গতকালের পর
গাজী তৌহিদুল ইসলাম: সামান্য কয়েকটা জেলা ছাড়া আওয়ামী লীগ তখনও গড়ে ওঠেনিই। তবে সব জেলায়ই বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত বন্ধুও সহকর্মী ছিল। এদিকে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদও গঠন করা হয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি দিনও ধার্য করা হয়েছে। কারণ, ওই দিনই পূর্ব বাংলার আইনসভা বসবে। কাজী গোলাম মাহাবুবকে সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর করা হয়েছিল। ১৯৪৮ সালে ছাত্ররাই এককভাবে বাংলা ভাষার দাবির জন্য সংগ্রাম করেছিল। এবার বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস ছিল, জনগণ এগিয়ে আসবে। কারণ জনগণ বুঝতে শুরু করেছে, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করতে পারলে তাদের দাসত্বের শৃঙ্খল আবার পরতে হবে। মাতৃভাষার অপমান কোনো জাতি সহ্য করতে পারে না। পাকিস্তানের জনগণের শতকরা ছাপ্পান্ন জন বাংলা ভাষাভাষী হয়েও শুধু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা বাঙালিরা করতে চায়নি। তারা চেয়েছে বাংলার সঙ্গে উর্দুকেও রাষ্ট্রভাষা করা হোক তাতে আপত্তি নাই। কিন্তু বাঙালির এই উদারতাটাই অনেকে দুর্বলতা হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে। এদিকে বাঙালিরা অনুভব করতে শুরু করেছে, তাদের ওপর অর্থনৈতিক দিক দিয়ে, ব্যবসা-বাণিজ্য, সরকারি চাকরিতেও অবিচার চলছে। পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে রাজধানী হওয়াতে বাঙালিরা সুযোগ-সুবিধা হতে বঞ্চিত হতে শুরু করেছে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি এবং শেষ পর্যন্ত সর্বদলীয় ‘গ্রান্ড ন্যাশনাল কনভেনশনে স্বায়ত্তশাসনের দাবি করায় বাঙালিদের মনোভাব ফুটে উঠেছে। পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ নেতারা যতই জনগণের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলেন ততই পশ্চিম পাকিস্তানের কোটারি ও আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভর করতে শুরু করেছেন ক্ষমতায় থাকার জন্য। খাজা নাজিমুদ্দীন ও নূরুল আমিন জনগণকে ভয় করতে শুরু করেছেন। সেই জন্য টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পরে অনেকগুলো আইনসভার সদস্যের পদ খালি হওয়া সত্ত্বেও উপনির্বাচন দিতে সাহস পাচ্ছিলেন না।
এদিকে জেলের ভেতর বঙ্গবন্ধু ও মহিউদ্দিন প্রস্তুত হচ্ছিলেন অনশন ধর্মঘট করার জন্য। তারা আলোচনা করে ঠিক করেন, যাই হোক না কেন, অনশন ভাঙবে না। যদিএই পথেই মৃত্যু এসে থাকে তবে তাই হবে। জেল কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে সুপারিনটেনডেন্ট আমীর হোসেন ও তখনকার দিনে রাজবন্দিদের ডেপুটি জেলার মোখলেসুর রহমান তাদের বুঝাতে অনেক চেষ্টা করলেন। তারা বললেন, আপনাদের বিরুদ্ধে আমাদের বলার কিছু নেই। আর আমরা সেজন্য অনশন করছি না। সরকার আমাদের বছরের পর বছর বিনা বিচারে আটক রাখছে, তারই প্রতিবাদ করার জন্য অনশন ধর্মঘট করছি। এতদিন জেল খাটলাম, আপনাদের সঙ্গে আমাদের মনোমালিন্য হয়নি। কারণ আমরা জানি, সরকারের হুকুমেই আপনাদের চলতে হয়।
