Print Date & Time : 23 June 2025 Monday 6:31 pm

বছরে ২৬ হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে নিয়ে যাচ্ছে বিদেশিরা

নিজস্ব প্রতিবেদক:বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে নিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মরত বিদেশিরা। দেশে অবৈধভাবে বিদেশি কর্মী নিয়োগের ফলে এমনটা হচ্ছে বলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। গতকাল রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে টিআইবির কার্যালয়ে ‘বাংলাদেশে বিদেশিদের কর্মসংস্থান: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।

গবেষণার প্রাক্কলন অনুযায়ী, বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি কর্মীর ন্যূনতম সংখ্যা ধরা হয়েছে আড়াই লাখ, যারা বছরে ন্যূনতম ২৬ হাজার ৪০০ লাখ কোটি টাকা পাচার করে। এর মধ্য বাংলাদেশ বছরে ন্যূনতম ১২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। আড়াই লাখ বিদেশির সংখ্যা নির্ধারণ ও রাজস্ব ফাঁকির একটি অনুমিত ব্যাখ্যাও দিয়েছে টিআইবি।

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন জানান, দেশে বৈধভাবে কর্মরত বিদেশির সংখ্যা ৮৫ হাজার ৪৮৬ জন। পর্যটন করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, ওই বছর আট লাখ পর্যটক ভিসা নিয়েছে।

টিআইবি বলছে, পর্যটক ভিসায় কাজ করা নিষিদ্ধ হলেও এই ভিসায় বিদেশিরা অবৈধভাবে দেশের বিভিন্ন খাতে কাজ করছেন। আট লাখ পর্যটকের অন্তত ৫০ শতাংশ বা চার লাখ ভিসা কাজের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। এসব ভিসার সর্বোচ্চ মেয়াদ তিন মাস হওয়ায় তারা তিন মাস পরপর দেশে গিয়ে আবার ভিসা নিয়ে ফিরে আসেন। অর্থাৎ একজনকে বছরে গড়ে আড়াইবার ভিসা নিতে হয়। সে হিসেবে পর্যটক ভিসায় প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার বিদেশি কাজ করেন।

এর সঙ্গে বৈধ বিদেশি কর্মী প্রায় ৯০ হাজার যোগ করে মোট বিদেশি কর্মীর সংখ্যা ন্যূনতম আড়াই লাখ ধরা হয়েছে। জনপ্রতি ন্যূনতম গড় মাসিক বেতন দেড় হাজার ডলার ধরে বিদেশি কর্মীদের মোট বার্ষিক আয় ৪৫০ কোটি ডলার হিসাব করা হয়েছে। সেখান থেকে স্থানীয় ব্যয় বাদ দিলে মোট পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩১৫ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা (১ ডলার = ৮৫ টাকা)। বিদেশিদের ৩০ শতাংশ করহার ধরে ন্যূনতম রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩৫ কোটি ডলার বা প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা।

টিআইবি বলছে, বাংলাদেশে কর্মরত বৈধ বিদেশির হিসাবে নিয়ে সরকারি সংস্থার মধ্যেই মিল নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেশে বিদেশি কর্মীর সংখ্যা ৮৫ হাজার ৪৮৬ জন বলেছেন। কিন্তু ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের হিসাবে কর্মোপযোগী ভিসার সংখ্যা ৩৩ হাজার ৪০৫টি। আর বিডা, বেপজা ও এনজিও ব্যুরোÑএ তিন সংস্থার দেওয়া কর্মানুমতির সংখ্যা ১১ হাজার ১৮০টি।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, তথ্যের অভাব আছে এবং বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব আছে। সরকারের কতটুকু সদিচ্ছা আছে, সেটাও দেখতে হবে। যারা রিটার্ন দিচ্ছেন, তারা সঠিকভাবে দিচ্ছেন কি না, সেটাও দেখার বিষয় আছে। অনেক সময় টুরিস্ট ভিসা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে, ভিসার মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে, কারণ সেখানে অবৈধ লেনদেন আছে।

