কাজী সালমা সুলতানা: ১১ মার্চ ১৯৭১। বাঙালি জাতির মুক্তির আন্দোলনে আরও উত্তাল হয়ে পড়ে দেশ। গণ আন্দোলনে দিশেহারা হয়ে পড়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী। স্বাধীন বাংলার দাবিতে অবিচল সর্বস্তরের
মানুষ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশে অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত থাকে। পূর্ববাংলায় পাকিস্তানের শাসনের কোনো দৃশ্যমান অস্তিত্ব নেই। অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে হাইকোর্টের বিচারপতি এবং জনপ্রশাসনের সচিবসহ সারা বাংলায় সরকারি ও আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানের সর্বস্তরের কর্মচারী অফিস বর্জন করেন।
আজও সচিবালয়ে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ে। এ ছাড়া মুখ্য সচিবের বাসভবন, প্রধান বিচারপতির বাসভবনসহ সব সরকারি ও আধা সরকারি ভবন এবং বাসাবাড়িতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়তে থাকে।
ওয়ালীপন্থি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) পূর্ববাংলা শাখার সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, আওয়ামী লীগ পাঞ্জাব শাখার সভাপতি এম খুরশীদ, কাউন্সিল মুসলিম লীগপ্রধান মমতাজ দৌলতানার বিশেষ দূত পীর সাইফুদ্দিন ও ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি কে উলফ আজ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর ধানমন্ডির বাসভবনে পৃথক বৈঠক করেন। বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের সহকারী আবাসিক প্রতিনিধির কাছে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সমরসজ্জায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
সংগ্রামী জনতা এ-দিন সেনাবাহিনীর রসদ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর স্বাভাবিক সরবরাহে বাধার সৃষ্টি করে। সিলেটে রেশন পরিবহনের সময় সেনাবাহিনীর একটি কনভয়কে বাধা দেয়া হয়। যশোরেও একই ধরনের ঘটনা ঘটে।
রাতে সামরিক কর্তৃপক্ষ ১১৪নং সামরিক আদেশ জারি করে। এ আদেশে বলা হয়, কেউ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারি সম্পত্তির ক্ষতিসাধন করলে অথবা সশস্ত্র বাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণে বা সেনাবাহিনীর গতিবিধিতে অন্তরায় সৃষ্টি করলে তাদের কার্যকলাপ আক্রমণাত্মক কাজের শামিল বলে গণ্য হবে। এ ধরনের ঘটনা সংশ্লিষ্ট সামরিক বিধি অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
এদিন টাঙ্গাইলে বিন্দুবাসিনী হাইস্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত জনসভায় ন্যাপপ্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান সাত কোটি বাঙালির নেতা। তার নির্দেশ পালন করুন। লক্ষ্য অর্জনে সবাই ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়–ন। এ মুহূর্তে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো রকম বিরোধ থাকা উচিত নয়। জনগণ এখন নিজেদের অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।
এদিন পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচি থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে একটি তারবার্তা পাঠান। এতে তিনি বলেন, উদ্ভূত ঘটনাবলিতে আমি গভীরভাবে মর্মাহত ও উদ্বিগ্ন। আমরা আজ বিরাট সংকটের মুখোমুখি। দেশের ভবিষ্যৎ আজ অনিশ্চিত। এ ব্যাপারে আমাদের উভয়ের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। ধ্বংস এড়ানোর জন্য সম্ভাব্য সবকিছুই আমাদের করতে হবে। যেকোনো মূল্যে দেশকে রক্ষা করতে হবে।
করাচিতে গণঐক্য আন্দোলনের নেতা এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, খুব দ্রুত পটপরিবর্তন ঘটছে। দেশকে বিচ্ছিন্নতার হাত থেকে রক্ষা করতে হলে শিগগিরই ব্যবস্থা নিতে হবে। আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমানই কার্যত এখন ঢাকার সরকার। সেখানে সব সরকারি কর্মচারী ও সচিব তার নির্দেশ পালন করছেন। ঢাকায় কেবল সামরিক সদর দপ্তরে পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে। তিনি আরও বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর করা না হলে দেশের দুই অংশকে এক রাখা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সমরাস্ত্রসহ একটি জাহাজ ১০ মার্চ চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে নোঙর করে। এর প্রতিবাদে ১১ মার্চ ‘স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’-এর চার ছাত্রনেতা ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ, ডাকসুর সহসভাপতি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন জনগণকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান।
এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির এক সভায় মুক্তিসংগ্রামের প্রতি সমর্থন দেয়ার জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আবেদন জানানো হয়। গণ আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের এক দিনের বেতন আওয়ামী লীগের ত্রাণ তহবিলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। অপরদিকে গণহত্যার প্রতিবাদে বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর পাকিস্তান সরকারের এক চিত্রপ্রদর্শনীতে যোগদানে অস্বীকৃতি জানান। তিনি দেশের অন্যান্য চিত্রশিল্পীকেও এ প্রদর্শনীতে যোগদানে বিরত থাকার আহ্বান জানান। এদিন কুমিল্লা কারাগার থেকে পালাতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন পাঁচ কয়েদি। অন্যদিকে বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগার ভেঙে ২৪ কয়েদি পালিয়ে যান।
তথ্যসূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের দলিলপত্র, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর