রহমত রহমান: প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে ছয় বছর আগে। হয়নি কোনো নিরীক্ষা। কাঁচামাল আমদানি হয়েছে, কিন্তু তার কোনো হদিস নেই। পণ্য রপ্তানি হয়েছে কি না, তার কোনো প্রমাণ নেই। অথচ প্রায় সাড়ে ১৫ কোটি টাকার বন্ড সুবিধার কাঁচামাল আমদানি করেছে তৈরি পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠান মেসার্স নাজিয়াত সোয়েটার্স লিমিটেড, যাতে শুল্ককরের পরিমাণ প্রায় পৌনে চার কোটি টাকা।
এনবিআর বলছে, নাজিয়াত গ্রুপের প্রতিষ্ঠানটি বন্ডের অপব্যবহার করেই সুযোগ বুঝে বন্ধ করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির কোনো অস্তিত্ব নেই। আর প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বলছে, পণ্য রপ্তানি হয়েছে, তবে টাকা দেশে আসেনি। শুল্ককর ফাঁকি ও বন্ডের অপব্যবহার প্রমাণিত হওয়ায় এই প্রতিষ্ঠানটিকে অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে। বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটিকে এই অর্থদণ্ড দিয়েছে। পাশাপাশি বন্ড লাইসেন্স স্থগিত করা ও প্রতিষ্ঠানের বিআইএন লক করা হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
সূত্রমতে, রাজধানীর উত্তরার চালাবন শাহ কবির মাজার রোড এলাকার প্রতিষ্ঠান মেসার্স নাজিয়াত সোয়েটার্স লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি ২০০৪ সালে বন্ড লাইসেন্স পায়। মূসক নিবন্ধন নেয় ২০১২ সালে। বন্ড সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি করার শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে খোলাবাজারে বিক্রির অভিযোগ ওঠে। নানা কারণ দেখিয়ে প্রতিষ্ঠান ২০১৪ সাল পর্যন্ত নিরীক্ষা সম্পন্ন করেনি। ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দেয়া হয়। তবে বন্ড কমিশনারেট থেকেও নিরীক্ষা করার উদ্যোগ নেয়া হয়নি বলে দাবি করেছে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। আর প্রতিষ্ঠানটি যে বন্ধ করা হয়েছে, এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বন্ড কমিশনারেটকে লিখিতভাবে কিছুই জানায়নি।
সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির আমদানি করা কাঁচামাল ও রপ্তানির তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ নেয় বন্ড কমিশনারেট। নিরীক্ষা সম্পন্ন করতে প্রতিষ্ঠানটির কাছে কাঁচামাল আমদানি, পণ্য রপ্তানি ও ইউডির তথ্য চেয়ে কয়েকবার চিঠি দেয়া হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে কোনো কাগজপত্র দেয়া হয়নি। পরে বন্ড কর্মকর্তারা এনবিআরের সিআইএস সেল থেকে নাজিয়াত সুয়েটার্সের তথ্য সংগ্রহ করেন, যাতে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৪ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত বন্ড সুবিধায় ১৫ কোটি ৫৮ লাখ ৮০ হাজার ৮৮৩ টাকার কাঁচামাল আমদানি করেছে, যাতে আদায়যোগ্য শুল্ককর তিন কোটি ৬৬ লাখ ৬৬ হাজার ৯০৭ টাকা।
বন্ড কর্মকর্র্তারা বলছেন, প্রতিষ্ঠানটিকে বারবার চিঠি দেয়ার পরও কোনো কাগজপত্র দিয়ে সহযোগিতা করেনি। প্রতিষ্ঠানটির কোনো রপ্তানির তথ্য পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ শুল্ককর ফাঁকি দিতেই এই বিপুল পরিমাণ কাঁচামাল খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে, যা কাস্টমস আইন অনুযায়ী দণ্ডযোগ্য। কাঁচামাল আমদানি ও পণ্য রপ্তানির বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যাখ্যা ও শুল্ককর পরিশোধে চলতি বছরের ১৭ জুন প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানায় দাবিনামা-সংবলিত কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ কোনো জবাব দেয়নি ও শুনানিতে কেউ অংশ নেয়নি। পরে ২৫ অক্টোবর পর্র্যন্ত চারবার নোটিস জারি করা হয়। কিন্তু শুনানিতে কেউ উপস্থিত হয়নি।
