গতকালের পর
গাজী তৌহিদুল ইসলাম: :এক শোভাযাত্রা করে সবাই হাজির হয়ে কাগজটা ভেতরে পাঠিয়ে দেয়া হলো খাজা সাহেবের কাছে। বঙ্গবন্ধু আবার বক্তৃতা করে সবাইকে চলে যেতে বললেন এবং নিজেও সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে চলে আসার জন্য রওনা করলেন। কিছু দূর এসে দেখলেন, অনেক ছাত্র চলে গিয়েছে। কিছু ছাত্র ও জনসাধারণ তখনও দাঁড়িয়ে আছে আর মাঝে মাঝে সেøাগান দিচ্ছে। তিনি আবার ফিরে গিয়ে বক্তৃতা করলেন। এবার অনেক ছাত্রও চলে গেল। বঙ্গবন্ধুও হলে চলে গেলেন। প্রায় চারটার দিকে খবর পেলেন, আবার বহু লোক জমা হয়েছে, তারা বেশির ভাগ সরকারি কর্মচারী ও জনসাধারণ, ছাত্র মাত্র কয়েকজন ছিল। শামসুল হক সাহেব চেষ্টা করলেন লোকদের ফেরাতে। মাঝে মাঝে হলের ছাত্ররা দু-একজন এমএলএকে ধরে আনতে শুরু করেছে মুসলিম হলে। তাদের কাছ থেকে লিখিয়ে নিচ্ছে, যদি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে না পারেন, তবে পদত্যাগ করবেন। মন্ত্রীরাও বের হতে পারছেন না। খাজা সাহেব মিলিটারির সাহায্যে পেছন দরজা দিয়ে ভেগে গিয়েছিলেন।
বহু লোক আবার জড়ো হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ছুটলেন অ্যাসেম্বলির দিকে। ঠিক কাছাকাছি যখন পৌঁছেছেন তখন লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করতে শুরু করেছে পুলিশ। তার চোখ জ্বলতে শুরু করল, পানি পড়ছে, কিছুই চোখে দেখছেন না। কয়েকজন ছাত্র ও পাবলিক আহত হয়েছে। কয়েকজন তাকে ব্যারাকের পুকুরে নিয়ে চোখে মুখে পানি দিতে শুরু করেছে। এমন সময় দেখলেন মুসলিম হলে হইচই। বাগেরহাটের এমএলএ ডা. মোজাম্মেল হক সাহেবকে ধরে আনা হয়েছে। তাকে ছাত্ররা জোর করছে লিখালেন, তিনি পদত্যাগ করবেন। বঙ্গবন্ধুকে তিনি চিনতেন, বঙ্গবন্ধুও তাকে চিনতেন। বঙ্গবন্ধু ছাত্রদের তাকে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করলেন, তিনি লোক ভালো এবং শহিদ সাহেবের সমর্থক ছিলেন। অনেক কষ্টে, অনেক বুঝিয়ে তাকে মুক্ত করে, রিকশা ভাড়া করে উঠিয়ে দিলেন। হঠাৎ খবর এলো, শওকত মিয়া আহত হয়ে হাসপাতালে আছে। তাড়াতাড়ি ছুটলেন তাকে দেখতে। পুলিশ লাঠি দিয়ে তাকে বেশ মেরেছে। আরও কয়েকজন সামান্য আহত হয়েছে। সবাইকে তিনি বলে আসলেন, একটু ভালো হলেই হাসপাতাল ত্যাগ করতে। কারণ, পুলিশ আবার গ্রেপ্তার করতে পারে।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন শুধু ঢাকায়ই সীমাবদ্ধ ছিল না। ফরিদপুর ও যশোর জেলায় কয়েকশ ছাত্র গ্রেপ্তার হয়েছিল। রাজশাহী, দিনাজপুর, খুলনা ও আরও অনেক জেলায় আন্দোলন হয়েছিল। নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ চেষ্টা করেছিল এই আন্দোলনকে বানচাল করতে, কিন্তু পারেনি। এই আন্দোলন ছাত্ররাই শুরু করেছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু এই আন্দোলনের পরে দেখা গেল জনসাধারণও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে বদ্ধপরিকরÑ বিশেষ করে সরকারি কর্মচারীরাও একে সমর্থন দিয়েছিল। