজিম বলেন, ‘আমি এই অফিসে নতুন যোগদান করেছি। এর মধ্যেই বিভিন্ন ফাইল দেখাশোনা শুরু করেছি। অবৈধ কোনো প্রতিষ্ঠান বা স্থাপনা থাকলে তা আমি দেখব এবং ব্যবস্থা নেব।’