Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 7:33 pm

বছরে ৩২৫ কোটি টাকার সুপারি উৎপন্ন হয় লক্ষ্মীপুরে


জুনায়েদ আহম্মেদ, লক্ষ্মীপুর : লক্ষ্মীপুরে ছোট-বড় মিলিয়ে বর্তমানে ছয় হাজার ৩৫৫ হেক্টর জমিতে সুপারি বাগান রয়েছে। আর এতে উৎপাদিত হয়েছে ১২ হাজার ৪৯০ মেট্রিক টন সুপারি। এর মধ্যে সদর উপজেলায় এক হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে তিন হাজার ৬৮০ মেট্রিক টন, রায়পুর উপজেলায় তিন হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে ছয় হাজার ৭৭২ মেট্রিক টন, রামগঞ্জ উপজেলায় ৮৯০ হেক্টর জমিতে এক হাজার ৩৩১ মেট্রিক টন, কমলনগর উপজেলায় ৩৭৫ হেক্টর জমিতে ৬৩৭ মেট্রিক টন ও রামগতি উপজেলায় ৪০ হেক্টর জমিতে ৭০ মেট্রিক টন সুপারি উৎপাদিত হয়েছে বলে জানা যায় লক্ষ্মীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে। আর এ মৌসুমে প্রায় ৩২৫ কোটি টাকার সুপারি উৎপাদিত হয়েছে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

উপকূলীয় অঞ্চল লক্ষ্মীপুরের ‘লক্ষ্মী’ হিসেবে পরিচিত অর্থকরী ফসল সুপারির এবার ভালো ফলন হয়েছে। এ বছর মৌসুমের শুরুতেই সুপারি ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন হাটবাজারে কেনাবেচায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। স্থানীয় বাজারে সুপারির চাহিদা ও দাম ভালো থাকায় সুপারি চাষে আগ্রহও বাড়ছে কৃষকদের।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে সুপারি গাছে ফুল আসে। পরে এ ফুল থেকে সৃষ্ট সুপারি পুরোপুরি পাকে কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে। মূলত কার্তিক মাসের শেষে আর অগ্রহায়ণ মাসেই সুপারির ভরা মৌসুম। এখানকার সুপারির প্রায় ৭০ ভাগ নদীনালা, খালডোবা, পুকুর ও পানিভর্তি পাকা হাউজে ভিজিয়ে রাখেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। আর ৩০ ভাগ সুপারি দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ ছাড়াও রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা হয়। এ বছর কাঁচা-পাকা সুপারির ভালো দাম পেয়ে খুশি চাষি, গৃহস্থ ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। লক্ষ্মীপুরে সুপারির প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র না থাকায় অনেক সময় কৃষকরা সুপারির ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হন।

জানা যায়, সুপারি গাছ একবার রোপণ করলে তেমন কোনো পরিচর্যা ছাড়াই টানা ৩৫-৪০ বছর ফলন দেয়। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় অন্যান্য ফসলের তুলনায় বেশি আয় করা যায়। সুপারি বাগানে পোকা-মাকড়ের আক্রমণ কিংবা রোগ-বালাই কম থাকায় এ অঞ্চলের কৃষকরা সুপারি চাষের দিকে বেশি ঝুঁকছেন। এ বছর মৌসুমের শুরুতেই সুপারি বিক্রির প্রধান মোকাম সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর শহর, দালাল বাজার, চররুহিতা, ভবানীগঞ্জ, মান্দারী, দত্তপাড়া, জকসিন, রায়পুর উপজেলা শহর, হায়দরগঞ্জ বাজার, সোনাপুর, দেনায়েতপুর, খাসের হাট, মোল্লারহাট, রামগঞ্জ উপজেলা শহর, কাঞ্চনপুর বাজার, করপাড়া বাজারসহ সুপারিকে ঘিরে বর্তমানে পুরো জেলায় চলছে জমজমাট ব্যবসা। গাছ থেকে সুপারি সংগ্রহ, ভিজিয়ে রাখা এবং বাজারজাত করতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন সুপারি চাষিরা। লাভজনক ও অর্থকরী পণ্য হওয়ায় সুপারি উৎপাদনে দিন দিন আগ্রহ বাড়ছে কৃষকের। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে সুপারি সরবরাহ হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে।