টিআইবির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কর অঞ্চল-১১-তে আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছেন সাড়ে ৯ হাজার বিদেশি, যাদের বার্ষিক আয় ৬০৩ কোটি টাকা, যাতে মোট কর পাওয়া গেছে ১৮১ কোটি টাকা।

তৈরি পোশাক খাতে কর্মরত বিদেশিদের আয়ের হিসাব তুলে ধরে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ খাতের একটি প্রতিষ্ঠানের বিদেশি প্রধান নির্বাহীর মাসিক বেতন ১০ থেকে ১২ হাজার মার্কিন ডলার। কিন্তু দেখানো হয়েছে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার ডলার। আর একজন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারের মাসিক বেতন তিন থেকে ছয় হাজার ডলার হলেও দেখানো হয় এক থেকে দুই হাজার ডলার।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, এখানে পরিষ্কারভাবে একটি যোগসাজশ রয়েছে। আয় যা তা দেখাতে হলে রিটার্নে দেখাতে হবেÑএটা নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান যেমন চায় না, তেমনি কর্মীও চায় না। ফাঁকি দেওয়া সম্ভব বলে তারা এটি করছে। এই অবৈধ কাজ চলছে। এটা সম্পর্কে সরকারের বিভিন্ন মহলে বিক্ষিপ্ত ধারণা ছিল। তাদের কাছে সেভাবে তথ্য নেই।

টিআইবি বলছে, বাংলাদেশে বৈধ প্রক্রিয়ায় বিদেশি কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম পেয়েছে টিআইবি। নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পদে যোগ্য দেশি কর্মী খোঁজা হয় না এবং বিদেশি কর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়া নিয়ম রক্ষার তাগিদে আনুষ্ঠানিকভাবে সারা হয়।

এসব কর্মী নিয়োগে ভিসার সুপারিশপত্রের জন্য পাঁ-সাত হাজার টাকা অবৈধ লেনদেন হয়। বিদেশে বাংলাদেশ মিশন থেকে ভিসা নিতে চার থেকে সাড়ে আট হাজার টাকা, কাজের অনুমতি নিতে পাঁচ-সাত হাজার টাকা, পুলিশের বিশেষ শাখার ছাড়পত্র পেতে পাঁচ-সাত হাজার টাকা, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) ছাড়পত্রের জন্য তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ছাড়ের জন্য দু-তিন হাজার টাকা এবং ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর জন্য তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা নিয়মবহির্ভূতভাবে দিতে হয়।

এসব নিয়মবহির্ভূত অর্থ লেনদেনে একটি শ্রেণি লাভবান হচ্ছে বলে জানিয়ে টিআইবি মনে করছে, এজন্য এ খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যাচ্ছে না।

প্রায় ৪৪টি দেশ থেকে আসা বিদেশিরা বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতে কর্মরত বলে টিআইবি বলেছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভারত, চীন, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, তুরস্ক, নরওয়ে ও নাইজেরিয়া।

কোন দেশের মানুষ বেশি আছেÑজানতে চাইলে টিআইবির গবেষক মনজুর ই খোদা বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে যে তথ্য দিয়েছেন, সেখানেই বলা আছে, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি কর্মী আসে ভারত থেকে। সরকারি প্রকল্পে কর্মরত বিদেশিদের ক্ষেত্রে অনিয়ম হয় কি নাÑজানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকারি বভিন্ন প্রকল্পে যারা কাজ করেন, অনেকেই ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া কাজ করছেন। তারাও সঠিক বেতন কত সেটা জানান না।

বিদেশি কর্মীদের ভিসার সুপারিশপত্র, নিরাপত্তা ছাড়, কর্মানুমতি ও ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধিসংক্রান্ত সেবা ওয়ান স্টপ সার্ভিস করার সুপারিশ করেছে টিআইবি। বিদেশি কর্মীদের ন্যূনতম বেতনসীমা হালনাগাদ, তথ্য অনুসন্ধানে বিভিন্ন অফিস/কারখানায় এনবিআর বিডা, এসবি সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন করে অভিযান ও স্থানীয় কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করার সুপারিশও রয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন টিআইবির উপদেষ্টা (নির্বাহী ব্যবস্থাপনা) অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার (রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি) শাহজাদা এম আকরাম।