১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে সকালবেলা বঙ্গবন্ধুকে জেলগেটে নিয়ে যাওয়া হলো এই কথা বলে যে, তার সঙ্গে আলোচনা আছে অনশন ধর্মঘটের বিষয়ে। তিনি জেল গেটে পৌঁছে দেখলেন, একটু পরেই মহিউদ্দিনকেও নিয়ে আসা হয়েছে একই কথা বলে। কয়েক মিনিট পরে মালপত্র, কাপড়চোপড় ও বিছানা নিয়ে জমাদার সাহেব হাজির। বললেন, ব্যাপার কী? কর্তৃপক্ষ বললেন, আপনাদের অন্য জেলে পাঠানোর হুকুম হয়েছে। জিজ্ঞাসা করলেন, কোন জেলে? কেউ কিছু বলেন না। এদিকে আর্মড পুলিশ, আইবি অফিসারও প্রস্তুত হয়ে এসেছে। খবর চাপা থাকে না। একজন বঙ্গবন্ধুকে বলে দিল, ফরিদপুর জেলে। দুইজনকেই এক জেলে পাঠানো হচ্ছে। তখন নয়টা বেজে গেছে। এগারটায় নারায়ণগঞ্জ থেকে জাহাজ ছাড়ে, সেই জাহাজ ধরতে হবে। বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন অজুহাতে দেরি করতে শুরু করলেন, কারণ তা না হলে কেউই জানবে না যে তাদের কোথায় পাঠাচ্ছে! প্রথমে তিনি তার বইগুলো এক এক করে মেলাতে শুরু করলাম, তারপর কাপড়গুলো। হিসাব-নিকাশ, কত টাকা খরচ হয়েছে, কত টাকা আছে। দেরি করতে করতে দশটা বাজিয়ে দিলেন। রওনা করতে আরও আধা ঘণ্টা লাগিয়ে দিলেন।
আর্মড পুলিশের সুবেদার ও কর্মচারীরা তাড়াতাড়ি করছিল। বন্ধ ঘোড়ার গাড়ি আনা হয়েছে। গাড়ির ভেতর জানালা উঠিয়ে ও দরজার কপাট বন্ধ করে দেওয়া হলো। দুইজন ভেতরেই তাদের সঙ্গে বসল। আর একটা গাড়িতে অন্যরা পেছনে পেছনে ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশে রোডের দিকে চলল। সেখানে গিয়ে দেখা গেল আগেই একজন আর্মড পুলিশ ট্যাক্সি রিজার্ভ করে দাঁড়িয়ে আছে। তখন ট্যাক্সি পাওয়া খুবই কষ্টকর ছিল। তারা আস্তে আস্তে নামলেন ও উঠলেন। বঙ্গবন্ধু এদিক ওদিক অনেকবার তাকালেন। কোনো চেনা লোকের সঙ্গে দেখা হলো না। ট্যাক্সি তাড়াতাড়ি চালাতে বলল। পৌঁছে খবর পাওয়া গেল জাহাজ ছেড়ে চলে গেছে। এখন উপায়? কোথায় তাদের নিয়ে যাবে? রাত একটায় আর একটা জাহাজ ছাড়বে। তাদের নারায়ণগঞ্জ থানায় নিয়ে যাওয়া হলো। ওপরওলাদের টেলিফোন করল এবং হুকুম নিল থানায়ই রাখতে। তাদের পুলিশ ব্যারাকের একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। বঙ্গবন্ধু একজন চেনা লোককে থানায় দেখলেন, তাকে বললেন, শামসুজ্জোহাকে খবর দিতে। খান সাহেব ওসমান আলী সাহেবের বাড়ি, সবাই চেনে। এক ঘণ্টার মধ্যে জোহা সাহেব, বজলুর রহমান ও আরও অনেকে থানায় এসে হাজির। খাবার নিয়ে এসেছে। পরে আলমাস আলীও তাদের দেখতে এসেছিল।
বঙ্গবন্ধু তাদের বললেন, ‘রাতে হোটেলে খেতে যাব। কোন হোটেলে যাব বলে যান। আপনারা আগেই সেই হোটেলে বসে থাকবেন। আলাপ আছে।’ তাদের কেন বদলি করেছে, ঢাকা জেল থেকে ফরিদপুর জেলে, এর মধ্যেই বলে দিলেন। বেশি সময় তাদের থাকতে দিল না থানায়, হোটেলের নাম বলে বিদায় নিল। বঙ্গবন্ধু সুবেদারকে রাতে হোটেলে খেয়ে সেখান থেকে জাহাজঘাটে যাওয়ার প্রস্তাব করলেন, সে রাজি হলো। সুবেদার কথা ফেলবে না এ বিশ্বাস তার ছিল। একজন সিপাহি দিয়ে মালপত্র স্টেশনে পাঠিয়ে দিয়ে যথাসময়ে হোটেলে পৌঁছালেন। দোতলায় একটা ঘরে বসার ব্যবস্থা ছিল। সেখানে খাবার বন্দোবস্ত করে রাখা হয়েছে। তারা বসে পড়লেন, আট-দশজন কর্মী নিয়ে জোহা সাহেব বসে আছেন। আমরা আস্তে আস্তে খাওয়া-দাওয়া, আলাপ-আলোচনা করলেন। ভাসানী সাহেব, হক সাহেব ও অন্যান্য নেতাদের খবর দিতে বললেন। খবরের কাগজে যদি দিতে পারে চেষ্টা করবে। তারা যে আগামীকাল থেকে আমরণ অনশন শুরু করবে, সে কথাও তাদের বললেন, যদিও তারা আগেই খবর পেয়েছিল। তারা বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ‘২১ শে ফেব্রুয়ারি তারিখে নারায়ণগঞ্জে পূর্ণ হরতাল হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতো আছেই, আপনাদের মুক্তির দাবিও আমরা করব।’
রাত এগারটায় স্টেশনে এলেন। জাহাজ ঘাটেই ছিল, সকলে উঠে পড়লেন। জাহাজ না ছাড়া পর্যন্ত সহকর্মীরা অপেক্ষা করল। রাত একটার সময় সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘জীবনে আর দেখা না হতেও পারে। সকলে যেন ক্ষমা করে দেয়, দুঃখ আমার নাই, একদিন মরতেই হবে, অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে যদি মরতে পারি, সে মরাতেও শান্তি আছে।
জাহাজ ছেড়ে দিল, তারা বিছানা করে শুয়ে পড়লেন। সকালে দুইজনে পরামর্শ করে ঠিক করলেন, জাহাজে অনশন করি কী করে? তাদেরকে জেলে নিতে হবে অনশন শুরু করার আগে। সমস্ত দিন জাহাজ চলল, রাতে গোয়ালন্দ ঘাটে আসল, সেখান থেকে ট্রেনে রাত চারটায় ফরিদপুর পৌঁছালেন। রাতে জেল কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করল না, তারা দুইজনে জেল সিপাহিদের ব্যারাকের বারান্দায় কাটালেন। সকালবেলা সুবেদারকে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘জেল অফিসাররা না এলেতো আমাদের জেলে নেবে না, চলেন কিছু নাশতা করে আসি।’ নাশতা খাবার ইচ্ছা তাদের ছিল না, তবে যদি কারও সঙ্গে দেখা যায়, তাহলে ফরিদপুরের সহকর্মীরা জানতে পারবে, যে তারা ফরিদপুর জেলে আছে এবং অনশন ধর্মঘট করছে। আধা ঘণ্টা দেরি করলেন, কাউকেও দেখলেন না-চায়ের দোকানের মালিক এসেছে, বঙ্গবন্ধু তাকে তার নাম বললেন এবং সহকর্মীদের খবর দিতে বললেন।