সুপারি চাষিরা জানান, সুপারি গাছের পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণে স্থানীয় কৃষি অফিসের সহযোগিতা এবং তদারকির কারণে গাছে রোগবালাই কম ও ফলন বেশি হয়েছে। গাছ রোপণ ও সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণে কৃষি বিভাগের আন্তরিক প্রচেষ্টার কারণে অর্থনৈতিক উন্নয়নে লক্ষ্মীপুরে এ অর্থকরী ফসল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারছে বলেও তারা জানান।

স্থানীয় কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলার সুপারি ব্যবসায়ীরা নিজেদের চাহিদামতো সুপারি স্থানীয় পাইকারদের কাছ থেকে সংগ্রহ করছেন। এ বছর প্রতি পোন সুপারি (৮০টি) মানভেদে ৯০ টাকা থেকে ১৭০ টাকা, প্রতি কাউন (১২৮০টি) সুপারি দুই হাজার থেকে দুই হাজার ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা গত কয়েক বছরের তুলনায় বেশি বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

সদর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ ও দত্তপাড়া বাজারের সুপারি ব্যবসায়ী মো. কামাল হোসেন জানান, প্রতিবছর এই মৌসুমে বিভিন্ন হাট থেকে সুপারি কিনে মজুদ করেন তিনি। পরে শুকিয়ে ও পানিতে ভিজিয়ে সুপারি সংরক্ষণ করে তা দেশের বিভিন্ন স্থানে পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন।

রায়পুর পৌরসভার দেনায়েতপুর এলাকার করিম মাঝি জানান, তার ৮০ শতাংশ জমিতে সুপারি বাগান রয়েছে। এ বাগানে মৌসুমে সুপারির বাম্পার ফলন হয়েছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর দাম খুব ভালো বলেও তিনি জানান।

সদর উপজেলার চররুহিতা গ্রামের সুপারি আড়তদার মো. জহিরুল ইসলাম জানান, গত বছরের তুলনায় এবার শুকনো সুপারির দাম বেশি। গত বছর শুকনো সুপারি প্রতি টন দেড় লাখ থেকে দুই লাখ টাকায় বিক্রি করা হলেও এবার বিক্রি করা হচ্ছে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকায়।

সদর উপজেলার জকসিন বাজারের সুপারি ব্যবসায়ী শাহদাৎ হোসেন জানান, গত বছর তিনি প্রায় ৩৫ লাখ টাকার সুপারি পানিতে ভিজিয়েছেন। এ বছর মৌসুমের শুরুতেই শুকনা ও কাঁচা-পাকা সুপারির পাশাপাশি পানিতে ভিজিয়ে মজানো সুপারি কিনতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্যবসায়ীরা আসছেন। গতবারের তুলনায় এবার ভালো দামও পাচ্ছেন তিনি।

চট্টগ্রামের পাইকারি সুপারি ব্যবসায়ী জাহিদুল ইসলাম জানান, সুপারির মান ভালো হওয়ায় তিনি প্রতিবছর লক্ষ্মীপুর থেকে পণ্যটি কেনেন। সাধারণত ফলন বাড়লে দাম কমে যায়। কিন্তু এবার ফলন ও দাম দুটোই বেড়েছে। দাম বেশি হওয়ায় চাষিরা লাভবান হলেও চাহিদামতো তিনি সুপারি কিনতে পারছেন না।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আবুল হোসেন জানান, এখানকার মাটি ও আবহাওয়া সুপারি চাষের জন্য বেশ উপযোগী। সুপারি বাগান করার মধ্য দিয়ে এখানকার কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার কাঁচা-পাকা সুপারির দাম কিছুটা বেশি। এত ভালো দাম পেয়ে চাষিরাও খুশি।