পলাশ শরিফ: ইস্পাহানি পরিবার দেশের অন্যতম বনেদি ব্যবসায়ী পরিবার। এ পরিবারের নানা প্রজন্ম ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিপুল পরিমাণ পুঁজি বিনিয়োগ করে চলেছে। তাদের হাতে গড়া ১৯০ বছরের পুরোনো প্রতিষ্ঠানটি উপমহাদেশে গুণগত পণ্য ও সেবা প্রদানে অনন্যসাধারণ দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে।
শিল্পগোষ্ঠী ‘ইস্পাহানি’র প্রতিষ্ঠাতা হাজী মোহাম্মদ হাশেম ইস্পাহানি। ১৮২০ সালে পারস্যের ইস্পাহান শহর থেকে ভারতবর্ষের বোম্বে নগরীতে এসে ব্যবসা শুরু করেন। উনিশ শতকের ৩০ দশকে কলকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত করেন তার ব্যবসা। ভারতের ব্যবসায়ী হিসেবে ওই সময় হাজী হাশেম কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত আসাম টি কোম্পানির একমাত্র মুসলিম সদস্য ছিলেন।
তার দূরদর্শিতার কারণে ইস্পাহানি শিল্পগোষ্ঠীর ব্যবসার পরিধি পশ্চিমে বোম্বে, দক্ষিণে মাদ্রাজ ও পূর্বে বার্মাসহ ভারতবর্ষের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। হাজী হাশেমের দৌহিত্র মির্জা মেহেদী ইস্পাহানি ব্যবসায়িক সদর দফতর মাদ্রাজে স্থানান্তর করেন। তিনি ১২ বছর মিসরের কায়রো শহরে ছিলেন। সেখানে চামড়া, চা, মশলা ও অন্যান্য ভারতীয় পণ্যের বিশাল ব্যবসা গড়ে তোলেন। ১৮৮৮ সালে মির্জা মেহেদীর হাত ধরে ঢাকা পর্যন্ত বিস্তৃত হয় ব্যবসা। তার ছেলে মির্জা মোহাম্মেদ ইস্পাহানি ১৯০০ সালে কলকাতায় ‘এমএম ইস্পাহানি অ্যান্ড সন্স’-এর একটি অফিস স্থাপন করেন। একই বছর লন্ডনেও শাখা অফিস খোলা হয়। তার তিন ছেলে মির্জা আহমেদ ইস্পাহানি, মির্জা আবুল হাসান ইস্পাহানি ও মির্জা মাহমুদ ইস্পাহানি ১৯৩৪ সালে ‘এমএম ইস্পাহানি’ নামে একটি লিমিটেড কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৭ সালের মধ্যেই শাল্যাক (বার্নিশ বা গালার পাত) কেইপক (জাজিম, লাইফ বেল্ট), হোসিয়ান (চটের সুতা ও কাপড়), পাটের ব্যাগ, চা ও রাসায়নিক পণ্যের অন্যতম প্রধান রফতানিকারক কোম্পানিতে পরিণত হয় ইস্পাহানি।
১৯৪৭ সালের পর ইস্পাহানি পরিবারের করপোরেট হেড অফিস পূর্ববাংলার বন্দরনগরী চট্টগ্রামে স্থানান্তর করা হয়। তখন এ কোম্পানির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেন মির্জা আহমেদ ইস্পাহানির ছেলে একেএ সদরী ইস্পাহানি। তিনি মির্জা মেহেদী ইস্পাহানি নামে পরিচিত। তিনি ১৯৪৯ সালে এমএ ইস্পাহানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০০৪ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কোম্পানির প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার নেতৃত্বেই কোম্পানির মালিকানাধীন সিলেটের চা বাগানগুলোয় প্রচুর বিনিয়োগ করা হয়। এর মধ্য দিয়ে দেশের চা শিল্পে ‘ইস্পাহানি গ্রুপ’ সফল হয়। পাকিস্তান আমলেই এ গ্রুপ ছিল চাশিল্পের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি।
বৃহত্তর সিলেট, মির্জাপুর, গাজীপুর ও চট্টগ্রামসহ দেশজুড়ে বর্তমানে ১৬৭টি চা বাগান রয়েছে তাদের। ইস্পাহানি কোম্পানির মালিকানাধীন বাগানগুলোয় একরপ্রতি চা উৎপাদন ১৮০০ কিলোগ্রামেরও বেশি। যা বাংলাদেশে একরপ্রতি চা উৎপাদনে সর্বোচ্চ। গুণগত মানেও সেরা তাদের চা। প্রতিবছর চট্টগ্রামে প্রিমিয়াম মানের এসব চা নিলামে বিক্রি হয়। এর মধ্যে মির্জাপুর, গাজীপুর ও জেরিন চা বাগান অনেক আগেই দেশের শীর্ষ ১০টি চা বাগানের তালিকায় স্থান পেয়েছে।