তারা জেলের দিকে রওনা করল, এমন সময় আওয়া লীগের এক কর্মী, ১৯৪৬ সালের ইলেকশনে ওয়ার্কার ইনচার্জ থাকাকালীন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাজ করেছিল, তার নামও মহিউদ্দিন-তার সঙ্গে দেখা। মহিউদ্দিন সাইকেলে যাচ্ছিল, তাকে দেখে তিনি ডাক দিলেন, সে দেখে এগিয়ে এল। আইবি নিষেধ করছিল। তিনি শুনলেন না, তাকে এক ধমক দিলেন এবং মহিকে বললেন যে, তাদের ফরিদপুর জেলে এনেছে এবং আজ থেকে অনশন করছেন সবাইকে এ খবর দিতে। তারা জেলগেটে চলে এলেন, মহিও সঙ্গে সঙ্গে এল। জেলগেটে এসে দেখলেন, জেলার সাহেব, ডেপুটি জেলার সাহেব এসে গেছেন। তাদের তাড়াতাড়ি ভেতরে নিয়ে যেতে বললেন। তারা আগেই খবর পেয়েছিলেন। জায়গাও ঠিক করে রেখেছেন, তবে রাজবন্দিদের সঙ্গে নয়, অন্য জায়গায়, বঙ্গবন্ধুরা তাড়াতাড়ি ওষুধ খেয়ে নিলেন, পেট পরিষ্কার করার জন্য। তারপর অনশন ধর্মঘট শুরু করলেন। দুই দিন পর অবস্থা খারাপ হলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। দুইজনেরই শরীর খারাপ। মহিউদ্দিন ভুগছে পুরিসিস রোগে, আর বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন রোগে। চার দিন পরে নাক দিয়ে জোর করে খাওয়াতে শুরু করল। মহাবিপদ! নাকের ভেতর নল দিয়ে পেটের মধ্যে পর্যন্ত দেয়। তারপর নলের মুখে একটা কাপের মতো লাগিয়ে দেয়। একটা ছিদ্রও থাকে। সে কাপের মধ্যে দুধের মতো পাতলা করে খাবার তৈরি করে পেটের ভেতর ঢেলে দেয়। এদের কথা হলো, ‘মরতে দেব না।’
বঙ্গবন্ধুর নাকে একটা সমস্যা ছিল। দুই তিনবার দেয়ার পরেই ঘা হয়ে গেল। রক্ত আসে আর যন্ত্রণা। তারা আপত্তি করতে লাগল, জেল কর্তৃপক্ষ শুনছে না। খুবই কষ্ট পাচ্ছেন। দুইটা নাকের ভেতরই ঘা হয়ে গেছে। জেল কর্তৃপক্ষ হ্যান্ডকাফ পরানোর লোকজন নিয়ে আসে, বাধা দিলে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে জোর করে ধরে খাওয়াবে। দুজনেরই শরীরও খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। পাঁচ-ছয় দিন পরে বিছানা থেকে ওঠার শক্তি হারিয়ে ফেলল। তারা ইচ্ছা করে কাগজি লেবুর রস দিয়ে লবণ পানি খেত, কারণ এর মধ্যে কোনো ফুড ভ্যালু নেই, ওজনও কমতে ছিল। নাকের মধ্য দিয়ে নল দিয়ে খাওয়ার সময় নলটা একটু এদিক ওদিক হলেই আর উপায় থাকবে না। সিভিল সার্জন, ডাক্তার ও জেল কর্তৃপক্ষ তাদের কোনো অসুবিধা না হয়, তার চেষ্টা করছিলেন। বারবার সিভিল সার্জন অনশন করতে নিষেধ করছিলেন। তাদের শরীর অতিশয় দুর্বল হয়ে পড়েছে। এখন আর বিছানা থেকে ওঠার শক্তি নেই। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারলেন তার হার্টের অবস্থা খারাপ হয়ে পড়েছে, নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট হয়, প্যালপিটিশন হয় ভীষণভাবে। ভাবলেন আর বেশি দিন নেই। একজন কয়েদিকে দিয়ে গোপনে কয়েক টুকরা কাগজ আনালেন। যদিও হাত কাঁপে তথাপি ছোট ছোট চারটা চিঠি লিখলেন। চারটার মধ্যে আব্বার কাছে একটা, স্ত্রীর কাছে একটা, আর দুইটা শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেবের কাছে। এমন অবস্থা যে, দু-এক দিন পরে হয়ত আর লেখার শক্তি থাকবে না।
