Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 10:28 pm

‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শোনার পর পাকিস্তানিদের হঠানোর সিদ্ধান্ত নেই’

মফিজ জোয়ার্দ্দার, চুয়াডাঙ্গা: বীর প্রতীক সুবেদার মেজর (অব.) সাইদুর রহমান ১৯৬৯ সালের ২৭ মার্চ তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে (ইপিআর) চুয়াডাঙ্গায় যোগদান করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় অবস্থান করেন যশোর ইপিআর হেডকোয়ার্টারে। স্বাধীনতা ঘোষণার আগে ২৩ মার্চ যশোর ইপিআর হেডকোয়ার্টার থেকে তিনিই প্রথম পতাকা উত্তোলন করেন। ৮নং সেক্টরের ফার্স্ট বেঙ্গলের ডি কোম্পানির ১১নং প্লাটুনের মেজর হাফিজের নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশ নেন তিনি। পরে ১১নং সেক্টরে মেজর জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে সিলেটের কানাইঘাটে যুদ্ধে অংশ নেন। তার উল্লেখযোগ্য অপারেশনের মধ্যে যশোর চাঁচড়ার মোড় অপারেশন, নড়াইল অপারেশন, কামারখালী ঘাট অপারেশন, ফরিদপুরের বোয়ালমারী অপারেশন, সাতক্ষীরার ভোমরা অপারেশন ও সিলেট অপারেশন অন্যতম। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বড় অপারেশন জামালপুরের ধানিয়া কামালপুরে। এ যুদ্ধে ৮২ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং পেটে গুলি লেগে সাইদুর রহমান মারাত্মকভাবে আহত হন। পরে আসামের গোহাটিতে এক মাস চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে ফিরে আবার যুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করেন। স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষে বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার সাইদুর রহমানের বিশেষ সাক্ষাৎকার শেয়ার বিজের চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রতিনিধি মফিজ জোয়ার্দ্দার।

এসময় নিজের ছেলেবেলা সম্পর্কে সাইদুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘দুই বোনের পর আমার জন্ম। বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে হিসেবে খুব আদরের ছিলাম। বেশি আদরের কারণে ডানপিটে এবং প্রতিবাদী ছিলাম। কোনো অন্যায় দেখলে সহ্য হতো না। সেটার প্রতিবাদ করতাম।’

যুদ্ধ যাওয়ার সিদ্ধান্ত আর প্রথম দিকের স্মৃতি নিয়ে তিনি বলেন,  যখন অষ্টম শ্রেণি পাস করি তখন বয়স ছিল ২০ বছর। ওই সময় পশ্চিম পাকিস্তানিদের অত্যাচার, জুলুম, বৈষম্য খুব নাড়া দিত। তখন পরিকল্পনা নিলাম কোনো একটা বাহিনীতে যোগ দিয়ে এর প্রতিবাদ করতে হবে। সে পরিকল্পনা থেকেই ১৯৬৯ সালের ২৭ মার্চ ইপিআরে যোগ দিই। চাকরিতে যোগদানের পর ছয় মাস ট্রেনিং শেষে আমার প্রথম পোস্টিং হয় খুলনায়, ৫ উইংয়ে। এরপর আমাকে পোস্টিং দেওয়া হয় বেনাপোল সি কোম্পানিতে। এরপরই শুরু হয় পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন। এটি মনকে বিশেষভাবে নাড়া দেয়। পরে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শোনার পর সিদ্ধান্ত নিই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেব। ২৩ মার্চ সকাল ৮টায় আমি যশোর ইপিআর হেডকোয়ার্টারে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করি। ২৫ মার্চ যখন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় তখনই পাঞ্জাবিরা টহল শুরু করলো। বাঙালি মেয়েদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সেক্টর গার্ডের সামনে দিয়ে যশোরে। তখন বাঙালি মেয়েরা আমাদের বলছিলো ইপিআর ভাইয়েরা আমাদের বাঁচান। ওই সময় আমার ডিউটি ছিল। আমি বাঙালি মেয়েদের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর গুলিবর্ষণ করি। ওই সময় থেকে আমার মনে একটা জেদ চেপে ধরে পশ্চিম পাকিস্তানিদের আর ছাড় দেওয়া যাবে না। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শোনার পর মনে মনে সিদ্ধান্ত নিই যে কোনো মূল্যে ওদের এদেশ থেকে হঠাতে হবে ‘

যুদ্ধদিনের বিশেষ স্মৃতিনিয়ে শেয়ার বিজকে সাইদুর রহমান বলেন, প্রথমে ইপিআর সেক্টরে কর্মরত ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বাঙালি ইপিআর সদস্যরা বিদ্রোহ শুরু করি এবং প্রতিরোধযুদ্ধে যোগ দিই। আমরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ি। আমি ছিলাম ছয় পাউন্ডারগান (ট্যাংকবিধ্বংসী অস্ত্র) ইউনিটের সদস্য। ৩০ মার্চ সন্ধ্যায় সাঁজোয়া যানে পাকিস্তানি সেনারা চাঁচড়ায় আসছিল। তখন আক্রমণ চালাই। আমাদের গোলার আঘাতে দুটি গাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস ও কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। পরে আমি ও আমার সহযোদ্ধারা এফইউপিতে পৌঁছে অ্যাসল্ট ফরমেশন তৈরির আগেই শুরু হয় গোলাবর্ষণ। সেই গোলার কিছু অংশ আমাদের ওপর পড়তে থাকে।

অন্যদিকে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। এতে আমাদের মধ্যে একধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। ১৯৭১ সালের ৩১ জুলাই জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার ধানিয়া কামালপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে কয়েকজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে সব প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে সামনে এগিয়ে যাই। এ সময় আমার অধিনায়ক ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ শহীদ হন। এতে আমাদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। নেতৃত্বশূন্যতায় কেউ কেউ পিছু হটতে থাকেন। কিন্তু আমিসহ কয়েকজন যোদ্ধা পিছু হটিনি। তখন রাগে পাকিস্তানিদের লক্ষ্য করে একটা ব্রাশ ফায়ার করলাম। এতে ৭-৮ জন পাঞ্জাবি মারা যায়।