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে একদল গুণ্ডা আক্রমণ করলে পলাশী ব্যারাক থেকে সরকারি কর্মচারীরা এসে তাদের বাধা দিয়েছিল। যার ফলে গুণ্ডারা মার খেয়ে ভাগতে বাধ্য হয়েছিল। পরে দেখা গেল, ঢাকা শহরের জনসাধারণের মনোভাবের অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। সরকার থেকে প্রোপাগান্ডা করা হয়েছিল, কলকাতা থেকে হিন্দু ছাত্ররা পায়জামা পরে এসে এ আন্দোলন করছে। যে সত্তর-পঁচাত্তরজন ছাত্র বন্দি হয়েছিল তার মধ্যে একজনও হিন্দুছাত্র ছিল না। এমনকি যারা আহত হয়েছিল তার মধ্যেও একজন হিন্দু ছিল না। তবু তখন থেকেই যুক্ত বাংলা ও ভারতবর্ষের দালাল, কমিউনিস্ট ও রাষ্ট্রদ্রোহী’Ñ এই কথাগুলো বলা শুরু হয়, ছাত্রদের বিরুদ্ধে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে। এমনকি সরকারি প্রেসনোটেও তাদের এভাবে দোষারোপ করা হতো।
বাংলা ছিল পাকিস্তানের শতকরা ছাপ্পান্ন ভাগ লোকের মাতৃভাষা। তাই বাংলাই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। তবুও ছাত্ররা বাংলা ও উর্দু দুইটা রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেছিল। পাঞ্জাবের লোকেরা পাঞ্জাবি ভাষা বলে, সিন্ধুর লোকেরা সিন্ধি ভাষায়, সীমান্ত প্রদেশের লোকেরা পশতু ভাষায়, বেলুচরা বেলুচি ভাষায় কথা বলে। কিন্তু উর্দু পাকিস্তানের কোনো প্রদেশেরই ভাষা ছিল না। যারা উর্দু ভাষা সমর্থন করে তাদের একমাত্র যুক্তি হলো উর্দু ইসলামিক ভাষা। উর্দু কী করে যে ইসলামিক ভাষা হলো সেটা বুঝাও দুরূহ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। আরব দেশের লোকেরা আরবি, পারস্যের লোকেরা ফার্সি, তুরস্কের লোকেরা তুর্কি, চীনের মুসলমানরা চীনা, ইন্দোনেশিয়ার লোকেরা ইন্দোনেশিয়ন এবং মালয়েশিয়ার লোকেরা মালয়া ভাষায় কথা বলেÑএ সম্বন্ধে অনেক যুক্তিপূর্ণ কথা বলা চলে।
পূর্ব পাকিস্তানের ধর্মভীরু মুসলমানদের ইসলামের কথা বলে ধোঁকা দেওয়া যাবে ভেবেছিল, কিন্তু পারেনি। যেকোনো জাতি তার মাতৃভাষাকে ভালোবাসে। মাতৃভাষার অপমান কোনো জাতিই কোনো কালে সহ্য করেনিই। এ সময় সরকারদলীয় মুসলিম লীগ নেতারা উর্দুর জন্য জানমাল কোরবানি করতে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু জনসমর্থন না পেয়ে একটু ঘাবড়িয়ে পড়েছিলেন। তারা ‘শেষ তাবিজ’ নিক্ষেপ করলেন। জিন্নাহকে ভুল বোঝালেন। এরা মনে করলেন, জিন্নাহকে দিয়ে উর্দুর পক্ষে বলাতে পারলেই আর কেউ এর বিরুদ্ধাচরণ করতে সাহস পাবে না। জিন্নাহকে দলমত নির্বিশেষে সবাই শ্রদ্ধা করতেন। তার যেকোনো ন্যায়সঙ্গত কথা মানতে সবাই বাধ্য ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের জনমত কোন পথে, তাকে কেউই তা বলেননি বা বলতে সাহস পাননি।
