রকিবুল হুদা মজুমদার: দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মীয়মাণ দেশের প্রথম সুড়ঙ্গপথ ‘বঙ্গবন্ধু টানেল’ তৈরির কাজ শেষের দিকে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে চলতি বছরেই এটি উদ্বোধন করা হবে এবং যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে।
প্রকল্পটি চীনের সাংহাইকে মডেল হিসেবে ধরে গড়ে তোলা হয়েছে, যার লক্ষ্যে হচ্ছে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’। বঙ্গবন্ধু টানেলে মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৪৩ কিলোমিটার। মূল টানেল ছাড়াও রয়েছে পতেঙ্গা ও আনোয়ারা প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক এবং আনোয়ারা প্রান্তে ৭২৭ মিটার একটি উড়াল সেতু। অর্থাৎ সব মিলিয়ে সর্বসাকুল্যে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত কাজের পরিমাণ ৯ দশমিক ৩৩ কিলোমিটার। টানেলটির একটি অংশ চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে অপর প্রান্তের আনোয়ারা অংশের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করবে। টানেলের উত্তর প্রান্ত বা শহরের দিক থেকে পাঁচটি সড়ক দিয়ে আউটার রিং রোড, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কাঠগড় সড়ক, এয়ারপোর্ট সড়ক ও পতেঙ্গা সৈকত সড়ক দিয়ে টানেলে প্রবেশ করা যাবে। অন্যদিকে নদীর দক্ষিণ তীরে আনোয়ারায় রয়েছে কোরিয়ান ইপিজেড, চায়না ইপিজেড, সিইউএফএল, পারকি সমুদ্রসৈকত। কর্ণফুলী পেরিয়ে আনোয়ারা দিয়েই কক্সবাজার, বাঁশখালী, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র ও মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরে যাওয়া যাবে।
বঙ্গবন্ধু টানেল চালু হলে চট্টগ্রাম প্রকৃত অর্থেই বাণিজ্যিক নগরী হয়ে উঠবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, মহেশখালী এলএনজি টার্মিনাল ও বাঁশখালীর কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড গ্রুপের ৩০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হচ্ছে। অন্যদিকে বাঁশখালীতে এস আলম গ্রুপের এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ এগিয়ে চলছে।
কর্ণফুলীর ওপারে বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। এরই মধ্যে ৭৮৩ একর জমি নিয়ে আনোয়ারায় চায়না ইকোনমিক জোন স্থাপিত হচ্ছে। গড়ে উঠছে বেসরকারি শিল্পাঞ্চল। সেখানে উৎপাদনমুখী বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত হবে। এতে বিপুল কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। মীরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল থেকে শুরু করে পুরো দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রামকে নিয়ে এই টানেল একটি ইকোনমিক হাবে পরিণত হবে।
অপরদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে সিটি আউটার রিং রোড দিয়ে পতেঙ্গা প্রান্তে টানেলে প্রবেশ করে আনোয়ারা প্রান্তে পটিয়া-আনোয়ারা-বাঁশখালী সড়কের চাতুরী চৌমুহনী পয়েন্টে ওঠা যাবে। ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে দূরত্ব ও খরচ কমে যাবে এবং সময় সাশ্রয় হবে। এক্ষেত্রে এ পথের গাড়িগুলোকে আর চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করতে হবে না। যার ফলে চট্টগ্রাম শহরের যানজট বেশ কমে আসবে। নির্বিঘœ ও দ্রুত সময়ের যোগাযোগ স্থাপিত হবে। দীর্ঘমেয়াদে এই পুরো চ্যানেলটি এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত হবে, যা যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক অনন্য মাত্রা দেবে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) তথ্যমতে, টানেল দিয়ে বছরে প্রায় ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করবে। চালু হওয়ার তিন বছর পর ওই সংখ্যা দাঁড়াবে এক কোটি ৩৯ লাখে, ২০৫০ সালে যা হবে তিন কোটি ৩৯ লাখ এবং ২০৬২ সালে পাঁচ কোটি পাঁচ লাখ। এর বড় অংশ পূর্বপ্রান্তের শিল্পকারখানার কাঁচামাল, উৎপাদিত পণ্য চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর ও দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে পরিবহনে ব্যবহার করবে। ফলে উৎপাদন খরচ কমবে এবং যথাসময়ে পণ্য জাহাজীকরণে সহায়তা করবে। মোটকথা, একটি কার্যকর আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে।
বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মিত হচ্ছে নদীর তলদেশ দিয়ে। পুরো পথের উভয় পাশেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন করতে পারবেন এ পথ ব্যবহারকারীরা। তাই এ টানেল ঘিরে পর্যটন খাতের অপার সম্ভাবনা তৈরি হবে। টানেলটির একপাশে পতেঙ্গা সৈকত এবং অন্যপাশে রয়েছে পারকির চর। চরের ৭০০ একর জমি নিয়ে কোস্টাল ট্যুরিজম গড়ে তোলা হবে। পতেঙ্গা সৈকতকেও আধুনিকায়নের মাধ্যমে পিকনিক, বার্ষিক ক্রীড়া ও অন্যান্য বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান করার উপযোগী করে গড়ে তোলা হচ্ছে। সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনের ফলে টানেলের আনোয়ারা পারকির চরসহ আশেপাশের এলাকা পর্যটনশিল্প হিসেবে বিকশিত হবে।
পদ্মা সেতুর পর দেশের আরেকটি বড় অর্জন হবে এই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। এটি দক্ষিণ এশিয়ার সর্বপ্রথম পাতালপথ। এ টানেল আঞ্চলিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করবে। ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
শিক্ষার্থী, ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকস