জয়নাল আবেদিন: করোনার প্রাদুর্ভাবে ক্ষতিতে পড়েছেন দেশের ছোট-বড় সব উদ্যোক্তা। ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় দেশের অর্থনীতিকে সচল করতে সরকার প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। কিন্তু এই প্রণোদনার ঋণ বড় উদ্যোক্তারা পেলেও কাক্সিক্ষত সুফল পাচ্ছে না কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো। মহামারির আঘাতে সরচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ছোট উদ্যোক্তা, কৃষক এবং নিম্ন-আয়ের জনগোষ্ঠী। তাদের জন্য ঋণ নিশ্চিত করতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, কিন্তু আশানুরূপ আগ্রহী হচ্ছে না ব্যাংকগুলো।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, বৃহৎ শিল্প ও সেবা খাতের জন্য ৩৩ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে চলতি মাসের ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ৩০ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা, অর্থাৎ ৯২ দশমিক ৭১ শতাংশ এরই মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। দুই হাজার ৯৬৮টি প্রতিষ্ঠান এ প্যাকেজের আওতায় চলতি মূলধন বাবদ ঋণ নিয়েছে।
বৃহৎ শিল্প ও সেবা খাতের উদ্যোক্তারা প্রণোদনার ঋণ পেলেও এমএসমই ও কৃষি খাতের উল্টো চিত্র। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ছোট উদ্যোক্তাদের চেয়ে বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ঋণ দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কারণ এসব ঋণ বিতরণে কষ্ট কম। যদিও বড় ঋণের চেয়ে কৃষি ও এসএমই ঋণের আদায় বেশি খেলাপি কম।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, সিএমএসএমই তহবিল নিয়ে শুরু থেকেই নানা অজুহাতে ছোট উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের ঋণ দিতে অনীহা দেখায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। ঋণ বিতরণ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাপ, সতর্কতা, ঋণ নিশ্চয়তা স্কিম (ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম) গঠনসহ নানা উদ্যোগও গ্রহণ করে। ঋণ দেয়ার বিভিন্ন শর্তও শিথিল করা হয়েছে। সিএমএসএমই ঋণ বিতরণে যে সুবিধা চেয়েছে ব্যাংকগুলো, তার প্রায় সবই দেয়া হয়েছে, কিন্তু তারপরও এ তহবিল থেকে বিতরণ তেমন গতি আসেনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, এসএমই ও কৃষি ক্ষেত্রের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজের বাস্তবায়ন হয়েছে কম। কারণ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্যাকেজগুলো থেকে ঋণ দিতে খুব একটা আগ্রহী নয়। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) খাতের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজের ঘোষণা করা হয়। ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর আগ্রহ কম থাকায় বারবার ঋণ বিতরণের সময় বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চতুর্থবার সময় বাড়িয়ে সবশেষ গত ৩১ ডিসেম্বর সিএমএসএমই ঋণ দেয়ার সময় বেঁধে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই সময় পর্যন্ত অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে ৪৬ শতাংশ অর্থ দিতে পারেনি ব্যাংকগুলো। কিন্তু কাক্সিক্ষত ঋণ বিতরণ না হওয়ায় তহবিল থেকে ঋণ দেয়ার সময় আরও তিনবার বাড়িয়েছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা। আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত এই তহবিল থেকে ঋণ পাবেন ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা।
৩১ ডিসেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, বিশেষ প্যাকেজে সিএমএসএমই খাতে ৭৬ হাজার ৩১৮ উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদিত ঋণের পরিমাণ ১২ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭২ হাজার ৯১২ জন উদ্যোক্তা ১০ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছে, যা মোট তহবিলের ৫৪ শতাংশ। বাকি অর্থ এখনও বিতরণ করা হয়নি।
এ বিষয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী (সিইও) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, বড় প্রতিষ্ঠানে ১০০ কোটি টাকা ঋণ দিতে যে শ্রম বা সময় লাগে, একই পরিমাণ অর্থ ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোয় দিতে গেলে অনেক সময় ব্যয় করতে হয়। এছাড়া খরচও বেশি। অন্যদিকে বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ নেয়ার প্রযয়োজনীয় কাগজপত্র দ্রুততম সময়ে দাখিল করে। কম সময়ে দ্রুত বেশি ঋণ দেয়ার জন্য ব্যাংক কর্মকর্তারা বড় ঋণ বিতরণে বেশি আগ্রহী।
তিনি বলেন, ছোট উদ্যোক্তাদের প্রণোদনার ঋণ দেয়ার সুদহার, জামানতসহ বিভিন্ন বিষয় ব্যাংকারদের কিছু আপত্তি ছিল। কেন্দ্রীয় এরই মধ্যে এগুলো সমাধন করেছে। তাই আগামীতে এসএমই ঋণ বিতরণও বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।
কৃষকের পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা কৃষি খাতের ক্ষতি মোকাবেলায় কৃষকের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার বিশেষ তহবিলের ঋণ বিতরণেও ধীরগতি। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এ খাতে ৪৩টি ব্যাংকের মাধ্যমে এক লাখ ৪৭ হাজার ২৫০ কৃষক তিন হাজার ৩৫০ কোটি ঋণ পেয়েছেন। তবে এখনও দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ এ তহবিলে পড়ে আছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, শিল্পগ্রুপগুলোর একটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হলে অন্য প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা দিয়ে পুষিয়ে নেয়ার সুযোগ থাকে, ছোট উদ্যোক্তাদের সেই সুযোগ থাকে না। করোনায় বেশি ক্ষতি হয়েছে ছোট ব্যবসায়ীদের। তারা মহামরিতে নিজের পুঁজি ভেঙে চলছে। কিন্তু এখন তারাই সময়মত সহায়তা পাচ্ছে না। ব্যাংকগুলো ছোটদের ঋণ দিতে অবহেলা করছে, যার কারণে তারা ঋণ পেতে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এটা চলতে থাকলে অনেক ছোট উদ্যোক্তা নিঃস্ব হয়ে যাবে। এতে করে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তিনি বলেন, আমরা লক্ষ করছি ব্যাংকগুলো সব সময় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে বেশি মনোযোগী। এর কারণ কম সময়ে বেশি ঋণ দেয়া যায়। ব্যাংকের কর্মকর্তারা তাদের লক্ষ্য পূরণে শর্টকাট রাস্তা খোঁজে। এক-দেড়শ ছোট উদ্যোক্তাকে ঋণ দেয়ার চেয়ে তারা সহজে চার-পাঁচ বড় উদ্যোক্তাকে ঋণ দেয়। এতে করে সব সময় বড়রা ঋণ পায়, বঞ্চিত হয় ছোটরা। এসএমই ঋণ বিতরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি জোরদার করার পরামর্শ দিয়ে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ঋণের সুষম বণ্টনের জন্য কৃষি ও এসএমই ঋণের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক করে দিতে হবে এবং তার সঠিক বাস্তবায়ন করতে হবে। তা না হলে অর্থনীতি কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না।