১৯ মার্চ জিন্নাহ ঢাকা এলে হাজার হাজার লোক তাকে অভিনন্দন জানাতে তেজগাঁ হাজির হয়েছিল। সেদিন ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুসহ ছাত্ররা সবাই ভিজে গিয়েছিলেন, তবুও ভেজা কাপড় নিয়ে তাকে অভ্যর্থনার জন্য এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করলেন। জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তানে এসে ঘোড় দৌড় মাঠে বিরাট সভায় ঘোষণা করলেন, ‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে।’ বঙ্গবন্ধুসহ প্রায় চার-পাঁচশ ছাত্র এক জায়গায় ছিলেন সেই সভায়। ছাত্ররা হাত তুলে দাঁড়িয়ে জানিয়ে দিল, মানি না। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনে বক্তৃতা করতে উঠে তিনি যখন আবার বললেন, ‘উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে’Ñ তখন ছাত্ররা তার সামনেই বসে চিৎকার করে বলল, ‘না, না, না।’ জিন্নাহ প্রায় পাঁচ মিনিট চুপ করেছিলেন, তারপর বক্তৃতা করেছিলেন। সম্ভবত এই প্রথম তার মুখের ওপরে তার কথার প্রতিবাদ করল বাংলার ছাত্ররা। এরপর জিন্নাহ যতদিন বেঁচেছিলেন আর কোনো দিন বলেনি, উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে।
ঢাকায় জিন্নাহ দুই দলের ছাত্রনেতাদের ডাকলেন। সম্ভবত বাংলা ভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতাদেরও ডেকেছিলেন। তবে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের দুইজন করে প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা করলেন। কারণ, তিনি পছন্দ করেননি, দুইটা প্রতিষ্ঠান কেন হবে এই মুহূর্তে! বঙ্গবন্ধুদের পক্ষ থেকে মিস্টার তোয়াহা আর শামসুল হক সাহেব ছিলেন। জিন্নাহ তাদের প্রতিষ্ঠানের নামটা পছন্দ করেছিলেন। নিখিল পূর্ব পাকিস্তানের কর্মকর্তাদের নাম যখন পেশ করা হয়, তখন তারা দেখিয়ে দিলেন যে, এদের অধিকাংশ এখন চাকরি করে, অথবা লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে। তখন জিন্নাহ তাদের ওপর রাগই করেছিলেন। শামসুল হক সাহেবের সঙ্গে জিন্নাহর একটু তর্ক হয়েছিল, যখন তিনি দেখা করতে যান বাংলা রাষ্ট্রভাষা করার বিষয় নিয়েÑযা শামসুল হক সাহেব বঙ্গবন্ধুকে এসে জানিয়েছিলেন।
জিন্নাহ চলে যাওয়ার কয়েকদিন পরে ফজলুল হক হলের সামনে এক ছাত্রসভা হয়। তাতে একজন ছাত্র বক্তৃতায় বলেছিল ‘জিন্নাহ যা বলবেন, তাই আমাদের মানতে হবে। তিনি যখন উর্দুই রাষ্ট্রভাষা বলেছেন তখন উর্দুই হবে।’ বঙ্গবন্ধু তার প্রতিবাদ করে বক্তৃতা করে বলেছিলেন ‘কোনো নেতা যদি অন্যায় কাজ করতে বলেন, তার প্রতিবাদ করা এবং তাকে বুঝিয়ে বলার অধিকার জনগণের আছে। যেমন হজরত ওমরকে (রা.) সাধারণ নাগরিকরা প্রশ্ন করেছিলেন, তিনি বড় জামা পরেছিলেন বলে। বাংলা ভাষা শতকরা ছাপ্পান্ন জন লোকের মাতৃভাষা, পাকিস্তান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সংখ্যাগুরুদের দাবি মানতেই হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হওয়া পর্যন্ত আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব। তাতে যাই হোক না কেন, আমরা প্রস্তুত আছি।’ সাধারণ ছাত্ররা বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন করল। এরপর পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ও যুবকরা ভাষার দাবি নিয়ে সভা ও শোভাযাত্রা করে চলল। দিন দিন জনমত সৃষ্টি হতে লাগল। কয়েক মাসের মধ্যে দেখা গেল, নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কোনো সমর্থক রইল না। কিছু নেতা রইল, যাদের মন্ত্রীদের বাড়ি ঘোরাফেরা করা আর সরকারের সব কিছুই সমর্থন করা ছাড়া কাজ ছিল না।
