ইসমাইল আলী: উদ্বোধনের প্রায় ১৩ বছর পর প্রথমবারের মতো বাড়ানো হয় বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল। এরপর পাঁচ বছরের ব্যবধানে দ্বিতীয় দফা টোল বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সেতু বিভাগ। এবার সেতুটির টোল ৪০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি সেতুটিতে চলাচলকারী ট্রেইলারের জন্য পৃথক টোল প্রস্তাব করা হয়েছে। শিগগিরই এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। যদিও জনগণের সামর্থ্য বিবেচনায় প্রথম দফা ১৪ শতাংশ টোল বাড়ানোর অনুমোদন দেওয়া হয়।
টোল বাড়ানোর প্রস্তাবে বলা হয়, ১৯৯৮ সালের জুনে তিন হাজার ৭৪৫ কোটি ৬০ লাখ ব্যয়ে যমুনা নদীর ওপর চার দশমিক আট কিলোমিটার দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু সেতুর নির্মাণকাজ সফলভাবে সম্পন্ন হয়। এটি নির্মাণে বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হয় দুই হাজার ৫৪৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা। আর ১৯৯৭ সালের ২৯ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ সেতুর টোল হার নির্ধারণ করা হয়।
এরপর ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে সেতুটির টোল মাত্র ১৪ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়। তবে এ সময় দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছর হতে ২০১৪-১৫ অর্থবছর পর্যন্ত ভোক্তা মূল্যসূচক ১০০ থেকে বেড়ে ২০৭ দশমিক ৫৮তে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ দ্রব্যমূল্য সূচক প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়।
এদিকে বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণে গৃহীত ঋণের ওপর ধার্য করা কিস্তি (ডিএসএল) নিয়মিত পরিশোধ করে আসছে সেতু বিভাগ। পাশাপাশি টোল থেকে প্রাপ্ত আয়ের অর্থে সেতুর পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ, নদীশাসন রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজ করা হয়। এছাড়া সরকারি বিধি অনুযায়ী আয়ের অর্থে কেটে রাখা হয় ভ্যাট ও আয়কর।
প্রস্তাবে আরও বলা হয়, বর্তমানে সেতু বিভাগ বছরে ১২০ কোটি টাকা ডিএসএল পরিশোধ করছে। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের কারণে এর পরিমাণ নিয়মিত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের বাইরে আগামী তিন বছরে সেতুর বড় ধরনের মেরামত প্রয়োজন হবে। এজন্য ব্যয় হবে ৩৫০ কোটি টাকা। এ অবস্থায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সেতু বিভাগের বাজেট ঘাটতি হবে প্রায় ১২৬ কোটি টাকা। তাই সেতুর টোল বৃদ্ধি ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
প্রস্তাবমতে, বর্তমানে বঙ্গবন্ধু সেতুতে টোলের হার মোটরসাইকেলে ৪০ টাকা, হালকা যান (প্রাইভেট কার, জিপ, পিকআপ, মাইক্রোবাস) ৫০০, ছোট বাস ৬৫০, বড় বাস ৯০০, ছোট ট্রাক ৮৫০, মাঝারি ট্রাক এক হাজার ১০০ ও বড় ট্রাকে এক হাজার ৪০০ টাকা। আর নতুন হার কার্যকর হলে টোল দাঁড়াবে মোটরসাইকেলে ৫৫ টাকা, হালকা যান (প্রাইভেট কার, জিপ, পিকআপ, মাইক্রোবাস) ৭০০, ছোট বাস ৯০০, বড় বাস এক হাজার ২৫০, ছোট ট্রাক এক হাজার ২০০, মাঝারি ট্রাক এক হাজার ৫৫০ ও বড় ট্রাকে এক হাজার ৯৫০ টাকা। অর্থাৎ ক্ষেত্রভেদে ৩৮ থেকে ৪১ শতাংশ টোল বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এর বাইরে চার এক্সেল পর্যন্ত ট্রেইলারে তিন হাজার ও চার এক্সেলের অধিক ট্রেইলারে পাঁচ হাজার টাকা টোল প্রস্তাব করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু সেতুর পাশাপাশি সেতু বিভাগের আওতাধীন মুক্তারপুর সেতুর টোলের হারও বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বর্তমানে ভ্যানে টোল হার ১০ টাকা, অটোরিকশা ২০, কার/জিপ ৪০, ছোট বাস ১০০, বড় বাস ২০০, ছোট ট্রাক ১৫০ ও বড় ট্রাক ৫০০ টাকা। নতুন হার কার্যকর হলে টোল দাঁড়াবে ভ্যানে ১৫ টাকা, অটোরিকশা ৩০, কার/জিপ ৬০, ছোট বাস ১৫০, বড় বাস ২৮০, ছোট ট্রাক ২০০ ও বড় ট্রাক ৬০০ টাকা। এক্ষেত্রে ৩৩ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত টোলহার বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সেতু বিভাগের সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় গত কয়েক বছর ধরে বঙ্গবন্ধু সেতুর ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বেড়ে গেছে। এছাড়া প্রতি বছরই সেতু মেরামতে অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। আর নতুন পে-স্কেল বাস্তবায়নে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা খাতে ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। তাই টোল বৃদ্ধি না করলে আগামীতে সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নিয়ে চলতে হবে। এজন্য টোল বাড়ানোর চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।
সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, গত অর্থবছরে বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে টোল বাবদ আয় হয় ৪০৫ কোটি টাকা। তবে ভ্যাট ও কর দেওয়ার পর আয় অবশিষ্ট ছিল ২৪১ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩৫১ কোটি টাকা। ভ্যাট ও কর দেওয়ার পর আয় অবশিষ্ট ছিল ২০৯ কোটি টাকা।
এদিকে বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণে গৃহীত ঋণ ২০৩৪ সাল পর্যন্ত বহন করতে হবে। ঋণ গ্রহণের সময়ের তুলনায় এখন ডলারের বিনিময়মূল্য প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ফলে ঋণ পরিশোধ ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। এতে গত দুই-তিন বছর ধরে দেখা দিচ্ছে বাজেট ঘাটতি।
টোলহার বৃদ্ধিতে গত মাসে বৈঠক করে সেতু কর্তৃপক্ষ। এতে উপস্থিত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, টোল বাড়ানোর জন্য প্রাথমিকভাবে সওজের সম্প্রতি প্রণীত টোল নীতিমালা বিশ্লেষণ করা হয়। এতে দেখা যায়, সওজের বিভিন্ন সেতুতে যে হারে টোল আদায় করা হচ্ছে, আনুপাতিক হারে বঙ্গবন্ধু সেতুর তুলনায় তা বেশি। তাই বঙ্গবন্ধু সেতুতে টোল হার বাড়ানো উচিত। এছাড়া সেতুটির সর্বশেষ টোল বৃদ্ধির পর প্রতি বছর মূল্যস্ফীতি হিসাব করলে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ টোল বৃদ্ধি করা উচিত। তবে এর প্রভাবে সেতুতে যানবাহন চলাচল হ্রাস পেতে পারে বিধায় গড়ে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত টোল বৃদ্ধির বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।