২১ শে ফেব্রুয়ারি। চরম উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা নিয়ে দিন কাটল বঙ্গবন্ধুর, রাতে সিপাহিরা ডিউটিতে এসে খবর দিল, ঢাকায় ভীষণ গোলমাল হয়েছে। কয়েকজন লোক গুলি খেয়ে মারা গেছে। ফরিদপুরে হরতাল হয়েছে, ছাত্র-ছাত্রীরা শোভাযাত্রা করে জেলগেটে এসেছিল। তারা বিভিন্ন সেøাগান দিচ্ছিল, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, বাঙালিদের শোষণ করা চলবে না, শেখ মুজিবের মুক্তি চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’, এরকম আরও অনেক সেøাগান।
বঙ্গবন্ধুরা দু’জনে পাশাপাশি বিছানায় শুয়ে আছেন, ডাক্তার সাহেব তাদের নড়াচড়া করতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু উত্তেজনায় বঙ্গবন্ধু উঠে বসলেন। দুইজন কয়েদি ছিল তাদের পাহারা দেয়ার এবং কাজকর্ম করে দেয়ার জন্য। তাড়াতাড়ি তাদের ধরে শুইয়ে দিল। বঙ্গবন্ধুর খুব খারাপ লাগছিল, মনে হচ্ছিল চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। ভাবতে লাগলেন- গুলি করারতো কোনো দরকার ছিল না। হরতাল করবে, সভা ও শোভাযাত্রা করবে, কেউতো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায় না। কোনো গোলমাল সৃষ্টি করার কথাতো কেউ চিন্তা করেনি। ১৪৪ ধারা দিলেই গোলমাল হয়, না দিলে গোলমাল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
অনেক রাতে একজন সিপাহি এসে বলল, ছাত্র মারা গেছে অনেক। বহু লোক গ্রেপ্তার হয়েছে। রাতে আর কোনো খবর নেই। ঘুমতো এমনিই হয় না, তারপর আবার এই খবর। পরের দিন নয়-দশটার সময় বিরাট শোভাযাত্রা বের হয়েছে, বড় রাস্তার কাছেই জেল, শোভাযাত্রীদের সেøাগান পরিষ্কার শোনা যায়, হাসপাতালের দোতলা থেকে দেখাও যায়, কিন্তু বঙ্গবন্ধুরা নিচের তলায়। হর্ন দিয়ে একজন বক্তৃতা করছে, সম্ভবত তাদের জানার জন্যই হবে। কী হয়েছে ঢাকায় তারা কিছু কিছু বুঝতে পারলেন। জেল কর্তৃপক্ষ তাদের কোনো খবর দিতে চায় না। তারা যেন কোনো খবর না পায়, আর কোনো খবর না দিতে পারে বাইরে, এই তাদের চেষ্টা। খবরের কাগজতো একদিন পরে আসে, ঢাকা থেকে। ২২ তারিখে সারা দিন ফরিদপুরে শোভাযাত্রা চলল। কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী এক জায়গায় হলেই স্লোগান দেয়। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা রাস্তায় বেড়ায় আর স্লোগান দেয়।
২২ তারিখে বঙ্গবন্ধু খবরের কাগজে কিছু কিছু খবর পেলেন। তিনি ভাবলেন, মুসলিম লীগ সরকার কত বড় অপরিণামদর্শিতার কাজ করল। মাতৃভাষা আন্দোলনে পৃথিবীতে এই প্রথম বাঙালিরাই রক্ত দিল। দুনিয়ার কোথাও ভাষা আন্দোলন করার জন্য গুলি করে হত্যা করা হয়নি। গুলি হলো মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের এরিয়ার ভেতরে, রাস্তায়ও নয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলেও, গুলি না করে গ্রেপ্তার করলেইতো চলত। দেখব কি না জানি না, তবে রক্ত যখন আমাদের ছেলেরা দিয়েছে তখন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করে আর উপায় নেই। (শেষ)
জনসংযোগ কর্মকর্তা, অর্থ মন্ত্রণালয়