এরপর পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি এবং বঙ্গবন্ধুর জীবনে বহু চড়াই উৎরাই, ঘাত প্রতিঘাত অতিক্রান্ত হয়। ১৯৫১ সালের অক্টোবর মাসে মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু যখন জেলে, সেই সময় লিয়াকত আলী খানকে রাওয়ালপিন্ডিতে এক জনসভায় গুলি করে হত্যা করা হয়। খাজা নাজিমুদ্দীন গভর্নর জেনারেলের পদ ছেড়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হলেন এবং গোলাম মোহম্মদ অর্থমন্ত্রী ছিলেন, তাকে গভর্নর জেনারেল করলেন। পাকিস্তান সরকারের সেক্রেটারি জেনারেল চৌধুরী মোহাম্মদ আলীকে করলেন অর্থমন্ত্রী। খাজা নাজিমুদ্দীন প্রধানমন্ত্রী হলেও দুইটা গ্রুপ তার ক্যাবিনেটে কাজ করছিল। একটা গ্রুপ পাঞ্জাবিদের আর একটা গ্রুপ বাঙালিদের। পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশের নেতারা বাঙালি গ্রুপকে তলে তলে সাহায্য করছিল। খাজা সাহেব বিরাট ভুল করে বসলেন প্রধানমন্ত্রী হয়ে কিছুদিন পরে তিনি পূর্ব বাংলায় আসেন। প্রথমবারে তিনি কিছুই বলেননি। কিছুদিন পরে, সম্ভবত ১৯৫১ সালের শেষের দিকে অথবা ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে পল্টন ময়দানে এক জনসভায় তিনি বক্তৃতা করলেন। সেখানে ঘোষণা করলেন, ‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে।’
খাজা নাজিমুদ্দীন ১৯৪৮ সালে পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে যে ওয়াদা করেছিলেন, ‘সে ওয়াদার খেলাপ করলেন। ১৯৪৮ সালের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন এবং নিজেই পূর্ব বাংলা আইনসভায় প্রস্তাব পেশ করেছিলেন যে, পূর্ব বাংলার অফিসিয়াল ভাষা বাংলা’ হবে। তাছাড়া যাতে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হয় তার জন্য কেন্দ্রীয় আইনসভায় কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরোধ করা হবে। এ প্রস্তাব পূর্ব বাংলার আইনসভায় সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। যে ঢাকায় বসে তিনি ওয়াদা করেছিলেন সেই ঢাকায় বসেই বিপরীত কথা বললেন। দেশের মধ্যে ভীষণ ক্ষোভের সৃষ্টি হলো। তখন একমাত্র রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, ছাত্র প্রতিষ্ঠান ছাত্রলীগ এবং যুবাদের প্রতিষ্ঠান যুবলীগ সবাই এর তীব্র প্রতিবাদ করে। বঙ্গবন্ধু তখন জেলে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আছেন। সন্ধ্যায় মোহাম্মদ তোয়াহা ও অলি আহাদ দেখা করতে আসেন। কেবিনের একটা জানালা ছিল ওয়ার্ডের দিকে। বঙ্গবন্ধু তাদের রাত একটার পরে আসতে বললেন। আরও বললেন, খালেক নেওয়াজ, কাজী গোলাম মাহাবুব আরও কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকে খবর দিতে। দরজার বাইরে আইবিরা পাহারা দিত। রাতে অনেকে ঘুমিয়ে পড়ার পরে পেছনের বারান্দায় ওরা পাঁচ-সাতজন আসে। বঙ্গবন্ধু অনেক রাতে একা হাঁটাচলা করতেন, রাতে কেউ আসে না বলে কেউ কিছু বলত না। পুলিশরা