বছর না যেতেই সুদ পরিশোধ বেড়ে দ্বিগুণ

রোহান রাজিব: বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ পরিশোধে চাপে রয়েছে বাংলাদেশ। ঋণ পরিশোধের চাপের সঙ্গে বেড়েছে সুদ পরিশোধের চাপ। চলতি বছর শেষ না হতেই গত বছরের তুলনায় সুদ পরিশোধ বেড়েছে দ্বিগুণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে (জানুয়ারি-অক্টোবর) বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি ঋণ পরিশোধ হয়েছে ৫২৫ মিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের (২০২২) পুরো সময়ে ছিল ২৪৬ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গত বছরের পুরো সময়ের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে সুদ পরিশোধ বেড়েছে ২৭৯ মিলিয়ন ডলার বা ১১৩ দশমিক ৪১ শতাংশ। ২০১৯ সালে সুদ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ২১০ দশমিক ৫১ মিলিয়ন, ২০২০ সালে ১৬৭ দশমিক ৪৫ মিলিয়ন এবং ২০২১ সালে ১৩৮ দশমিক ৫৫ মিলিয়ন ডলার।

তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের প্রথম ১০ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুদ পরিশোধ হয় এপ্রিলে। ওই মাসে পরিশোধের পরিমাণ ছিল ১৩৭ মিলিয়ন ডলার। বাকি মাসগুলোয় এর পরিমাণ ছিল ৩৫ থেকে ৪৯ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে।

খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, বেসরকারি খাতে ঋণের সুদ পরিশোধ আগের তুলনায় বাড়তে পারে মূলত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুদহার বৃদ্ধির কারণে। এছাড়া আগের অনেক সুদ সময়মতো পরিশোধ করতে পারেননি ব্যবসায়ীরা। ওই সুদ পরিশোধের জন্য সময় নেয়া হয়েছিল। সেই সময় শেষ হওয়ার কারণে সুদ পরিশোধ করে দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। সে কারণেও আগের তুলনায় সুদ পরিশোধ বাড়তে পারে।

জানা যায়, কয়েক বছর আগেও দুই থেকে তিন শতাংশ হারে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হতো। বর্তমানে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুদহার বৃদ্ধির কারণে তা প্রায় ৯ শতাংশের কাছাকাছি হয়েছে, যার কারণে ব্যবসায়ীরা দ্রুত ঋণ পরিশোধ করে দিচ্ছেন। ঋণ পরিশোধের কারণেও বেশি সুদ পরিশোধ হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, বৈদেশিক ঋণের জন্য সর্বোচ্চ সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেটসহ (এসওএফআর) তিন শতাংশ সুদ দিতে হবে। বর্তমানে এসওএফআর ৫ দশমিক ৩০ শতাংশ, যা একসময় ছিল এক শতাংশের কম। তাই আন্তর্জাতিক বাজারে সুদের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় ঋণের সুদ পরিশোধের পরিমাণও বেড়ে গেছে।

এদিকে সংকটের কারণে বিদেশি ঋণসহ নানা উপায়ে ডলারের সরবরাহ বাড়াতে চাইছে সরকার। তবে রেমিট্যান্স কমছে। রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমেছে। এর মধ্যেই বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপে পড়েছে বেসরকারি খাত।

চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে বেসরকারি খাত যে পরিমাণ বিদেশি ঋণ নিয়েছে, পরিশোধ করতে হয়েছে তার চেয়ে ৪ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার বেশি। গত ১০ মাসে ২১ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি ঋণ পেয়েছে বেসরকারি খাত। একই সময়ে সুদ ও মূল ঋণ পরিশোধ হয়েছে ২৬ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারের। অর্থাৎ বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ নেয়ার চেয়ে পরিশোধ হচ্ছে বেশি।

বেসরকারি খাতের ঋণ দ্রুত পরিশোধের কারণে রিজার্ভের ওপর চাপ পড়েছে। তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বর শেষে গ্রস নিট রিজার্ভ (জিআইআর) কমে হয়েছে ১৯ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার। গত জুন শেষে রিজার্ভ ছিল ২৪ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে যে রিজার্ভ রয়েছে, তা দিয়ে চার মাসের কিছু কম সময়ের আমদানি দায় মিটবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসেবে রিজার্ভ রয়েছে ২৫ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের বেসরকারি খাতের বিদেশি বিভিন্ন ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠান থেকে নেয়া স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ১৬ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছরের ডিসেম্বরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ ১০ মাসে ঋণ পরিশোধ হয়েছে ৪ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলার।

ব্যাংকাররা জানান, করোনা শুরুর পর বিশ্ববাজারে সুদহার তলানিতে নামে। তখন বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ বেশ বেড়ে যায়। এখন এসব ঋণ পরিশোধের চাপ তৈরি হয়েছে। করোনার আগের বছর ২০১৯ সাল শেষে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণস্থিতি ছিল মাত্র ৮ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলারের। গত বছরের শেষে তা বেড়ে ১৬ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। মাত্র দুই বছরে ঋণ বাড়ে ৮ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। আর চলতি বছরের অক্টোবরে তা কমে ১২ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। এর মানে ঋণ যত দ্রুত বেড়েছিল, কমছেও সেভাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ঋণের প্রিন্সিপাল (মূল) ও সুদ দুই-ই পরিমাণে বেড়েছে। আমাদের ঋণের উল্লেখযোগ্য অংশই দ্বিপক্ষীয় (বাইলেটারেল) ও হার্ড লোন, সফট লোন নয়। যেমন এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি), বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের দেয়া লোন কিন্তু সফট লোন, যাদের সুদের হার অনেক কম। সফট লোনে সুদহার এক শতাংশ থেকে ১ দশমিক ২৫ শতাংশের মতো থাকে। সফট লোনের গ্রেস পিরিয়ড এবং রিপেমেন্ট পিরিয়ড বেশি (কখনও কখনও তা ২০ থেকে ২৫ বছর)। কিন্তু আমরা বিভিন্ন দেশ ও বাণিজ্যিক উৎস থেকে অনেক ঋণ নিয়েছি, যা বাইলেটারেল বা দ্বিপক্ষীয় ঋণ। বিভিন্ন উৎস থেকে নেয়া সরকারি ও বেসরকারি ঋণের সুদও কিন্তু বেশি। এগুলোর বেশিরভাগই কিন্তু স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি। এখন আমাদের কাছে ইমিডিয়েট চ্যালেঞ্জটি হলো স্বল্পমেয়াদি ঋণগুলো ম্যাচিউর (পরিশোধ) করতে হবে।

বিষয় ➧

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০