জুনায়েদ আহম্মেদ, লক্ষ্মীপুর: লক্ষ্মীপুরকে অর্থকরী ফসলের জন্য নতুনভাবে খ্যাতি এনে দিয়েছে পান। অল্প পুঁজি, নিয়মিত শ্রম ও সঠিক পরিচর্যার ফলে অধিক আয় সম্ভব হওয়ায় পানকে কৃষি ফসল হিসেবে বেছে নিয়েছেন জেলার বেশ কয়েকজন কৃষক। পানের ভালো ফলন হওয়ায় অধিক লাভের আশায় দিন দিন বাড়ছে পান চাষ। এ বছর লক্ষ্মীপুরে প্রায় ১০০ কোটি টাকার পান উৎপাদন হয়েছে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর লক্ষ্মীপুর সদর, রায়পুর, রামগঞ্জ, কমলনগর ও রামগতি উপজেলায় ৫০০ হেক্টর জমিতে ছোট-বড় প্রায় আড়াই হাজার বরজে পান চাষ হয়েছে। এর মধ্যে রায়পুর উপজেলায় ৪০০ হেক্টর জমিতে প্রায় এক হাজার ৬২০টি বরজে পান চাষ করেন কৃষক।
সংশ্লিষ্টরা জানান, পান চাষে লাভবান হওয়ায় এ অঞ্চলের কৃষকের পান চাষে আগ্রহ বেড়েছে। এখানকার উৎপাদিত পান জেলার চাহিদা মিটিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য জেলায়ও সরবরাহ করা হচ্ছে। পানের ভরা মৌসুমে ন্যায্য দাম পেয়ে খুশি পানচাষিরা। বছরজুড়ে পানের আবাদ ও ফলন হলেও আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন ও কার্তিক মাসে পানের বেশি ফলন হয়। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে নিয়মিত পরিচর্যার মাধ্যমে আবাদ করা বরজ থেকে ১০-১৫ বছর পর্যন্ত পান উৎপাদন হয়।
এ মৌসুমে প্রতি হেক্টর জমিতে প্রায় ১৫-১৬ হাজার বিড়া (৭২টি পানে এক বিড়া) পান উৎপাদন হয়েছে। স্থানীয় বাজারগুলো থেকে পাইকাররা এক পাই (১২ বিড়া), এক কুড়ি (৪৮ বিড়া) ও এক গাদি (১৯২ বিড়া) হিসেবে আকারভেদে ক্রয় করছেন। বর্তমানে প্রতি বিড়া পান আকারভেদে ৩৫ থেকে ১০০ টাকা দরে পাইকারি বিক্রি হলেও দুই থেকে তিন মাস পর এ পানের দাম প্রতি বিড়া ৯০ থেকে ১৭০ টাকা পাইকারি বিক্রি হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
‘পানপল্লি’খ্যাত ক্যাম্পের হাট এলাকার কয়েকজন পানচাষির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রায়পুরের ক্যাম্পের হাট ও চরআবাবিল এলাকার ৬০ ভাগ মানুষ পান চাষ ও পান ব্যবসার ওপর নির্ভরশীল। বৈশাখ থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত পানের উৎপাদন ভালো হয়। এ সময় উৎপাদিত পানের মান ভালো ও আকারে বড় হয়। শীতকালে সঠিক পরিচর্যা না করলে ঘন কুয়াশা ও ক্ষেতে পানি জমে পান উৎপাদন কমে যায় এবং পানের বরজ নষ্ট হয়ে যায়।
রায়পুর উপজেলার হায়দরগঞ্জ বাজারের পান ব্যবসায়ী আবদুর জহির জানান, রায়পুর উপজেলার উত্তর চরআবাবিল, দক্ষিণ চরআবাবিল, উত্তর চরবংশী ও দক্ষিণ চরবংশী ইউনিয়নে পানের আবাদ বেশি হয়। জেলার সবচেয়ে বড় পানের হাট বসে হায়দরগঞ্জ বাজারে। বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা এ হাটে এসে তাদের চাহিদামতো পান সংগ্রহ করে নিয়ে যান।
একই বাজারের ব্যবসায়ী মো. আনোয়ার হোসেন জানান, পান চাষের কারণে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা রয়েছে। প্রয়োজনীয় ঋণ সুবিধা ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ জেলায় উৎপাদিত পান বিদেশে রফতানি করে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখা সম্ভব।
রায়পুরের ক্যাম্প হাটের পানচাষি অসীম কুমার জানান, পান লাভজনক ফসল। উৎপাদন খরচের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ লাভ হওয়ায় পান চাষের দিকে ঝুঁকছেন অধিকাংশ কৃষক। তবে প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাবে পানের বরজের প্রসার ঘটানো যাচ্ছে না।
রায়পুর উপজেলার চর আবাবিল এলাকার পানচাষি খোরশেদ আলম জানান, তাঁর এক একর জমিতে পানের বরজ রয়েছে। গত চার বছরে এ বরজ তৈরি ও আবাদ করতে তার পাঁচ লাখ টাকার মতো ব্যয় হয়েছে। তিনি এ পর্যন্ত ১২ লাখ টাকার বেশি পান বিক্রি করেছেন।
সদর উপজেলার চররুহিতা গ্রামের পানচাষি হরহর লাল বাবু জানান, তিনি ৪০ শতাংশ জমিতে ৫০ হাজার টাকা খরচ করে পান চাষ শুরু করেন। ইতোমধ্যে প্রায় ৪০ হাজার টাকার পান বিক্রি করেছেন। পানের খুব ভালো ফলন হওয়ায় এখনও বরজে বিক্রি উপযোগী ৮০-৯০ হাজার টাকার পান রয়েছে।
রায়পুর উপজেলার দক্ষিণ চরবংশী ইউপি চেয়ারম্যান মিন্টু ফরায়েজী জানান, এখানকার উৎপাদিত পান সুস্বাদু হওয়ায় বাজারে এর চাহিদা ও দাম বেশি। পান চাষকে ঘিরে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা বদলে যাচ্ছে। পানের উৎপাদন বাড়ানো, রোগ-ব্যাধি নির্মূল, সার ও কীটনাশকের সঠিক ব্যবহার করতে কৃষি অফিস নিয়মিত তদারকি করায় এখানে পানের আবাদ ও পান চাষে কৃষকের আগ্রহ বেড়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আবুল হোসেন জানান, লাভজনক হওয়ায় এ অঞ্চলে পান চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বর্তমানে পানের ভরা মৌসুমে চাষিরা ভালো দাম পাচ্ছেন।
Add Comment