চুপচাপ পড়ে থাকত, কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল যে তিনি ভাগবেন না। গোয়েন্দা কর্মচারী একপাশে বসে ঝিমায়। বারান্দায় বসে আলাপ হলো এবং বঙ্গবন্ধু সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে বললেন। আওয়ামী লীগ নেতাদেরও খবর দিয়েছেন। ছাত্রলীগই তখন ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান। ছাত্রলীগ নেতারা রাজি হলো। অলি আহাদ ও তোয়াহা জানাল, যুবলীগও রাজি হবে। আবার ষড়যন্ত্র চলছে বাংলা ভাষার দাবিকে নস্যাৎ করার। এখন প্রতিবাদ করলে কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলিম লীগ উর্দুর পক্ষে প্রস্তাব পাস করে নেবে। খাজা নাজিমুদ্দীন উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথাই বলেননি, অনেক নতুন নতুন যুক্তিতর্ক দেখিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু তাদের আরও বললেন, ‘খবর পেয়েছি, আমাকে আবার শিগগিরই জেলে পাঠিয়ে দেবে, কারণ আমি নাকি হাসপাতালে বসে রাজনীতি করছি। তোমরা আগামীকাল রাতেও আবার এস।’ আরও দু-একজন ছাত্রলীগ নেতাকে নিয়ে আসতে বললেন। শওকত মিয়া ও কয়েকজন আওয়ামী লীগ কর্মীকেও দেখা করতে বললেন। পরের দিন রাতে এক এক করে অনেকেই এলো। সেখানেই ঠিক হলো আগামী ২১ শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর করতে হবে। ফেব্রুয়ারি থেকেই জনমত সৃষ্টি করা শুরু হবে।
বঙ্গবন্ধু আরও বললেন, ‘আমিও আমার মুক্তির দাবি করে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট শুরু করব। আমার ছাব্বিশ মাস জেল হয়ে গেছে। মহিউদ্দিনও জেলে আছে, আমার কাছে থাকে। যদি সে অনশন করতে রাজি হয়, তবে খবর দেব, তার নামটাও আমার নামের সঙ্গে দিয়ে দেবে। আমাদের অনশনের নোটিশ দেওয়ার পরই শওকত মিয়া প্যামপ্লেট ও পোস্টার ছাপিয়ে বিলি করার বন্দোবস্ত করবে।’
দুই দিন পরেই দেখা গেল একটা মেডিকেল বোর্ড গঠন করে বঙ্গবন্ধুকে এক্সজামিন করতে এসেছে। তারা মত দিলেন তিনি অনেকটা সুস্থ, এখন কারাগারে বসেই চিকিৎসা হতে পারে। সরকার তাকে ঢাকা জেলে পাঠিয়ে দিলেন, ভালোভাবে চিকিৎসা না করে। জেলে এসেই তিনি মহিউদ্দিনকে সব কথা বললেন। মহিউদ্দিনও রাজি হলো অনশন ধর্মঘট করতে। তারা দুইজনে সরকারের কাছে পহেলা ফেব্রুয়ারি দরখাস্ত পাঠালেন। যদি ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে তাদের মুক্তি দেওয়া না হয় তাহলে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট করতে শুরু করবে। বঙ্গবন্ধুকে যখন জেল কর্তৃপক্ষ অনুরোধ করল অনশন ধর্মঘট না করতে তখন তিনি বললেন, ‘ছাব্বিশ-সাতাশ মাস বিনাবিচারে বন্দি রেখেছেন। কোনো অন্যায়ও করিনি। ঠিক করেছি জেলের বাইরে যাব, হয় আমি জ্যান্ত অবস্থায় না হয় মৃত অবস্থায় যাব।’ তারা সরকার জানিয়ে দিল। বাইরে খবর দিয়েই এসেছিলাম এই তারিখে দরখাস্ত করা হবে। বাইরে সমস্ত জেলায় ছাত্রলীগ কর্মীদের ও যেখানে যেখানে আওয়ামী লীগ ছিল সেখানে খবর পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। (চলবে)
জনসংযোগ কর্মকর্তা, অর্থ মন্ত্রণালয়