শুধু তা-ই নয়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে পাট, টেক্সটাইল ও শিপিং ব্যবসাও করে আসছে গ্রুপটি। ১৯৪৭ সালের আগে ইস্পাহানি কোম্পানি ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় পাট রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান ছিল। বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইস্পাহানি শিল্পগোষ্ঠী ‘চিটাগাং জুট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড (সিজেএমসিএল)’ নামে ব্যক্তি খাতে সর্ববৃহৎ পাটকল প্রতিষ্ঠা করে। একইভাবে ইস্পাহানি শিল্পগোষ্ঠীর মালিকানাধীন ‘পাহাড়তলী হোসিয়ারি মিলস (পিটিএইচএম)’ পূর্ববাংলায় টেক্সটাইল শিল্পের পথিকৃৎ হিসেবে কাজ করেছে। এছাড়া প্রায় ৫০ বছর ধরে ইস্পাহানি শিল্পগোষ্ঠী বিশ্বখ্যাত শিপিং কোম্পানিগুলোর পক্ষে ও নন ভেসেল অপারেটিং কমন ক্যারিয়ার্সের স্থানীয় এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে। অবশ্য বাংলাদেশে শিপিং ব্যবসার সঙ্গে ইস্পাহানি শিল্পগোষ্ঠীর সম্পর্ক আরো পুরোনো। ১৯৪৬ সালের ২৩ অক্টোবর মির্জা আহমেদ ইস্পাহানি কলকাতায় ‘ওরিয়েন্ট এয়ারওয়েজ লিমিটেড’ নামে পূর্ববাংলায় প্রথম বেসরকারি ও বেসামরিক বিমান পরিবহন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৭ সালে বিভক্তির পরও এটি ছিল পূর্ববঙ্গের একমাত্র বেসামরিক বিমান পরিবহন কোম্পানি। পরে পাকিস্তান সরকার পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন (পিআইএ) গঠনের মাধ্যমে বিমান পরিবহন সরকারি খাতে নিলে ১৯৪৮ সালে ওরিয়েন্ট এয়ারওয়েজ বন্ধ হয়ে যায়।
ইস্পাহানি শিল্পগোষ্ঠীর সর্বশেষ চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মির্জা আলী বেহরুজ ইস্পাহানি। তিনি গত ২৩ জানুয়ারি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার অবর্তমানে শিল্পগোষ্ঠীর হাল ধরতে যাচ্ছেন ছেলে মির্জা সালমান ইস্পাহানি। তিনি বর্তমানে ওই ব্যবসায়ী গ্রুপটিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন।
১৯৪৭ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ও শিল্পায়নে ইস্পাহানি শিল্পগোষ্ঠী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ইস্পাহানি শিল্পগোষ্ঠী চা, টেক্সটাইল, পাট ও শিপিংসহ বেশকিছু খাতে সফলভাবে ব্যবসা চালিয়ে আসছে। বাংলাদেশে অন্যতম বৃহৎ চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্থান পেয়েছে গ্রুপটি।
বাংলাদেশে ইস্পাহানি পরিবার সামাজিক দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা পালন করে চলেছে। বিশেষ করে শিক্ষা বিস্তার ও উন্নয়নে তারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। দেশজুড়ে তাদের ৯টি স্কুল ও কলেজ রয়েছে। রয়েছে বেশ কয়েকটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানও। এর মধ্যে শীর্ষে আছে ইস্পাহানি চক্ষু হাসপাতাল ও এমএ ইস্পাহানি ইনস্টিটিউট অব অফথালমোলজি। বহুজাতিক ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক লিমিটেডের সহায়তায় হাসপাতালটি বাংলাদেশে অন্ধত্ব দূরীকরণের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। একই সঙ্গে ওই হাসপাতাল এখন বিশ্বখ্যাত চক্ষু প্রতিষ্ঠান সাইট সেভার্স ইন্টারন্যাশনাল ও অরবিসের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে।
বনেদি শিল্পগোষ্ঠী ইস্পাহানি

Add Comment