পরে মামলার নথি, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ও প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে ২ ডিসেম্বর ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনার মামলার রায় দেয়, যাতে বলা হয়, প্রতিষ্ঠান কোনো সহযোগিতা করেনি। সিআইএস সেল থেকে আমদানির তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তবে যে কাঁচামাল আমদানি করেছে, তার বিপরীতে কোনো পণ্য রপ্তানির তথ্য দাখিল করেনি। রপ্তানির কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। চারবার শুনানিতে ডাকা হলেও প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ অংশ নেয়নি বলে রপ্তানির বিষয়টি প্রমাণিত হয়নি। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি কাঁচামাল অবৈধভাবে অপসারণ করেছে বলে প্রমাণিত হয়েছে। কাস্টমস আইন লঙ্ঘন করে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করায় প্রতিষ্ঠানটিকে ১৪ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে। ফাঁকি দেয়া শুল্ককর ও অর্থদণ্ডসহ মোট তিন কোটি ৮০ লাখ ৬৬ হাজার ৯০৭ টাকা ১৫ দিনের মধ্যে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে প্রতিষ্ঠানটিকে নির্দেশ দেয়া হয়।

এ বিষয়ে এনবিআরের একজন সদস্য শেয়ার বিজকে বলেন, প্রতিষ্ঠানটি শুল্ককর ফাঁকি দিতেই সব কাঁচামাল খোলাবাজারে বিক্রি করে সুযোগ বুঝে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার আগে ব্যবস্থা না নেয়ার ফলে প্রতিষ্ঠানটি সুযোগ পেয়েছে। শুল্ককর ফাঁকিতে এখানে প্রতিষ্ঠান ও বন্ড কমিশনারেট সমান দায়ী। তবে প্রতিষ্ঠানটি বলছে, রপ্তানি করেছে, টাকা আসেনি। মানে প্রতিষ্ঠানটি জেনে-বুঝেই রপ্তানির মাধ্যমে টাকা পাচার করে দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব না থাকলেও চেষ্টা করলে সেটির কর্তৃপক্ষকে বিচারের মুখোমুখি করা যায়।
এ বিষয়ে নাজিয়াত সোয়েটার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা যা কাঁচামাল আমদানি করেছি, তা দিয়ে তৈরি করা সব পণ্য রপ্তানি হয়েছে। কোনো কাঁচামাল বাইরে বিক্রি হয়নি। তবে রপ্তানির টাকা দেশে আসেনি।’ টাকা দেশে না আসার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সঠিক সময়ে শিপমেন্ট হয়নি, অর্ডার ক্যানসেল হয়েছে এবং নানা ঝামেলা ছিল। তাই টাকা দেশে আসেনি।’
বন্ড কমিশনারেট বলছে, রপ্তানির কোনো তথ্য নেই, আপনারা কোনো পণ্যই রপ্তানি করেননি। এ বিষয়ে শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘রপ্তানি করেছি। আমাদের লাইসেন্সের হালনাগাদ মেয়াদে নিরীক্ষা বাকি রয়েছে। আমরা নিরীক্ষা করাইনি।’ বন্ড কমিশনারেট মামলার পর শুনানিতে অংশ নিতে চারবার চিঠি দিলেও আপনারা আসেননি এ কথায় তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো চিঠি পাইনি। চিঠি পাব কী করে, আমাদের ফ্যাক্টরি আগের ঠিকানায় নেই। বাড়িওয়ালার সঙ্গে ভাড়া নিয়ে ঝামেলা হওয়ার পর সেই বাড়ি আমরা ছেড়ে দিয়েছি। ফ্যাক্টরি ২০১৫ সাল থেকে বন্ধ। সেই ফ্যাক্টরির নামে ঋণ রয়েছে। আমি এখন ঋণখেলাপি।’